নিজস্ব প্রতিবেদক : গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মধুমতি নদীর ওপর নির্মাণাধীন দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতু সেপ্টেম্বর মাসে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ সেতুর পূর্বপাড়ে কাশিয়ানী উপজেলা ও পশ্চিম পাড়ে নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলা। সেতুটি চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন, শিল্প ও বাণিজ্যে প্রসার ঘটাবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সড়ক জনপথ অধিদপ্তরের নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান জানান, সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে; মূল সেতুর দুটি স্প্যান বসানোর কাজও সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দশ জেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন এ সেতুটি দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সড়ক জনপথ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্প্রতি সেতুর কাজ পরিদর্শন করেছেন। “তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরে সেতুতে যানবাহন চালানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে।”
সওজের এ প্রকৌশলী বলছেন, এ সেতু চালু হলে নড়াইল, যশোর, বেনাপোল স্থলবন্দর ও খুলনা থেকে ঢাকা যাতায়াতকারী পরিবহন মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে যাতায়াতের পরিবর্তে কালনা হয়ে যাতায়াত করতে পারবে। এতে বেনাপোল-ঢাকা ও যশোর-ঢাকার দূরত্ব ১১৩ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকার দূরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং নড়াইল-ঢাকার দূরত্ব ১৮১ কিলোমিটার কমবে। একইভাবে ঢাকার সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া, মোংলা বন্দর ও সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্য জেলার দূরত্বও কমে যাবে। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। জাপানের টেককেন করপোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড যৌথভাবে এ সেতুর ঠিকাদার। কালনা সেতুর কাজে দীর্ঘদিন ধরে উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন সওজের প্রকৌশলী সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন। তিনি জানান, দৃষ্টিনন্দন সেতুটি দেশের সবচেয়ে বড় নেলসন লোসআর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু। পদ্মা সেতুর পাইলক্যাপ পানির ওপর পর্যন্ত; কিন্তু এ সেতুর পাইলক্যাপ পানির নিচে মাটির ভেতরে।
“তাই নৌযান চলাচলে সমস্যা হবে না, পলি জমবে না এবং নদীর স্রোত কম বাধাগ্রস্ত হবে।” যোগ করেন তিনি। সরেজমিনে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধুমতি নদীর পশ্চিম পাড়ে কার্পেটিং এর কাজ চলছে; তবে পূর্ব পাড়ের সংযোগ সড়কের কার্পেটিং শেষ হয়েছে। সংযোগ সড়কের ১৩টি কালভার্টের মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে বরোটির। অন্যটির ফিনিশিং কাজ চলছে। এছাড়া আটটি আন্ডারপাসের কাজ শেষ হয়েছে; পাশাপাশি কাশিয়ানী অংশে সেতুর ডিজিটাল টোলপ্লাজা নির্মাণের কাজও প্রায় শেষের পথে। সেতুর মাঝখানে বসানো হয়েছে ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্টিলের স্প্যান। ধনুকের মতো বাঁকা এ স্প্যানটি তৈরি হয়েছে ভিয়েতনামে; তৈরি করেছে জাপানের নিপ্পন কোম্পানি। এটি বসানোর কাজই ছিল সেতুর সবচেয়ে বড় কাজ। স্প্যানটির উভয় পাশের অন্য স্প্যানগুলো পিসিগার্ডারের (কনক্রিট)। এই সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, ছয় লেনের এ সেতু হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। চারটি মূল লেনে দ্রুতগতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করবে। সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ হবে ২৭ দশমিক ১০ মিটার। বর্ষায় পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ৭ দশমিক ৬২ মিটার। তারা আরও জানান, সেতুর উভয় পাশে সংযোগ সড়ক হবে ৪ দশমিক ২৭৩ কিলোমিটার, যার প্রস্থ ৩০ দশমিক ৫০ মিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৯৫৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ২৪ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই সালের ৫ সেপ্টেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তখন থেকে ৩৬ মাস অর্থাৎ ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ছিল সেতু নির্মাণের মেয়াদকাল। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান বলেন, “প্রথমে সেতুর নকশা ছিল চার লেনের, পরে তা করা হয় ছয় লেনের। সংযোগ সড়কের জমি অধিগ্রহণে দেরি হয়েছে। এছাড়া করোনার মধ্যে প্রায় ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। এসব কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি।” কাশিয়ানী উপজেলা সদরের বাসিন্দা গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দিন আহমেদ বলেন, “কালনা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১০টি জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব হবে। এটি এই এলাকার মানুষের স্বপ্নের সেতু। ইতোমধ্যে সেতুকে ঘিরে কাশিয়ানীতে মিল, কলকারখানা ও হোটেল রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেতে শুরু করেছে।” তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলেও যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইলসহ ১০ জেলার মানুষ পদ্মা পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না। কালনা সেতু চালু হলে ওই জেলাগুলো এ সুফল পাবে। তখন ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রসারও করবে।
সেপ্টেম্বরে চালু হচ্ছে ৬ লেনের কালনা সেতু
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ