প্রযুক্তি ডেস্ক: ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল এক বিরল পূর্ণ সূর্যগ্রহণ উত্তর আমেরিকার আকাশজুড়ে দেখা গিয়েছিল, যা মেক্সিকোর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে শুরু হয়ে টেক্সাস ও যুক্তরাষ্ট্রের আরো ১৪টি অঙ্গরাজ্য পেরিয়ে কানাডা পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ জুড়ে দেখা দেখা গেছে। সূর্যগ্রহণের সময়ে, চাঁদ যে সূর্যের মুখ পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছিল, সেই অন্ধকার স্থানভেদে প্রায় চার মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
অসংখ্য মানুষ যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে এই মহাজাগতিক দৃশ্য উপভোগ করছিলেন তখন সূর্যগ্রহণের ফলে পাখিদের ওপর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। পাখিদের দৈনন্দিন ও মৌসুমী ছন্দ সূর্যের আলোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিজ্ঞানীরা যেসব পাখি প্রজাতি নিয়ে কাজ করেছিলেন সেগুলোর বেশিরভাগ পাখির গানের স্বর বদলে গিয়েছিল। তবে সব প্রজাতিতে নয়, বিশেষ করে যেসব পাখিরা ভোরে গান ও ডাক দেয় সেসব পাখিরাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে রয়টার্স।
পূর্ণগ্রহণের পর সূর্যের আলো যখন আবার ফিরে আসতে শুরু করল তখন কিছু পাখি এদের স্বাভাবিক ‘ভোরের গান’ গাইলো, যেন নতুন দিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে এরা। আবার কিছু প্রজাতি চুপ করে রইল এবং কিছু পাখির আচরণ স্বাভাবিক দিনের মতোই রয়ে গেল।
‘ইনডিয়ানা ইউনিভার্সিটি’র বিবর্তন, পরিসর ও আচরণ বিভাগের ডক্টরাল শিক্ষার্থী ও এ গবেষণার প্রধান লেখক লিজ আগুইলার বলেছেন,আলো হচ্ছে পাখিদের আচরণ গঠনের অন্যতম শক্তিশালী শক্তি। ফলে কেবল চার মিনিটের ‘রাত’ হওয়ার বিষয়টি অনেক প্রজাতির পাখিদের আবার সকালে ঘুম ভেঙে উঠার মতো আচরণ করতে বাধ্য করেছিল। পাখিদের এ বিষয়টি আমাদের জানান দেয় যে, কিছু পাখি আলোর পরিবর্তনের প্রতি কতটা সংবেদনশীল।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ। ‘ওহাইয়ো ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি’র জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও এ গবেষণার সহলেখক ডাস্টিন রেইচার্ড বলেছেন, আগের বিভিন্ন গবেষণা, যেগুলো বেশির ভাগই ল্যাবে করা হয়েছে, তা থেকে আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি, আলোতে পরিবর্তন প্রাণীকূলের দৈনন্দিন ছন্দ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। দিনের আলো থেকে রাতের অন্ধকারে, আর রাত থেকে দিনের আলোতে বদল হলে শরীরের হরমোনের মাত্রা ও জিনের কার্যকারিতায় পরিবর্তন আসে, যা আচরণেও পার্থক্য তৈরি করে।
সূর্যগ্রহণের সময় পাখিদের আচরণ নিয়ে কিছু গল্প ও কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির ওপর গবেষণা আগে থেকে থাকলেও এ গবেষণাটিই পাখিদের গানের বিষয়টিকে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছে। গবেষণার ফলাফল এসেছে দুটি আলাদা তথ্যভাণ্ডার থেকে, যা এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে গবেষকদের। গবেষণার জন্য ইনডিয়ানার ব্লুমিংটনের আশপাশে রাখা চৌদ্দটি রেকর্ডিং ডিভাইস এক লাখেরও বেশি পাখির গান ও ডাক ধারণ করেছিল। এসব ডেটা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা, যাতে এর মাধ্যমে কোন প্রজাতির পাখি গান ও ডাক দিয়েছে তা শনাক্ত করা যায়।
এ ছাড়া, ‘সোলারবার্ড’ নামের এক অ্যাপের মাধ্যমে সূর্যগ্রহণের সময় পাখিদের আচরণ সম্পর্কে ১১ হাজারেরও বেশি তথ্য পাঠিয়েছিলেন উত্তর আমেরিকার প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন মানুষ। অ্যাপটি গবেষকরা তৈরি করেছিলেন, যাতে যে কোনো সাধারণ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করতে পারেন।
ব্লুমিংটনের আশপাশে মোট ৫২ প্রজাতির পাখি শনাক্ত করেছেন গবেষকরা, যেখানে সূর্যগ্রহণের সময় সাধারণ এপ্রিল মাসের দুপুরের তুলনায় বেশি পরিবর্তন দেখিয়েছিল ২৯ প্রজাতির পাখির গান ও ডাকের আচরণ। অধ্যাপক আগুইলার বলেছেন, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ভোরকে আলাদা আলাদাভাবে অভিবাদন জানায়। কিছু পাখির ভোরের গান অনেক জোরালো ও জটিল হয়, আবার কিছু পাখি অনেক বেশি নীরব থাকে। যেসব প্রজাতির ভোরের গান সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ও প্রাণবন্ত সেসব পাখিরাই সূর্যগ্রহণের সময় সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিভিন্ন রকম আচরণ দেখিয়েছে। আমেরিকান রবিন পাখি সাধারণত ভোরের খুব আগেই অন্ধকারে গান গায়, এরা সূর্যগ্রহণের সময় ও পরবর্তীতে গানের মাত্রা ছয় গুণ বেশি বাড়িয়েছিল, যা স্বাভাবিক এক সন্ধ্যার তুলনায় অনেক বেশি।
অধ্যাপক আগুইলার আরো বলেছেন আসলে সব প্রজাতির পাখি একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে– বিষয়টি স্বাভাবিক নয়। পাখিরা আলোর পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীলতার দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। সব প্রজাতি একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তা অনেক বেশি অদ্ভুত বিষয় হত। প্রতিটি প্রজাতির নিজস্ব কার্যকলাপের ধরন, শক্তির চাহিদা ও সংবেদনশীলতা থাকে। ফলে এরা পরিবেশগত পরিবর্তন ভিন্নভাবে বোঝে।
সানা/কেএমএএ/আপ্র/১৮/১০/২০২৫