ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান : সুশাসন একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এটি ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভূমিকা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, কারণ অর্থনৈতিক বিকাশে এই সম্প্রদায়ের অবদান অপরিসীম। তবে এই ভূমিকা আরও কার্যকর করতে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মানদণ্ডে উন্নতি আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বাণিজ্য সংস্থাগুলোর পরিমণ্ডল একটি জটিল এবং বহুমুখী কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে; যেখানে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একত্র হয়েছেন। মূলত এই সংস্থাগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে; যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশের বাণিজ্য সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে আছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই); যা বিভিন্ন শিল্প খাতের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে। তবে বেশকিছু সেক্টরভিত্তিক বাণিজ্য সংস্থা যেমন- বিজিএমইএ (বিজিএমইএ), বিকেএমইএ (বিকেএমইএ) এবং বেসিস ইত্যাদির নির্দিষ্ট খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাতে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ-এর প্রভাবশালী ভূমিকা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই খাত দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি নিয়ে থাকে। বেসিস প্রযুক্তি ও আইটি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরিতে এবং সেই খাতের বিকাশে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে বেশ কয়েকটি অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়েছে। বড় এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব অনেক বেশি। ফলে ছোট ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে কম। বাণিজ্য সংস্থাগুলোর মাঝে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়।
উদাহরণস্বরূপ- বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর মধ্যে কখনো কখনো প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান; যা সংশ্লিষ্ট খাতে সুসংহত উন্নয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। এর পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি, কর ফাঁকি, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন এবং পরিবেশগত অবহেলার মতো ইস্যু ও বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ- তৈরি পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা ইস্যুতে বহুবার আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে একাধিক ব্যবসায়িক নেতার রাজনীতির সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততা, প্রশাসনিক দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজশ, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি উদাসীনতা এই সম্প্রদায়কে প্রায়ই বিতর্কের মুখে ফেলে। ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই সম্প্রদায়ের প্রকৃত ক্ষমতা ও প্রভাব কমে যাচ্ছে।
এখন দেখা যাক বৈশ্বিক বাস্তবতা কি তথ্য উপস্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপে বাণিজ্য সংস্থাগুলো (ঞৎধফব ইড়ফরবং) সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গভীর এবং বহুমুখী ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সংস্থাগুলো যেমন- ট.ঝ. ঈযধসনবৎ ড়ভ ঈড়সসবৎপব এবং ঘধঃরড়হধষ অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ গধহঁভধপঃঁৎবৎং (ঘঅগ), ব্যবসায়িক খাতের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। তারা সুশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রধান ক্ষেত্রে অবদান রাখে- নীতি প্রণয়ন এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ। এই সংস্থাগুলো করনীতি, শ্রম আইন, এবং বাণিজ্য চুক্তিসমূহের প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সংস্থাগুলো করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (ঈঝজ) এবং ব্যবসায়িক স্বচ্ছতার ওপর জোর দেয়। উদাহরণস্বরূপ- কোম্পানিগুলোর করপোরেট গভর্নেন্স ফ্রেমওয়ার্কে এই সংস্থাগুলোর প্রভাবের ফলে ব্যবসায়িক লেনদেন এবং করপোরেট নীতিমালা আরও স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত হয়েছে। এতে করে বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যবসায়িক অনিয়ম হ্রাস পেয়েছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রি (ঈইও), ফেডারেশন অব স্মল বিজনেসেস (ঋঝই) এবং লন্ডন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতো বাণিজ্য সংস্থাগুলো সরকার এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে কাজ করে।
ওই সংস্থাগুলো সুশাসনের জন্য সরাসরি সরকারের সাথে পরামর্শ করে এবং নীতিমালার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে। যেমন- ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্যিক পরিবেশে ঈইও এবং ঋঝই সরকারের সঙ্গে মিলে ব্যবসায়িক নীতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন কাঠামো তৈরি করতে কাজ করছে। এছাড়া করপোরেট কর, শ্রম আইন, এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়িক চর্চা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা বিশাল। এছাড়াও ইউরোপিয়ান চেম্বারস অব কমার্স এবং ইউরোপিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (ঊঞটঈ) মতো সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ- পরিবেশ সংক্রান্ত আইন, শ্রমিকের অধিকার এবং কর নীতি সংশোধন সংক্রান্ত উদ্যোগে তারা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইউরোপিয়ান গ্রিন ডিলের ক্ষেত্রে বাণিজ্য সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এই অঞ্চলে টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা ও সুশাসনের প্রসারে সহায়ক হয়েছে। অধিকন্তু, জাপানের ব্যবসায়িক সম্প্রদায় উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে সুশাসনে ভূমিকা রেখেছে। তাদের ‘কাইজেন’ পদ্ধতি; যা ক্রমাগত উন্নতি সাধন ও দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়- একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ পদ্ধতি শুধু ব্যবসায়িক পরিবেশ নয়, সামগ্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও কার্যকর।
বৈশ্বিক উদাহরণ ও বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে কতিপয় কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। সুশাসনের জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বচ্ছতা। ব্যবসায়িক সম্প্রদায়কে অবশ্যই তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক রিপোর্টিং, ট্যাক্স প্রদান এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রতি সম্মান জানানো এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে তাদের কাজের জন্য জনগণের প্রতি জবাবদিহি করতে হবে। কর ফাঁকি, শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ ধ্বংস বা অন্য কোনো অনৈতিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের আর্থিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব পালনের প্রতি নজর দেয়, তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা আরও জোরালো হবে। এর সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার পরিমাণ কমানোর কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত; যা প্রায়ই ব্যবসা পরিচালনায় পক্ষপাতমূলক সুবিধা ও প্রশাসনিক দুর্নীতি বাড়ায়। ফলে সুশাসনের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে রাজনীতি থেকে কিছুটাা দূরে সরে এসে নিরপেক্ষভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করতে হবে। এতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সমাজ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারবে এবং সুশাসনের বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে।
সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সমাজের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখা সম্ভব; বিশেষত সামাজিক বৈষম্য হ্রাস ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। অধিকন্তু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে সুশাসনের পরিবেশ উন্নত করা যেতে পারে।
ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতি প্রণয়নে অংশ নিতে পারে এবং সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজ করে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক্ষেত্রে জার্মানির ‘মিটেলস্ট্যান্ড’ (ছোট ও মাঝারি শিল্প) মডেল বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায় অনুসরণ করতে পারে।
সুশাসনের উন্নয়নে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভূমিকা বাংলাদেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ভূমিকা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে ব্যবসায় পরিচালনা করা অপরিহার্য। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় শুধু নিজেদের লাভ নয়, সমাজ ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও অবদান রাখলে সুশাসনের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভূমিকা আরও উন্নত করা সম্ভব, যা দেশের সামগ্রিক সুশাসন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
লেখক: লোকপ্রশাসন ও জননীতি গবেষক