নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগে শিক্ষকতা অবস্থায় এক ছাত্রীকে প্রতিনিয়ত অনৈতিক প্রস্তাব দিতেন সহকারী অধ্যাপক আবু সালেহ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন চৌধুরী। ফেসবুক মেসেঞ্জার ছাড়াও সরাসরি এবং মোবাইলে তিনি এই প্রস্তাব দেন। তাছাড়া প্রাইভেট পড়ার জন্য ওই শিক্ষার্থীকে বাসায় যেতে বলেন। বাসায় যেতে রাজি না হওয়ায় ওই ছাত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হন সালাউদ্দিন। তার প্রস্তাবে রাজি না হলে এক শিক্ষাবর্ষে অনেক বছর আটকে রাখা হবে বলেও হুমকি দেন।
দীর্ঘদিন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন অনৈতিক প্রস্তাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ওই ছাত্রী। শেষমেশ গেল ২৩ ডিসেম্বর প্রথমে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে রমনা থানায় মামলা করেন ২৮ ডিসেম্বর। পরদিন ভোরে রাজধানীর মগবাজার থেকে সালাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র্যাব। একইদিন প্রতিষ্ঠান থেকেও তাকে বরখাস্ত করা হয়।
প্রায় এক মাস তদন্তের পর আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে রমনা থানা পুলিশ। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন উপপরিদর্শক (এসআই) সালমান রহমান। থানা পুলিশ বলছে, তদন্তে ওই ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুই পাতার প্রতিবেদনে সব তথ্য-উপাত্তসহ বিস্তারিত তুলে ধরে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সালাউদ্দিন জামিনে রয়েছেন। গত ১৩ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন।
গতকাল সোমবার দুপুরে এসআই সালমান রহমান বলেন, এক মাস তদন্ত শেষে গত ৩১ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত তা গ্রহণ করেন। তদন্তে ডা. সালাউদ্দিন যে ওই ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গেই অভিযুক্ত সালাউদ্দিন এমন আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ ছিল। তদন্তে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে কি-না জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর মামলার বিষয় নিয়েই আমরা তদন্ত করেছি। এর বাইরে অন্য কেউ আমাদের কাছে এমন অভিযোগ করেনি। তাই আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করেছি।’
ভুক্তভোগী ছাত্রী যা বলেছিলেন: মামলার পর ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী বলেছিলেন, আমার মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মেসেঞ্জারে আমাকে বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় আমাকে এক শিক্ষাবর্ষে অনেক বছর আটকে রাখবেন বলে হুমকি দেন। এরপর কলেজে বিভিন্নভাবে ডেকে আমাকে তার দেওয়া মেসেজ ফোন থেকে মুছে দিতে আর তার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করতে বলেন। ওই ছাত্রী বলেন, এর আগে উনি আমাকে কলেজে প্রাইভেট পড়াবেন বলে দুই দফায় ২০ হাজার টাকা নেন, কিন্তু পড়াননি। পড়ার জন্য বারবার আমাকে তার বাসায় আসতে বলেন, যাতে আমি কখনোই রাজি হইনি। এতে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হন। আমি আমার ও আমার পরিবারের মানসম্মানের ভয়ে এতদিন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। কিন্তু দিন দিন অবস্থা এতই খারাপ হয় যে, আমার পড়ালেখা চরম হুমকির মুখে পড়ে। এখন তিনি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আমি এরই মধ্যে উত্তরা পশ্চিম থানায় এই মর্মে একটা জিডি করেছি। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে রমনা থানায় মামলা করি।
সবশেষ গত বছরের ৬ নভেম্বর দুপুরে কলেজে ওই ছাত্রীকে একা পেয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন সালাউদ্দিন। এতে তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। তাছাড়া ফেসবুকে অনৈতিক ও অশালীন মেসেজ পাঠাতে থাকেন। একটি মেসেজে ওই শিক্ষক লিখেছেন, ‘ঢাকায় এসে সময় দিস’। আরেকটি মেসেজে তিনি লিখেন, ‘প্রেমে পড়া বারণ, তাই প্রেমে পড়লাম না’। ‘ফিজিক্যাল ডিমান্ড কীভাবে কী করিস?’ এমন অনেকে মেসেজ ওই ছাত্রীকে পাঠিয়েছেন তিনি।
সাময়িক বরখাস্ত ও তদন্ত : ২৮ ডিসেম্বর বিকালে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. দৌলতুজ্জামান সহকারী অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরীকে বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন ও হুমকি প্রদানের অভিযোগ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নসংক্রান্ত গঠিত কমিটিতে তদন্তাধীন রয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে কুপ্রস্তাব দিতেন সালাউদ্দিন : পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দিয়ে হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের অনেক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক আবু সালেহ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন চৌধুরী। তবে ভয়ে কেউ কখনো মুখ খুলেনি। সবশেষ প্রতিষ্ঠানটির এক ছাত্রীর মামলায় ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপরই বেরিয়ে আসে তার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কলেজের একাধিক সূত্র তখন ঢাকা টাইমসকে জানায়, ওই শিক্ষক অনেক ছাত্রীর সঙ্গে যৌন নির্যাতনমূলক ও অশালীন ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলতেন। আবার অনেককে পরীক্ষায় ফেল করানোর কথা বলে কুপ্রস্তাব দিতেন। শিক্ষক হিসেবে তার এমন আচরণ কেউ পছন্দ করত না। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলত না। তার এমন আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রীদের টার্গেট করেই তিনি এসব প্রস্তাব দিতেন। আগেও একাধিক বিদেশি ছাত্রীকে তিনি এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিষয়টি শিক্ষার্থীরা জানতেন, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতেন না। কারণ কেউ কথা বলতে চাইলে তিনি পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দিতেন।
সেই শিক্ষক সালাউদ্দিনের তদন্তে যা পেল পুলিশ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ