সাভার (ঢাকা) সংবাদদাতা : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ বেষ্টিত সাভারের বিরুলিয়া গোলাপ গ্রাম। এই গ্রামের ছোঁয়ায় যেন পূর্ণতা পায় ভালোবাসার। ভালোবাসা দিবস বরণে যেন লাল রঙে সেজেছে ৬টি গ্রাম। আর এই লাল টুকটুকে গোলাপের টানে মাতোয়ারা দর্শনার্থীরাও। তাই তো দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন গোলাপপ্রেমীরা। এখান থেকেই এবার ভালোবাসার দিনে মানুষের কাছে ৫০ কোটি টাকার গোলাপ পৌঁছে যাবে বলে আশা গোলাপচাষিদের। এক প্রহর পরেই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বসন্তের প্রথম দিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও উদ্যাপন হবে দিবসটি। দিবসটি লাল গোলাপ ছাড়া উদ্যাপন যেন অসম্ভব।
তাই পরম যত্নে প্রায় ২৮৩ হেক্টর জমিতে গোলাপসহ ৩০৫ হেক্টর জমিতে ফুল উৎপাদন করেছেন গোলাপগ্রামের চাষিরা। এবার অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভালো ফলন হওয়ায় হাসি ফুটেছে চাষিদের মুখে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, শ্যামপুর, সাদুল্লাহপুর, মৈস্তাপাড়া, বাগনীবাড়ি, বাটুলিয়া ও কমলাপুর উঁচু লাল মাটিসহ বিভিন্ন গ্রামে সুবাস আর সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে লাল গোলাপ। এসব গ্রামের সমষ্টিই গোলাপ গ্রাম নামে পরিচিত। যতদূর শুধু চোখ যায় গোলাপের বাগানে গোলাপ আর গোলাপ। যেন স্বপ্নের গ্রামে পরিণত হয়েছে গ্রামগুলো। বাগানের পাশেই গড়ে উঠেছে ফুলের দোকান। দৃষ্টিনন্দন ফুলের তোড়া, মাথার রিং, কানের দুল ও মালাও পাওয়া যাচ্ছে এখানে। ফুল কেনার পাশাপাশি বাগানে প্রবেশ করে প্রিয়জনের সঙ্গে ছবি তুলছেন বেশিরভাগ দর্শনার্থী। গোলাপচাষিরা জানায়, ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ফুল বিক্রির ভরা মৌসুম। ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস), পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, শহীদ দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফুল বিক্রি বাড়ে কয়েকগুণ। চাষিদের আশা, এবার এই মৌসুমে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে। তাই চাষিরা বাড়তি যত্নে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাভার কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এবার বিরুলিয়ায় প্রায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছে। এসব জমিতে গোলাপ ফুল চাষ করছেন প্রায় দেড় হাজার চাষি। গোলাপ ছাড়াও এখানে উৎপাদন হচ্ছে গাদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরাসহ বাহারি রঙের ফুল।
চাষিরা এসব ফুল তুলে ইউনিয়নের শ্যামপুর ও মৈস্তাপাড়ায় বসে ফুলের বাজার। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এই বাজারে চলে ফুল বিক্রি। তাই বিকেলের মধ্যেই চাষিরা ফুল তুলে বাজারে নিয়ে যান। আর এখান থেকে ব্যবসায়ীরা ফুল সংগ্রহ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। এবার প্রায় ৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা। সরেজমিনে দেখা গেল, ফুলের মৌসুম ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন গোলাপচাষিরা। কেউ বাগানে সেচ, কেউ বা সার ও কীটনাশক দিচ্ছেন গোলাপ বাগানে। অনেকেই আবার বিক্রির জন্য বাগান থেকে গোলাপ সংগ্রহ করছেন।
সাদুল্লাহপুর এলাকার বাগান মালিক মোক্তার হোসেন বলেন, করোনা ও ছত্রাকের হানায় আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিন্তু এবার কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। আবহাওয়াও ছিল অনুকূলে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ফুলও ফুটেছে আশানুরূপ। বিগত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ এবার রয়েছে। যদি ফুলের বাজার ভালো হয় তাহলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। বাগানেই বর্তমানে ফুল বিক্রি হচ্ছে ৭/১০ টাকায়। যা আগামীকাল বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২০/২৫ টাকায়। ফুলচাষি ইমরান হোসেন বলেন, বাজারে প্লাস্টিকের ফুলে ভরে গেছে। যা তাজা ফুলের বাজারে প্রভাব বিস্তার করেছে। যে কারণে আমরা ভালো বাজার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা চাই প্লাস্টিকের ফুল আমদানি বন্ধ করা হোক। এছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা গত বেশ কয়েক বছর ক্ষতির মুখে পড়েছিলাম। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের বেগ পেতে হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ঋণ সহায়তা দিলে আমাদের অনেক উপকার হতো। এদিকে গোলাপের টানে দূরদূরান্ত থেকে বিরুলিয়ায় ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। তারা লাল গোলাপের সমারোহে বিমোহিত। লাল গোলাপের সুবাস নিতে ঢাকার ধামরাই থেকে ফুলের বাগানে এসেছেন নাইম দম্পতি। তারা বলেন, ভালোবাসা দিবস ঘিরে এখানে গোলাপ বাগানের বাড়তি যত্ন নেন চাষিরা। এসময় বাগান ভরা ফুল থাকে। এই গোলাপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসা। আমরা এখানে দ্বিতীয়বারের মতো এসেছি। এখানে এলে অনেক ভালো লাগে। কোলাহল নেই, শুধু গোলাপ আর গোলাপ। এখানে এসে আমরা অনেক ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি। সারাদিন অনেক ভালো কেটেছে। ঢাকা থেকে আসা তানিয়া আক্তার বৃষ্টি বলেন, গোলাপ গ্রামে এই প্রথম এসেছি। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে এখানে এসেছি। ফেসবুকে আর ইউটিউবে আমরা যা দেখেছি তার চেয়েও বেশি সুন্দর। তবে এখানে সুবিধামতো খাবারের ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো হতো। একই সঙ্গে ওয়াশরুমের ব্যবস্থাটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি। যেহেতু এখানে দর্শনার্থী অনেক আসেন, এদিকটা নজর দেওয়া জরুরি। সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, বিরুলিয়া ইউনিয়নের ১০/১২ গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করা হয়। সাদুল্লাহপুর, মৈস্তাপাড়া, বাগনীবাড়ি, কালিয়াকৈর ও কমলাপুরসহ এসব গ্রামে প্রায় ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করছেন চাষিরা। অন্যান্য ফুলের চাষ হচ্ছে প্রায় ৭৫ হেক্টর জমিতে।
এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। সামনের তিন দিবসে এসব ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। গোলাপের পাশাপাশি অন্যান্য ফুলের চাষাবাদ বৃদ্ধিতে এবার নজর দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে কৃষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে সাবেদ আলী নামের এক গোলাপপ্রেমী বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুরে ফুল চাষ শুরু করেন। ফলন অনেক ভালো ও লাভবান হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকে পড়েন গোলাপ চাষে। সাবেদ আলীর দেখানো পথে ধরেই স্থানীয় কৃষকসহ বেকার যুবকেরা গোলাপ চাষ শুরু করেন। ধীরে ধীরে বিরুলিয়া ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামগুলোতেও গোলাপের চাষ বাড়তে থাকে। বর্তমানে ১০ থেকে ১২টি গ্রামের ৯০ ভাগ জমিতেই চাষ হচ্ছে গোলাপ। সঙ্গে বিরুলিয়া ইউনিয়নের এসব গ্রাম রূপান্তরিত হয় গোলাপ গ্রাম নামে।