ফারজানা কাশেমী : ‘গোটা বিশ্ব আমার সম্প্রসারিত মাতৃভূমি’-গ্যেট। উল্লিখিত বাক্যের ভাবগত অর্থ সুনিশ্চিত হলে হয়তো বিশ্বটার আনুপাতিক দূরত্ব কিছু অংশে হ্রাস পেতো। বিভাজন, যুদ্ধ, হিস্রংতা, বিদ্বেষ, কিছুটা নি¤œহারে পরিলক্ষিত হতো। আমরা অধিকাংশ মানুষ হয়তো মানবিক মানুষ হবার সুযোগ পেতাম। চিন্তার স্বাধীনতার ব্যপ্তি বিস্তৃত, প্রকাশে ঋুজ গতি। সংকুলান সীমাবদ্ধতার সাপেক্ষে আমাদের বিচরণ আজও ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র পরিসরের।
শ্রমিকের কষ্টে অর্জিত শ্রমে আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার, স্যাটেলাইট প্রভৃতি। ভোগ বিলাস বহুল জীবন আমাদের জন্য সহজতর হয় তাদের কষ্ট, ঘামে উপার্জিত অর্থে। উল্লেখ্য যে, পোশাকশিল্প ও এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, শ্রমবাজার, রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, জিডিপি, প্রবৃদ্ধি শিল্পমুখী অর্থনীতির সাথে জড়িত।
যাদের অক্লান্ত শ্রমে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বিনির্মাণ ও সমৃদ্ধ হয়, তাদের ভাগ্য উন্নয়ন নামক যাদুর পরশ, রূপকথার রাজ্য স্বপ্নই থেকে যায়। আইনের সুস্পষ্ট বিধি অনুসরণ হয় না শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে। ভুলুণ্ঠিত হয় ন্যূনতম অধিকার। শ্রম বিক্রির ন্যায্য মুজুরিও তাদের জন্য নিশ্চিত হয় না। শ্রমিকদের জীবন- জীবিকা নির্বাহ আজও কলুর বলদ সাদৃশ্য।
দক্ষিণ এশিয়ার শ্রম বাজারে পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জিত হয় আমাদের দেশে। শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য আনুপাতিক হারে সবচেয়ে কম এই দেশে। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সহজলভ্যতা, সস্তা শ্রম, বৈদেশিক বিনিয়োগ, কম মূল্যে চাহিদা অনুযায়ী পোশাক সরবরাহ ও শ্রমিকদের সহজপ্রাপ্যতায় আমাদের দেশের নাম বহির্বিশ্বে বহুলাংশে পরিচিত। তাই আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার আমরা একচেটিয়া দখলের চেষ্টায় কিছুটা অগ্রগামী। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে পোশাক শিল্পের অর্জিত মুনাফা এই ক্ষুদ্র পরিবেষ্টিত সীমানার চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
অত্যন্ত অনুতাপের বিষয় এই যে, যাদের অক্লান্ত শ্রম ও কষ্টে আজ আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে এদেশের পণ্যের চাহিদা রয়েছে তাদের জীবন যেনো কদরহীন।
শ্রমিকদের ন্যায্য মুজরি বা মানসম্মত মুজরি কোনভাবেই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য না পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে- গতানুগতিক জটিলতা, অস্বচ্ছতা, সদিচ্ছার অভাব, আইনি কাঠামোর দুর্বলতা ও সুষ্ঠু মনিটরিং-এর ব্যত্যয়।
শ্রমিকরা আমাদের শিল্পায়নমুখি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় নিরলস যোদ্ধা। অথচ তারা প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত ও প্রবঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য মুজরি, ভাতা, ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে। শ্রমিকের জীবনের ন্যূনতম স্বার্থ সংরক্ষিত হয় না প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক জটিলতার আচ্ছনতায়। যেন জীবন মানে এক পরাজিত সৈনিক। জীবনের সব স্তরে তাদের জন্য লাঞ্চনা, বঞ্চনা এক অসহায়ত্ব। তাদের সুদিন, দাবি, চাহিদা সঙ্গতিপূর্ণ সহাবস্থান আজও অলিক; যা এক বিষুবরেখায় শুধুই পুঞ্জীভূত হয়। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাস, ক্ষোভ, ঘৃণা ও নোনা জলের করুণত্ব, অসহায়ত্বের নির্মমতা।
শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি মানে তাদের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি। শ্রমিকদের মানসম্মত মজুরি মানে জীবনমান উন্নয়ন, চাহিদা অনুযায়ী ও পরিবারের সদস্য নিয়ে মানসম্মতভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রদানকৃত মজুরি।
মজুরি বোর্ড কর্তৃক শ্রমিকদের জন্য ধার্য্য মজুরি আজও অপ্রতুল। শ্রমিকদের জন্য সুপারিশকৃত মজুরি আজও আলোর মুখ দেখেনি।
তদোপরি, শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অনেকাংশে নতজানু। ফলশ্রুতিতে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ তে মহামারি বা দুর্যোগকালীন সময়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন অনুচ্ছেদ প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে দুর্যোগকালীন সময়ে শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য কোন আইনি রক্ষা কবজ নেই। দুর্যোগকালীন সময়ে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুরক্ষার অধিকার অসংরক্ষিত রয়েছে। তথাপি শ্রম আইন ২০০৬ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের বিধিব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বিধি প্রণীত আছে। শ্রম আইন ২০০৬ এ বলা হয়েছে কোন শ্রমিককে ছাঁটাই করার অন্তত এক মাস পূর্বে তাকে এই বিষয়ে অবহিত করতে হবে। কোন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সময়কাল একবছর হলে এক মাসের মূল বেতন প্রদান সাপেক্ষে তাকে কর্মচ্যুত করতে হবে। কোন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বয়স দশ (১০) বছর হলে তাকে এক বছরের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে। আরো উল্লেখিত হয় যে, কোন শ্রমিকের কর্মের ব্যপ্তি দশ (১০) বছরের অধিক হলে তাকে পয়তাল্লিশ (৪৫) মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে।
কোন কারখানা পূর্ববতী নোটিশ প্রদান ব্যতীত বন্ধ করা যাবে না। কারখানা বন্ধের নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধের বিষয়ে স্পষ্টত নির্দেশনা রয়েছে। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কারখানা বন্ধের দিনই শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, শ্রমিকদের কাজের পরিসর এক বছরের কম হলে তারা কোনরূপ মজুরি প্রাপ্য হয় না। বাংলাদেশে অধিকাংশ কারখানা শ্রমিকদের কর্মের ব্যপ্তি এক বছরের পূর্বেই তাদেরকে ছাঁটাই করে। কারণ দর্শানোর সুযোগ আইনগত বিধি থাকলেও তা অমান্য করে অধিকাংশ কারখানা। শ্রম আইনে শ্রম বাজারে বলবৎ থাকলেও তা শ্রমিকদের সুরক্ষায় অনেকাংশে অকার্যকর।
আইনি কাঠামোর ফাঁক ফোঁকরে হয়তো শ্রমিক শোষিত ও নিস্পেষিত হয়। তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে একদল মানুষ প্রতিপত্তিশীল হচ্ছে।
শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি অধিকার হননে শুধু আইনি জটিলতা ও কারখানার মালিকদের অপারগতাই দায়ী নয়, এর সাথে জড়িত আছে অর্থ পাচার, অধিক মুনাফা অর্জন, ঋণ খেলাপির যোগসাজশের এক কৃত্রিম আস্ফালন। এই শ্রমিকদের শোষণে হয়তো বেগম পাড়ায় কারো ঠিকানা হয়, আবার কারো হয়তো বার্ন ইউনিটে গলিত দেহ অথবা ধ্বংসস্তুপে জীবনাবসান!
খানা জরিপ ২০১১ থেকে ২০১৫ অনুযায়ী শ্রমিকদের গড় পুষ্টি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। এই অসহায়ত্বের করুণ শিকার শ্রমিক যখন তার সামান্য মজুরি বৃদ্ধির জন্য আবেদন করে, তাদের প্রাপ্য হয় লাঠিপেটা বা অবৈধ লে অফ অথবা কর্মচ্যুত। নির্মমতার নিষ্ঠুর পরিহাসে বৃদ্ধ বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে যায় দারিদ্রের কাছে পরাজিত এক নির্বাক লাশ।
ভীষণ আশাপ্রদ একটি খাতে কর্মরত আমাদের শ্রমিকদের নিয়ে অনেক হতাশাই রয়েছে। মালিক-বণিক-উদ্যোক্তা দ্বারা এদেশের শ্রমিকদের শোষণকে এক ‘জঘন্য মডেল’ বললেও অত্যুক্তি হবে না হয়তো। কিন্তু কোনভাবেই এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই যে, বিশাল-বিপুল এই শ্রমশক্তির ওপর ভর করে উন্নত হচ্ছে অর্থনীতি; এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ^সভায় কতশত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা নৈরাজ্যের বাধার প্রাচীর পেরিয়ে শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হোক। হোক শিল্প ঋণের সাড়ে তিন হাজার কোটি ও প্রণোদনার সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সুষম ব্যবস্থাপনা। সঠিক শ্রমবান্ধব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অন্যায্য শ্রমিক ছাঁটাই বিলুপ্ত করা হোক।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ