ঢাকা ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

সেন্ট্রাল হাসপাতালে সন্তান হারানো আঁখিও চলে গেলেন

  • আপডেট সময় : ০৯:২০:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ জুন ২০২৩
  • ৮২ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতক শিশুকে হারানো মা মাহবুবা রহমান আঁখিকেও বাঁচানো গেল না। গতকাল রোববার বেলা আড়াইটার কিছু আগে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন। তিনি বলেন, “একটু আগে আঁখি মারা গেছে। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।”
অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে নিজের ইচ্ছের কথা স্বামীকে জানিয়েছিলেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মাহবুবা রহমান আঁখি। সেজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে নিয়মিত ওই চিকিৎসকের কাছেই তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রসবব্যথা উঠলে গত ৯ জুন মধ্যরাতে কুমিল্লা থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখিকে নিয়ে আসে তার পরিবার। ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, সেদিন তাদের বলা হয়েছিল ডা. সংযুক্তা হাসপাতালে আছেন। কিন্তু সেদিন ওই চিকিৎসকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ওইদিনই মারা যায়। সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। ল্যাবএইডে ভর্তির পরও আঁখির শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না বলে গত বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন।
ওই ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে মঙ্গলবার ধানম-ি থানায় মামলা করেন ইয়াকুব। বৃহস্পতিবার ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহা গ্রেপ্তার করে ধানম-ি থানা পুলিশ। ওইদিনই তাদের কারাগারে পাঠায় আদালত। এছাড়া ওই দুই চিকিৎসক-কর্মচারীসহ ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আইসিইউ ও জরুরী সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম শুক্রবার বন্ধ করে দিয়েছে। ওই হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। আঁখির চাচাতো ভাই শামীম বলেন, রোববারই আঁখির মরদেহ কুমিল্লায় নিয়ে যাবেন তারা।
“লাকসামে আমাদের বাড়িতে দাফন করা হবে। আঁখিকে আট মাসের রেখে আমার চাচা মারা গিয়েছিলেন। চাচী আর বিয়ে করেননি, সে আমাদের সবার খুব আদরের ছিল।”
সেন্ট্রাল হসপিটালে আঁখি ও তার নবজাতকের সঙ্গে যা ঘটেছিল: গত শুক্রবার (৯ জুন) রাতের ঘটনা। মাহাবুবা রহমান আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন বারবার সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার স্ত্রী কেমন আছে? আর ডা. সংযুক্তা সাহা কোথায়? কিন্তু ইয়াকুবের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। তারা বার বার ইয়াকুবকে বলছিলেন, আপনি ‘গেটের বাইরে অপেক্ষা করুন’। একপর্যায়ে একজন নার্স এসে ইয়াকুবকে জানান, আঁখির অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেজন্য তাকে কাগজে সই দিতে হবে। সই না দিলে আঁখি ও তার নবজাতকের চিকিৎসা করবে না সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাগজে সই দিয়েও স্ত্রী ও সন্তানের কোনো তথ্যই পাচ্ছিলেন না ইয়াকুব।
এ বিষয়ে শুরু থেকেই ইয়াকুবের সঙ্গে লুকোচুরি করছিলেন চিকিৎসকরা। একপর্যায়ে ইয়াকুবকে জানানো হয়, তার স্ত্রীর চিকিৎসা করা আর সেন্ট্রাল হসপিটালে সম্ভব নয়। তাকে অন্য হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। পরে স্ত্রীর জীবন বাঁচাতে শনিবার (১০ জুন) ধানমন্ডির ল্যাবএইড হসপিটালে আঁখিকে ভর্তি করান ইয়াকুব। এরপর সেন্ট্রাল হসপিটালে এসে জানতে পারেন তার নবজাতক হসপিটালের এনআইসিইউতে মারা গেছে।
এ ঘটনায় বুধবার (১৪ জুন) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি থানায় সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন ইয়াকুব আলী। মামলার আসামিরা হলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালের ডা. মুনা সাহা (২৮), ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা (৩৮), অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমির, ডা. এহসান, ডা. মিলি ও সেন্ট্রাল হসপিটালের ম্যানেজার পারভেজসহ আরও অজ্ঞাত ৫-৬ জন। এর মধ্যে বুধবার এজাহারনামীয় দুই আসামি ডা. মুনা সাহা ও ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানাকে গ্রেপ্তার করেছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার আসামিদের বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) আদালতে তুললে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ইয়াকুব আলীর স্ত্রী আঁখি ও সন্তানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেদিন রাতের ঘটনার বিষয়ে বৃহস্পতিবার আদালতকে এসব তথ্য জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে বলেন, অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে ওই রাতে আঁখির সিজারিয়ান অপারেশন কোনো চিকিৎসক করেছেন তা ইয়াকুব আলীকে জানানো হয়নি। এর মধ্যে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে আঁখির শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ইয়াকুব আলী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সেন্ট্রাল হসপিটালের ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ পারভেজকে মৌখিকভাবে জানান। এরপর ইয়াকুব তার স্ত্রী ও নবজাতকের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো তথ্য না দিয়ে আঁখিকে অন্য হসপিটালে চিকিৎসা করানোর জন্য বলে। ইয়াকুব সেন্ট্রাল হসপিটালের কোনো সহযোগিতা না পেয়ে পরে তার স্ত্রীকে ল্যাবএইড হসপিটালে ভর্তি করান। পরদিন অর্থাৎ ১০ জুন সেন্ট্রাল হসপিটালের কর্তৃপক্ষ ইয়াকুবকে জানায়, তার সন্তান বিকেল ৪টার দিকে এনআইসিইউতে মারা গেছে। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল বলেন, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে যেকোনো একজন চিকিৎসক সেদিন রাতে আঁখির সিজার করেছিলেন। এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালের অফিশিয়াল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে জানা যাবে আসলে অপারেশনটি কোন চিকিৎসক করেছেন। তবে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য আমরা আমাদের মতো তদন্ত করছি। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিকভাবে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় ডা. সংযুক্তা সাহার কোনো গাফিলতি বা সংশ্লিষ্টতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তদন্ত শেষে বলা যাবে। তবে আঁখি হসপিটালে তার অধীনেই ভর্তি হয়েছিলেন।
আঁখির মৃত্যুর কারণ ‘পরিষ্কার করেনি’ ল্যাবএইড: সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসময় আঁখির মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে মৃত্যুর সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়েই সংবাদ সম্মেলন শেষ করা হয়।
গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে ৪টায় আঁখির মৃত্যু নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা দীপ। আঁখির চিকিৎসায় ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলেও মৃত্যু পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কোনো চিকিৎসক আসেননি, বরং ব্রিফিংয়ে পাঠানো হয় হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তাকে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তার কাছে আঁখির সর্বশেষ চিকিৎসা ও মৃত্যুর কারণ জানতে চান। এসময় জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপ বলেন, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণে আঁখির মৃত্যু হয়েছে। এরকমটা স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে। আঁখির শরীরের কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে রক্তক্ষরণ হয়েছিল সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারেননি। ভর্তিকালীন রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে দীপ বলেন, রোগীকে অচেতন অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স যোগে ল্যাবএইড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আনা হয়। তখন প্রসবজনিত জটিলতায় শিশুর মৃত্যু হয় এবং মায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে আনা হয়। তিনি বলেন, ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছিল। রোগীর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান অব্যাহত ছিল।
ল্যাবএইডের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরও বলেন, রোগীর ইউরিন আউটপুট বন্ধ থাকায় ডায়ালাইসিস প্রদান করা হচ্ছিল। সকল প্রকার প্রচেষ্টার পরও রোগীর কোনো প্রকার উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। আজ (গতকাল রোববার) দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রধান উপদেষ্টা হতাশ-ক্ষুব্ধ, ‘পদত্যাগ’ নিয়ে আলোচনা

সেন্ট্রাল হাসপাতালে সন্তান হারানো আঁখিও চলে গেলেন

আপডেট সময় : ০৯:২০:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ জুন ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে নবজাতক শিশুকে হারানো মা মাহবুবা রহমান আঁখিকেও বাঁচানো গেল না। গতকাল রোববার বেলা আড়াইটার কিছু আগে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন। তিনি বলেন, “একটু আগে আঁখি মারা গেছে। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।”
অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে নিজের ইচ্ছের কথা স্বামীকে জানিয়েছিলেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মাহবুবা রহমান আঁখি। সেজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে নিয়মিত ওই চিকিৎসকের কাছেই তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রসবব্যথা উঠলে গত ৯ জুন মধ্যরাতে কুমিল্লা থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখিকে নিয়ে আসে তার পরিবার। ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, সেদিন তাদের বলা হয়েছিল ডা. সংযুক্তা হাসপাতালে আছেন। কিন্তু সেদিন ওই চিকিৎসকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ওইদিনই মারা যায়। সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। ল্যাবএইডে ভর্তির পরও আঁখির শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না বলে গত বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন।
ওই ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে মঙ্গলবার ধানম-ি থানায় মামলা করেন ইয়াকুব। বৃহস্পতিবার ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহা গ্রেপ্তার করে ধানম-ি থানা পুলিশ। ওইদিনই তাদের কারাগারে পাঠায় আদালত। এছাড়া ওই দুই চিকিৎসক-কর্মচারীসহ ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আইসিইউ ও জরুরী সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম শুক্রবার বন্ধ করে দিয়েছে। ওই হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। আঁখির চাচাতো ভাই শামীম বলেন, রোববারই আঁখির মরদেহ কুমিল্লায় নিয়ে যাবেন তারা।
“লাকসামে আমাদের বাড়িতে দাফন করা হবে। আঁখিকে আট মাসের রেখে আমার চাচা মারা গিয়েছিলেন। চাচী আর বিয়ে করেননি, সে আমাদের সবার খুব আদরের ছিল।”
সেন্ট্রাল হসপিটালে আঁখি ও তার নবজাতকের সঙ্গে যা ঘটেছিল: গত শুক্রবার (৯ জুন) রাতের ঘটনা। মাহাবুবা রহমান আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন বারবার সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমার স্ত্রী কেমন আছে? আর ডা. সংযুক্তা সাহা কোথায়? কিন্তু ইয়াকুবের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। তারা বার বার ইয়াকুবকে বলছিলেন, আপনি ‘গেটের বাইরে অপেক্ষা করুন’। একপর্যায়ে একজন নার্স এসে ইয়াকুবকে জানান, আঁখির অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেজন্য তাকে কাগজে সই দিতে হবে। সই না দিলে আঁখি ও তার নবজাতকের চিকিৎসা করবে না সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাগজে সই দিয়েও স্ত্রী ও সন্তানের কোনো তথ্যই পাচ্ছিলেন না ইয়াকুব।
এ বিষয়ে শুরু থেকেই ইয়াকুবের সঙ্গে লুকোচুরি করছিলেন চিকিৎসকরা। একপর্যায়ে ইয়াকুবকে জানানো হয়, তার স্ত্রীর চিকিৎসা করা আর সেন্ট্রাল হসপিটালে সম্ভব নয়। তাকে অন্য হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। পরে স্ত্রীর জীবন বাঁচাতে শনিবার (১০ জুন) ধানমন্ডির ল্যাবএইড হসপিটালে আঁখিকে ভর্তি করান ইয়াকুব। এরপর সেন্ট্রাল হসপিটালে এসে জানতে পারেন তার নবজাতক হসপিটালের এনআইসিইউতে মারা গেছে।
এ ঘটনায় বুধবার (১৪ জুন) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি থানায় সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন ইয়াকুব আলী। মামলার আসামিরা হলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালের ডা. মুনা সাহা (২৮), ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা (৩৮), অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার সহকারী মো. জমির, ডা. এহসান, ডা. মিলি ও সেন্ট্রাল হসপিটালের ম্যানেজার পারভেজসহ আরও অজ্ঞাত ৫-৬ জন। এর মধ্যে বুধবার এজাহারনামীয় দুই আসামি ডা. মুনা সাহা ও ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানাকে গ্রেপ্তার করেছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার আসামিদের বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) আদালতে তুললে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ইয়াকুব আলীর স্ত্রী আঁখি ও সন্তানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেদিন রাতের ঘটনার বিষয়ে বৃহস্পতিবার আদালতকে এসব তথ্য জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে বলেন, অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতিতে ওই রাতে আঁখির সিজারিয়ান অপারেশন কোনো চিকিৎসক করেছেন তা ইয়াকুব আলীকে জানানো হয়নি। এর মধ্যে ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে আঁখির শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ইয়াকুব আলী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সেন্ট্রাল হসপিটালের ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ পারভেজকে মৌখিকভাবে জানান। এরপর ইয়াকুব তার স্ত্রী ও নবজাতকের শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো তথ্য না দিয়ে আঁখিকে অন্য হসপিটালে চিকিৎসা করানোর জন্য বলে। ইয়াকুব সেন্ট্রাল হসপিটালের কোনো সহযোগিতা না পেয়ে পরে তার স্ত্রীকে ল্যাবএইড হসপিটালে ভর্তি করান। পরদিন অর্থাৎ ১০ জুন সেন্ট্রাল হসপিটালের কর্তৃপক্ষ ইয়াকুবকে জানায়, তার সন্তান বিকেল ৪টার দিকে এনআইসিইউতে মারা গেছে। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক রাসেল বলেন, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে যেকোনো একজন চিকিৎসক সেদিন রাতে আঁখির সিজার করেছিলেন। এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালের অফিশিয়াল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে জানা যাবে আসলে অপারেশনটি কোন চিকিৎসক করেছেন। তবে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য আমরা আমাদের মতো তদন্ত করছি। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিকভাবে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় ডা. সংযুক্তা সাহার কোনো গাফিলতি বা সংশ্লিষ্টতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তদন্ত শেষে বলা যাবে। তবে আঁখি হসপিটালে তার অধীনেই ভর্তি হয়েছিলেন।
আঁখির মৃত্যুর কারণ ‘পরিষ্কার করেনি’ ল্যাবএইড: সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসময় আঁখির মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে মৃত্যুর সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়েই সংবাদ সম্মেলন শেষ করা হয়।
গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে ৪টায় আঁখির মৃত্যু নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা দীপ। আঁখির চিকিৎসায় ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হলেও মৃত্যু পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কোনো চিকিৎসক আসেননি, বরং ব্রিফিংয়ে পাঠানো হয় হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তাকে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তার কাছে আঁখির সর্বশেষ চিকিৎসা ও মৃত্যুর কারণ জানতে চান। এসময় জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপ বলেন, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণে আঁখির মৃত্যু হয়েছে। এরকমটা স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে। আঁখির শরীরের কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে রক্তক্ষরণ হয়েছিল সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারেননি। ভর্তিকালীন রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে দীপ বলেন, রোগীকে অচেতন অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স যোগে ল্যাবএইড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আনা হয়। তখন প্রসবজনিত জটিলতায় শিশুর মৃত্যু হয় এবং মায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে আনা হয়। তিনি বলেন, ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছিল। রোগীর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান অব্যাহত ছিল।
ল্যাবএইডের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরও বলেন, রোগীর ইউরিন আউটপুট বন্ধ থাকায় ডায়ালাইসিস প্রদান করা হচ্ছিল। সকল প্রকার প্রচেষ্টার পরও রোগীর কোনো প্রকার উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। আজ (গতকাল রোববার) দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।