নিজস্ব প্রতিবেদক : যার লেখা গান কণ্ঠে ধরে প্রভাত ফেরির মিছিল ছোটে শহীদ মিনারে, সেই স্থানেই শেষ বিদায় জানানো হল আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।
গতকাল শনিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধায় সিক্ত হন প্রয়াত এই সাংবাদিক- সাহিত্যিক। এরপর যুগল জীবনের ৫৬টি বছর একসঙ্গে কাটানো স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর পাশেই অন্তিম শয্যা পেলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। গতকাল শনিবার বিকালে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় এই ভাষাসৈনিক ও মুক্তিসংগ্রামীকে।
একুশের গানের রচয়িতা গাফফার চৌধুরী ৮৮ বছর বয়সে কয়েক মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৯ মে যুক্তরাজ্যে মারা যান। গতকাল শনিবার সকালে লন্ডন থেকে বিমানে মরদেহ ঢাকায় পৌঁছানোর পর নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দুপুরে শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মন এবং সর্বসাধারণের শ্রদ্ধায় সিক্ত হন প্রয়াত এই সাংবাদিক-সাহিত্যিক। পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর মরদেহ নেওয়া হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর লন্ডনে মৃত্যুর পর মিরপুরের এই কবরস্থানেই শেষ শয্যা হয় স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর। সেখানে দীর্ঘদিনের সঙ্গীর পাশেই শায়িত হলেন গাফফার চৌধুরীও। তার কবরের একপাশে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’ এর স্রষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা এম আর আখতার মুকুল। আরেক পাশে মুক্তিযোদ্ধা ও গীতিকার ইমতিয়াজ বুলবুলের কবর।
আশেপাশে শায়িত আছেন মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী, গোলাম মোস্তফা, কমরেড আলী আকসাদ, সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক কে জি মুস্তাফা, শিল্পী কলিম শরাফী, সংগীতগুরু সোহরাব হোসেন।
দুপুর ১টায় গাফফার চৌধুরীর কফিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছনোর পর প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এসময় তার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গাফফার চৌধুরী রচিত সেই অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গেয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বেলা ৩টায় শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব শেষে শহীদ মিনার থেকে কফিন নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে, সেখানে জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সেখানে প্রবীণ-নবীন সাংবাদিকরা ফুল দিয়ে অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এর আগে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে জানাজাও হয়। পরে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে সন্ধ্যার আগেই দাফন করা হয়।
এর আগে বিমানে মরদেহ ঢাকায় পৌঁছনোর পর সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় শহীদ মিনারে। দুপুর ১টায় গাফফার চৌধুরীর কফিন পৌঁছনোর পর প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এসময় তার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গাফফার চৌধুরী রচিত সেই অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গেয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের শুরুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবীর আহাম্মদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক ইতিহাস তিনি জাতির কাছে তুলে ধরেছিলেন। অনেক দিক-নির্দেশনামূলক লেখাও আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি। তার এই শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।
“যতদিন অমর একুশের চেতনা বাঙালির মনে জাগ্রত থাকবে, ততদিন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির মধ্য দিয়ে জাতি চিরকাল আবদুল গাফফার চৌধুরীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।”
আবদুল গাফফার চৌধুরীর কফিনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের শীর্ষ নেতারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের সংস্কৃতির সমকালের সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষটির পতন ঘটল। তিনি মরে গেলেও একুশের আমর গানে তিনি বেঁচে থাকবেন।
“আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দুঃসময়ে, সংকটে পরামর্শ দিতেন। আজকে এই চলমান বিশ্বের সংকটে জাতিকে পরামর্শ দেওয়ার, আমরা যারা ক্ষমতার মঞ্চে আছি, আমাদেরকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার শূন্যতা অনুভব করব।”
বেলা ৩ টা পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আবদুল গাফফার চৌধুরীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ছেলে অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী বলেন, “আমার আব্বা বাংলাদেশকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনিও জানতেন বাংলাদেশের মানুষ তাকে অনেক ভালোবাসেন। আব্বা সব সময় বলতেন এই দেশেই যাতে তাকে মাটি দেওয়া হয়। সেজন্য তাকে এখানে নিয়ে আসছি। “আজকে এখানে তাকে শ্রদ্ধা অনেক মানুষ এসেছেন। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার বাবার প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, সেজন্য আমি উনার কাছে চির কৃতজ্ঞ।”
শহীদ মিনার থেকে কফিন নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে, সেখানে জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সকাল ১১টার দিকে মরদেহ দেশে পৌঁছলে বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে সরকারের পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করেন মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজম্মেল হক। উড়োজাহাজ থেকে মরদেহ নামানোর পর জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়। পরে সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মন্ত্রীরা। বিমানবন্দরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়মন্ত্রী মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, “আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন ইতিহাসের জলন্ত সাক্ষী। ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট তিনি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন আজীবন। বাংলার মানুষ তার কাছ থেকে জানার জন্য অপেক্ষা করতেন।”
বাংলাদেশের বিমানের একই ফ্লাইটে গাফফার চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরাও দেশে এসেছেন। একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলার নির্বাহী সম্পাদক গাফফার চৌধুরী দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত ছিলেন। পেশায় সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী কলামনিস্ট হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। গল্প-কবিতা-উপন্যাসেও তিনি রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।
সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা : প্রেস ক্লাব থেকে বিকাল সাড়ে ৪টায় মরহুমের কফিন মীরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আব্দুল গাফফার চৌধুরী জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন।
প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন, সিনিয়র সহসভাপতি হাসান হাফিজ, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, যুগ্ম সম্পাদক মাইনুল আলম ও আশরাফ আলী, কোষাধ্যক্ষ শাহেদ চৌধুরীসহ ক্লাব কর্মকর্তারা তার মরদেহের সামনে পুস্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, বিএফইউজে, ডিইউজে, এডিটর গিল্ড, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কমান্ড, ডিআরইউ, ডিক্যাব, ক্র্যাব, ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিল, পিআইবিসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনসহ অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের পক্ষে প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও উপ প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার প্রয়াত গাফফার চৌধুরীর কফিনে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। এর আগে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গনে প্রয়াতের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর কবির নানক ও বাহাউদ্দিন নাসিম, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব ইহসানুল করিম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, সাইফুল আলম, মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, মোজাম্মেল বাবু, মঞ্জরুল আহসান বুলবুল, সোহরাব হাসান, নঈম নিজাম, রাশেদ চৌধুরী, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, আবদুল জলিল ভুঁইয়া, নুরুল আমিন রোকন, আবুল খায়ের, কাজী আবদুল হান্নান, আবু জাফর সূর্য, সোহেল হায়দার চৌধুরী, আক্তার হোসেন, নুজরুল ইসলাম মিঠু, নুরুল ইসলাম হাসিব, আইয়ুব ভুঁইয়া, শাহিন-উল ইসলাম চৌধুরী, আতাউর রহমানসহ সাংবাদিক-পেশাজীবীরা অংশ নেন।
সেই শহীদ মিনারে গাফফার চৌধুরীকে শেষ বিদায়
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ