নিজস্ব প্রতিবেদক ও চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছেছে। একটি ইউরোপীয় জাহাজ থেকে আবদুল্লাহর ওপর নজর রাখার কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স-ইইউএনএভিএফওআর, যাদের কার্যক্রম অপারেশন আটলান্টা হিসেবে পরিচিত। পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে জলদস্যুতা নির্মূলে কাজ করে যাওয়া এই ইউরোপীয় নৌ নিরাপত্তা বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অপারেশন আটলান্টার অংশ হিসেবে তারা সোমালিয়া উপকূলে একটি জাহাজ মোতায়েন করেছে। ওই জাহাজটি বাংলাদেশি কার্গো জাহাজ আবদুল্লাহকে অনুসরণ করছে। এবিসি নিউজ লিখেছে, সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ১১০০ কিলোমিটার দূরে এমভি আব্দুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে জিম্মির খবর মঙ্গলবার প্রথম জানতে পারে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়া পথে দুস্যদের কবলে পড়ে এমভি আব্দুল্লাহ। কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি নৌপথে পণ্য পরিবহন করে। দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার সময় এসআর শিপিং কর্তৃপক্ষ ও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন নাবিকরা। মুক্তিপণ না দিলে দস্যুরা তাদের মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে বলেও জানান। তবে এখন পর্যন্ত জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিকল্প হিসেবে ‘সেকেন্ড পার্টির’ মাধ্যমে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন।
মন্ত্রী বলেছেন, “ইতোমধ্যে রিপোর্টিং সেন্টার ইন কুয়ালালামপুর, ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার ইন নিউ দিল্লি, তারপর সিঙ্গাপুর, ইউএসএ, ইউকে, চায়নাসহ সকল এরিয়াল নেভাল শিপে জানানো হয়েছে। অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।” এদিকে ইইউএনএভিএফওআর তাদের বিবৃতিতে বলেছে, এমভি আবদুল্লাহর ওপর নজর রাখার পাশাপাশি ‘কার্যকর পদক্ষেপ’ নেওয়ার জন্য অপারেশন আটলান্টার পক্ষ থেকে সোমালিয়া ও বাংলাদেশ সরকার এবং ভারতীয় নৌবাহিনীসহ সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে তারা। সেই কার্যকর পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা স্পষ্ট করা না হলেও মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স এ আরেক পোস্টে ইইউএনএভিএফওআর তাদের যুদ্ধজাহাজ এবং সামরিক বিমান ‘অপারেশনের এলাকায়’ সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ মারচেন্ট মেরিন অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার জানানো হয়, জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বৃহস্পতিবার সেটি সোমালিয়ার গারাকাদ উপকূলের ২০ মাইল দূরে সাগরে নোঙ্গর ফেলে বলে তারা জানতে পেরেছে।
পরে জাহাজের মালিক এস আর শিপিং লাইনের মূল কোম্পানি কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ সময় বেলা ১টার দিকে এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছেছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তারা জাহাজ তীরে পৌঁছানোর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। পাশাপাশি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকেও জাহাজের মালিকপক্ষকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে মিজানুল ইসলাম বলেন, ইইউএনএভিএফওআর এর একটি জাহাজ যে এমভি আবদুল্লাহকে অনুসরণ করছেন, সেটি তারা জানতে পেরেছেন। তবে বুধবার রাতে জাহাজ ঘিরে গোলাগুলির যে কথা শোনা যাচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। এবিসি নিউজ লিখেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সের সামরিক অভিযানে হর্ন অব আফ্রিকা ও পশ্চিম ভারত মহাসাগরীয় উপকূলে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা অনেক কমে এসেছিল। তবে গত কয়েক মাসে নতুন করে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে জলদস্যুরা। গত ডিসেম্বরে অন্তত দুটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। একটি ঘটনায় সোমালিয়ার উপকূলে ইল শহরের কাছে ভারী অস্ত্রধারী জলদস্যুরা একটি বাণিজ্যিক জাহাজ জিম্মি করে। আরেকটি ঘটনায় মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ ছিনতাই করা হয় আরব সাগরে। ওই জাহাজটিও সোমালিয়ার একই উপকূলের দিকে নেওয়া হয়। সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুতা সবথেকে বেশি হয়েছিল ২০১১ সালে। জাতিসংঘের হিসাবে, সাগরে সেসময় ১৬০টি জাহাজ ছিনতাই হয়।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টার দিকে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। সে সময়ে জাহাজটি সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে প্রায় ৭০০ মাইল দূরে ছিল। এমভি আব্দুল্লাহ হাইজ্যাক হওয়ার বিষয়টি সবার প্রথম ব্রিটিশ সেনাবাহিনী রিপোর্ট করেছিল। তারা জানায় যে, সোমালিয়ার উপকূলীয় রাজধানী মোগাদিশু থেকে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার দূরে এই ঘটনা ঘটে। ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাত থেকে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দিতে কাজ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অপারেশন আটলান্টা। এর আওতায় একটি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহকে’ ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ইইউ। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) বরাত দিয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, বর্তমানে জাহাজটি সোমালিয়ার গারাকাড উপকূল থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থান করছে। জাহাজটি এই দূরত্বে নোঙর করা অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম। বৃহস্পতিবার দুপুরে এ তথ্য জানান তিনি।
ব্রিটিশ মেরিটাইম সিকিউরিটি কোম্পানি অ্যামব্রেয়ের মতে, মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতো থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়া যাওয়ার সময় ২০ জন সশস্ত্র হামলাকারী জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।
জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে: কাদের
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল বৃহস্পতিবার ( ১৪ মার্চ) বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ের সময় এক প্রশ্নের উত্তরে কাদের এ কথা জানান। সোমালিয়ায় বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান সেতুমন্ত্রী। তিনি বলেন, জিম্মিদের উদ্ধারে সরকার খুবই সক্রিয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুবই তৎপর, যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। যারা জিম্মি আছে আমাদের ২৬ জন, ২৬ জনের ইন্সুরেন্সও আছে। তাদেরকে নিরাপদে রাখা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত সোমালিয়ায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলতে খুবই নাজুক। সেখানে কিছুদিন আগে এক সমীক্ষা দেখা যায় প্রতি মিনিটে দুর্ভিক্ষে একজন করে মানুষ মারা যায়। সেই দেশ সন্ত্রাস কবলিত, দুর্ভিক্ষ থেকেও অনেকেই অনেকেই তারা, জলদস্যুরা এ বিপথগামী হয়। এখানে মুক্তিপণ আদায় মূল লক্ষ্য। এখন সোমালিয়ার মোগাদিসুর দিকে জাহাজ যাচ্ছে। উপকূলে গিয়ে মঙ্গল করে হয়তো তারা কোনো মুক্তিপণ দাবি করতে পারে এমন শোনা যাচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগের কোন ঘাটতি নেই। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব সংক্রান্ত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সেতুমন্ত্রী বলেন, ড. ইউনূস একজন ব্যক্তি। জানতে চাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কে? তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের আইন আদালত আছে। যা সবার জন্য সমান। এখানে শ্রমিকেরা পাওনা না পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আইন আদালত সব দেশের নিজস্ব ব্যাপার। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, দাবিতো করতেই পারে। দাবির যৌক্তিকতা কতটুকু সেটাও তো আমাদের ভেবে দেখতে হবে। সরকার এখানে উদাসীন নয়। এ বিএনপি এখন বেগম জিয়াকে নিয়ে বড় বড় কথা বলে, সরকারের সমালোচনা করে। কিন্তু বছরের পর বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলা নিয়ে আদালতে তারা আইনি লড়াই করেনি। শুধু বিচারকে প্রলম্বিত করেছে। অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে হবে। আজকে এটা স্বীকার করতেই হবে, শেখ হাসিনার উদারতায় খালেদা জিয়া বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারছেন। এরপর ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি , সাধারণ সম্পাদক জাহানারা বেগম, যুব মহিলা লীগের সভাপতি ডেইজি সারোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি।

























