লেখক যদি তার প্রয়াণের পরও পাঠকের মাঝে রাজত্ব করতে পারেন তাহলে বলা যায় তিনি প্রকৃত এবং শক্তিমান লেখক। পৃথিবীর সব মহৎ ও শক্তিমান লেখকের বেলায় এই ভাবনা সত্য। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশের দিকে খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারবো কী বিপুলভাবে, কী পরাক্রমে তারা আমাদের মাঝে রয়েছেন। আমরা তাদের এড়াতে চাই না, চাইলেও পারি না
আমাদের চারপাশের যাপিত জীবনজাত নানামাত্রিক অভিজ্ঞান ও বিভূতি যেভাবে বিস্তারলাভ করে আমাদের চিন্তাজগৎকে প্রসারিত করে তাতে ব্যঞ্জনা এনে দেন সৃষ্টিশীল লেখকরা। একজন পাঠক হিসেবে আমি মনে করি সৈয়দ শামসুল হক সেই কাজটি ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে, তার রচনা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে বিপুল আগ্রহ, তাই প্রমাণ করে যে তিনি আমাদের চিৎপ্রকর্ষের মধ্যে রয়েছেন।
যারা তার কোনো কোনো পর্বের লেখাকে খারিজ করতে চান তাদের সাথে আমি একমত হতে পারি না। আমিও স্বীকার করি যে তার লেখার দুর্বলতা খুঁজে বের করা কঠিন কাজ নয়। সৈয়দ হকের লেখালেখি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি শক্তিমান মৌলিক কবি এবং লেখক ছিলেন; তিনি ছিলেন পরিশ্রমী ও জাত লেখক। লেখাকে তিনি তার ধ্যান ও জ্ঞানের মধ্যে রেখেছিলেন। বাংলাদেশে তিনি বোধহয় একমাত্র লেখক যিনি লিখেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তার সামগ্রিক রচনার দিকে এবং এর বৈচিত্র্যের দিকে তাকালে বোঝা যায় কী অসম্ভব কাজ তিনি করেছেন পাঁচ-ছয় দশক ধরে।
পঞ্চাশ দশকের শুরুতে সৈয়দ শামসুল হক বাবার হাত ধরে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছিলেন; জীবনের অনভববেদ্য সূক্ষ্ম কিছু কৌতূহলকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করার দীপ্র প্রত্যয় নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন শিল্পীজীবন। বিচিত্র জীবন-বিন্যাস আর শৈশবের স্মৃতি, মানুষ আর জনপদকে আণুবীক্ষণিকভাবে দেখার দুর্মর লোভ আর অবিরাম প্রপন্ন বিস্ময়ের ঘেরাটোপে বন্দি লড়াকু এক কিশোর কলম তুলে নিয়েছিল বাংলা ভাষায় সাহিত্য করার মানসে। আরো পরে, যখন তার অভিজ্ঞান বেশ পুষ্ট, শিল্পের অমোঘ ডাকে সে পরাজিত, ঘোষণা দিয়ে ফেলেন, লিখেই বেঁচে থাকবো । বাংলাদেশে বা বাংলা ভাষাভাষী কোনো লেখক এরকম দৃঢ়প্রত্যয় আর কখনো ব্যক্ত করতে পারেননি। ততদিনে তিনি বুঝে নিয়েছেন, সাহিত্যসৃজন তার একমাত্র পথ, শিল্পই তার সংসার এবং জীবনের তরঙ্গের দোলায় দোলায়, উপলব্ধির শানুদেশে চলতে চলতে, তাকে খুঁজে নিতে হবে লেখার মালমশলা।
আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশে তার মতো নিবেদিত, লেখার জন্য সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠিত এবং শিল্পের গতিমান নিরীক্ষায় নিপতিত লেখক দ্বিতীয় কেউ নেই। আমাদের হয়তো এ যাবৎ অঙ্গুলিমেয় সিরিয়াস লেখক আছেন, তবু তারা সার্বক্ষণিক পাঠক বা লেখক নন। এর সাথে আরো যোগ করতে হবে লেখার মান এবং বৈচিত্র্যকে। সৈয়দ হক বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় মাধ্যমে স্বচ্ছন্দে লিখেছেন, এমন কয়েকটি ফর্মে তিনি লিখেছেন যা তার আগে কোনো বাংলাদেশি লেখক লেখেননি। কাব্যনাটককে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়। সৈয়দ হক কাব্যনাট্য শুরু করেছিলেন অসামান্য সফলতা দিয়ে। কাব্যনাট্য লেখার সময় তিনি মৈমনসিংহ গীতিকাকে আদিপাঠ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। আর এরসঙ্গে যুক্ত করেছিলেন টিএস এলিয়টের নাট্যভাবনা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাংলার হাজার বছরের কাব্যের মধ্যেই নাট্যবীজ লুকিয়ে আছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের নিবিড় পাঠের ফলে এই সত্য তিনি আবিষ্কার করেন। এর প্রয়োগ করেন কাব্যনাট্যে। তার অন্যান্য নাটকও সমানভাবে মঞ্চসফল ও শিল্পোত্তীর্ণ। নাটকে বা অন্যশাখার অনুবাদে তার সফলতা ঈর্ষণীয়। সেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ ও জুলিয়াস সিজার অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন সল বেলোর উপন্যাস ‘শ্রাবণরাজা’ নামে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বিশেষত ইংরেজি ভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন অজস্র। সেই অনুবাদ প্রাণবন্ত এবং তা এ দেশীয় পটভূমিতে মিশে গেছে। উর্দু বা ফার্সি ভাষার বিখ্যাত কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছেন ‘গোলাপের বনে দীর্ঘশ্বাস’ নামক গ্রন্থে।
সৈয়দ হক বাংলা কবিতায় বিচিত্র প্রকরণ সংযোজন করেছেন। পঞ্চাশের প্রথম পাদেই সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে। স্বাভাবিক গঠনের বাইরে তিনি চিত্রধর্মী, একলাইনের কবিতা, কোরাস জাতীয় কবিতা, দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। এর বাইরে রয়েছে আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সনেটগুচ্ছ ‘পরানের গহীন ভেতর’। নিরীক্ষা প্রবণতার কারণে তার কবিতা কখনো কখনো স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছে তবে তার নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অনেক উজ্জ্বল কবিতাও আমরা পেয়েছি যা বাংলা কবিতাকে ধনী করেছে। কাব্যনাট্যে তার যে অসমান্য অবদান তার মূলেও রয়েছে তার কাব্যপ্রতিভার গভীরতা।
‘হৃদয় যেন, রংগপুরের কণকরঙা মেয়ে/হঠাৎ সাড়া জগিয়ে দিয়ে লুকোয় পরাণ পণে’(বুনোবৃষ্টির গান)। এই কবিতাটি রচিত হয়েছিল পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে। এর পাশে ২০১১ সালে প্রকাশিত কাব্য ‘তোমার নক্ষত্র এই রক্তের লোহিতে’র কবিতা তুলনা করলে বোঝা যাবে এত বছর পরও কত তীক্ষ্ম তার অনুভূতির ফলা, কতটা অনুভববেদ্য তার হৃদয়মানস। বয়সের কোনো ছাপ, বার্ধক্যের কোন গ্লানি তাকে স্পর্শ করেনি।
সাহিত্যের বিচিত্র বিষয়, চরিত্র, ও রচনাভঙ্গি তৈরি করার নেপথ্যে তার কর্মপ্রয়াস দেখার করার মতো। তার নিজের কথায়, এমন কোন পূর্ণিমা নেই যে বেরিয়ে পড়ি না।’ আপাতভাবে মনে হবে তিনি নাগরিক জীবনে অভ্যস্থ এবং গ্রামীণ জীবনে অভিজ্ঞতাহীন। বস্তুত, বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল বা জনপদ নেই যেখানে তার পদধূলি পড়েনি। প্রথমত তিনি লেখক, দ্বিতীয়ত তিনি পর্যটক। তার এই অভিজ্ঞতাকে তিনি শিল্পময় করে তুলেছেন তার গদ্য রচনায়। এখানে ব্যক্তিজীবনের কথাও তিনি বলেছেন অভিজ্ঞতার সারাৎসার হিসেবে। বিচিত্র মানুষ আর জনপদ নিয়ে তার অভিজ্ঞতার শব্দশিল্প হিসেবে আমারা পেয়েছি ‘বাংলার মুখ’ ও ‘হৃৎকলমের টানে’ নামে দুটি গ্রন্থ। আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘প্রণীত জীবন’-এ রয়েছে তার শিল্প জীবনের কিছু স্মারক যা তাকে কবি করে তুলেছিল । বাংলাদেশের সামগ্রিক আচার-আচরণ বোধ-বিশ্বাস-সংস্কার ও প্রবহমান বাঙালির সংস্কৃতির গভীর পাঠ পাওয়া যায় ‘কথা সামান্যই’ গ্রন্থে। ‘মার্জিনে মন্তব্য’; ‘গল্পের কলকবজা’ গ্রন্থে তিনি ছোটগল্পের শৈলি ও গঠন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা অসাধারণ। বাংলা বাক্যের গঠন নিয়ে তিনি অনেক নিরীক্ষা করেছেন। যতি চিহ্নের অজস্র ব্যবহারে, দীর্ঘ বাক্যের ব্যবহারে চিন্তার গভীরতা ও বৈচিত্র কীভাবে প্রকাশ করা সম্ভব সেটা সৈয়দ হকের গদ্য না পড়লে বোঝা যাবে না। সৈয়দ হক জীবনের সব অলিগলি সন্ধিতে ঢুকেছেন, একজন সৎ শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা তার সৃষ্ট চরিত্র আবার চোর, বেশ্যা, দালাল, যাদুকর, রাজাকার, বাজিকর ,লম্পট, খুনিও তার হাতে গড়া চরিত্র। ফলে একজন বাবর আলিকে দেখে বিস্মিত হবার কিছু নেই, তারা এ সমাজের অংশ, ফলত তারা শিল্পের উপাদান। বাজারসুন্দরি, বনবালা, পরান মাস্টার সবাই এক লাইনে ভিড় করে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে। বাংলাদেশের ছোটগল্পে যারা বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে কাজ করেছন, তারা জানেন উত্তীর্ণ মানের গল্প লিখেছেন সৈয়দ হক। তিনি প্রচল ধারার বাইরে লিখেছেন বরাবর। রোমান্টিক গল্পে তার আগ্রহ কম, যা দুএকটা লিখেছেন তা ব্যতিক্রম। ‘রুটি ও গোলাপ’ নামে তার অসাধারণ প্রেমের গল্প রয়েছে। দুর্ভিক্ষপীড়িত উত্তর অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে অসাধারণ কিছু গল্প (কোথায় ঘুমাবে করিমন বেওয়া, পূর্ণিমায় বেচাকেনা, কালাম মাঝির চড়নদার, প্রাচীণ বংশের নিঃস্ব সন্তান) লিখেছেন। আঞ্চলিক-ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের কারণে ও লোকজ সংলাপের জন্য তার গল্পগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। ‘জলেশ্বরীর গল্প’ গ্রন্থে তিনি কুড়িগ্রাম অঞ্চলের জীবন ও জনপদ এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করেছেন। এই পর্বের গল্পের বর্ণনাকৌশল সম্পূর্ণ নতুন। লক্ষণীয় যে, বহুবচনে প্রেক্ষণবিন্দু ব্যবহার করে বিরতিহীন বর্ণনার এই শৈলি পরবর্তীকালে অনেকেই ব্যবহার করেছেন সৈয়দ হকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। এখানেও উত্তরবঙ্গ ও মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম বিষয়। গল্পকথকের বর্ণনাভঙ্গি ব্যবহারে স্বতন্ত্র ধারা তিনি প্রবর্তন করেছেন। ‘আমার বন্ধু আবদুল খালেক’ সিরিজের গল্পে ঢাকা শহরের জীবন ও সংস্কৃতির গভীর ছাপ লক্ষ্য করা যাবে। ঢাকা শহর নিয়ে তার আলাদা একটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে, ‘আমার শহর’ নামে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, প্রগতি, সামগ্রিক জীবনানুভূতি, সমাজ-সংলগ্ন জীবনাচরণ, মানবপ্রতীতি এবং অবিরাম পরিবর্তনীয় সমাজ কাঠামোর তিনি অসাধারণ পর্যবেক্ষক এবং তার রূপায়ন করেছেন নিজস্ব শব্দচয়নে। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশ গঠনের দীপ্ত অঙ্গিকার ও পথনির্দেশনা পাওয়া যায় তার রচনায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋব্ধ তার সাহিত্য, যা আমাদেরকে চলার প্রেরণা দেবে সতত। শক্তিমান এই লেখককে এ জাতি মনে রাখবে তার কবিতা, নাটক, কথাসাহিত্য এবং অন্যান্য রচনার মধ্য দিয়ে।
লেখক: মোস্তফা তারিকুল আহসান