ঢাকা ১১:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

‘সুন্দর তেহরানকে গাজা হতে দিও না’, বলছেন হতবাক, বিভ্রান্ত ইরানিরা

  • আপডেট সময় : ০৯:০০:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
  • ৭ বার পড়া হয়েছে

ইসরায়েলি হামলায় জ্বলছে তেহরানের শারান তেলক্ষেত্র-ছবি: রয়টার্স

প্রত্যাশা ডেস্ক: পেট্রল স্টেশন, বেকারিতে মানুষের লম্বা সারি। রাজধানী ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করা গাড়ির দীর্ঘ লাইন। আর অন্তহীন, আতঙ্কের সব রাত।
শুক্রবার (১৩ জুন)ভোররাতে ইরানে ইসরায়েলের আচমকা হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়া তেহরানের বাসিন্দারা এখনো ভয় আর বিভ্রান্তির ঘোর থেকে বের হতে পারছেন না। তাদের সঙ্গে কথায় উঠে আসছে অসহায়ত্ব আর মনোজাগতিক নানান টানাপড়েনের দিক। বেশ কয়েক রাত ঘুমাইনি আমরা। সবাই (শহর) ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যাবো না। আমার বাবা বলেছে, পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে নিজের বাড়িতে মৃত্যু বেশি সম্মানের, এনক্রিপটেড সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে বিবিসির এক প্রতিবেদককে এমনটাই বলেছেন সঙ্গীত নিয়ে পড়া ২১ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী। নিজের আসল নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়ায় প্রতিবেদনে তাকে ‘দনিয়া’ নামে ডেকেছে যুক্তরাজ্যের এ সংবাদমাধ্যম। দনিয়া সেই ইরানিদের একজন, যারা দুই পক্ষের এমন এক যুদ্ধে আটকা পড়েছেন, যে যুদ্ধে কোনো পক্ষকেই তাদের পছন্দ নয়। একদিকে ইরানি শাসনব্যবস্থা, যাকে তারা ঘৃণা করেন; অন্যদিকে ইসরায়েল, যারা বছর দেড়েকের মধ্যেই গাজায় অর্ধলক্ষ বেসামরিককে মেরে ফেলেছে। আমি সত্যিই চাই না আমার চমৎকার তেহরান গাজায় পরিণত হোক -বলেছেন তিনি।
শুক্রবার ইরানে হামলা চালানোর পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানিদেরকে মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে আহ্বান জানিয়েছেন তাও ‘গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে’ এ নারীর। ইসরায়েল আমাদের রক্ষা করুক, তা চাই না আমরা। কোনো বিদেশি রাষ্ট্রই কখনো ইরানের ভালো চায়নি। আমরা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রও চাই না, বলেছেন দনিয়া। আরেক নারী জানিয়েছেন, ইসরায়েল যখন ইরানের সামরিক কর্মকর্তাদের মারা শুরু করেছিল, তখন তার অদ্ভূত অনুভূতি হয়েছিল। তিনি একসময় ভাবতেন, ওই সামরিক কর্মকর্তারা বোধহয় এতটাই প্রভাবশালী যে তারা চিরকাল বেঁচে থাকবেন। হঠাৎই ক্ষমতার সেই ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে যখন আমি শুনলাম সাধারণ মানুষ, আমি যাদেরকে চিনি না, কিন্তু আমার মতোই সাধারণ মানুষ মারা পড়ছে, তখন আমি কষ্ট, ভয় আর দুঃখ পেতে শুরু করলাম- বলেন তিনি। এই দুঃখবোধ পরিণত হল রাগে, যখন তিনি শুনতে পেলেন সাউথ পারস গ্যাসক্ষেত্রে হামলা হয়েছে, বুঝতে পারলেন- ইসরায়েল ইরানকে ‘ধুলায় মিশিয়ে দিতে’ চেষ্টা করছে। জীবনে প্রথমবার আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম-বলেছেন তিনি।
শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ইসরায়েলের হামরায় ইরানে ২২০ জনের বেশি বেসামরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানি কর্তৃপক্ষ, এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েল বলেছে, একই সময়ের মধ্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তাদেরও অন্তত ২৪ বেসামরিকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ইসরায়েলিদের তাও আসন্ন হামলার সতর্ক সঙ্কেত বাজানোর ব্যবস্থা আছে, আছে দৌড়ে যাওয়ার মতো কাছাকাছি আশ্রয়কেন্দ্র, ইরানিদের এসব নেই। একদিকে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ছে, অন্যদিকে গাড়ি বোমা হামলা চলছে, দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ আতঙ্ক, বিভ্রান্তি। ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ায় ইরানের ভেতরেই মোল্লাতন্ত্রের অনেক সমর্থকও ভেঙে পড়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। অনেক ইরানি তো তাদের শাসকদের আগে থেকেই অবিশ্বাস করতেন।
দনিয়া আগে মোল্লাতন্ত্র আর এর কঠোর পোশাকবিধি অগ্রাহ্য করে খোলা চুলেই বাইরে যেতেন। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায়, এখন তাকে বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। রাতে খুব আতঙ্কে থাকি। আরাম বোধ করার জন্য কিছু ওষুধ খাই, ঘুমানোর চেষ্টা করি-বলেন এ নারী। ইরানের সরকার দেশটির লোকজনকে হামলার সময় মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এই পরামর্শ মেনে চলা বেশ কঠিন, কারণ কখন কোথায় বিস্ফোরণ ঘটবে, তা জানার যখন কোনো সুযোগই নেই।
তেহরান বেশ বড় শহর, তবুও প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির প্রভাব টের পাচ্ছে,” বিবিসিকে বলেছেন আরেক নারী। এখন আমরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর চেক করি, এবং যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে সেখানে থাকা আত্মীয়-বন্ধুরা জীবিত আছে কিনা, তার খোঁজ নিই। এ নারী এবং তার পরিবারের সদস্যরা এখন নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এমন এক এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে পরিচিত কোনো সরকারি ভবন নেই। কিন্তু ইরানের মতো দেশে, আপনি কখনোই জানতে পারবেন না, আপনার পাশে কারা বাস করছে। শহরটির বাসিন্দারা বলছেন, ইসরায়েলের আক্রমণ ইরানিদেরকে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে। কেউ কেউ শাসকদের ক্ষয়ক্ষতিতে উল্লাস করছে, আর অন্যরা ওই উল্লাসরতদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে। অনেক ইরানির চিন্তাভাবনাও বদলে যাচ্ছে। তিক্ত হচ্ছে ভেদাভেদ, এমনকি পরিবারের ভেতরও। অনেকটা বরফখণ্ডে টাইটানিকের আঘাত হানার পরের কয়েক ঘণ্টার মতো পরিস্থিতি। কেউ পালানোর চেষ্টা করছে, কেউ বলছে এটা বড় কোনো ব্যাপার নেই, বাকিরা নাচতেই আছে -বলেছেন এ নারী। তিনি জানান, তিনি সবসময়ই ইরানের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু নেতানিয়াহু যা করেছে তা ‘ক্ষমার অযোগ্য’। প্রত্যেকের জীবন, তা তারা এই হামলাকে সমর্থন করুক বা না করুক, চিরতরে বদলে গেছে। বেশিরভাগ ইরানিই, এমনিক যারা সরকারের বিরোধী, তারাও বুঝতে পেরেছে যে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ বাস করে যেসব শহরে সেখানে ফেলা ইসরায়েলি বোমার সঙ্গে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আসে না। পরে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে আমরা বেশিরবাগই ভীত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমরা ফার্স্ট এইডের জিনিসপত্র, খাবার, পানিসহ ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি, বলা তো যায় না পরিস্থিতি যদি আরো খারাপ হয়ে যায়।
ইসরায়েল বলছে, তারা ইরানের সামরিক স্থাপনাতেই হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের কমান্ড সেন্টার ও অস্ত্রশস্ত্র বেসরকারি ভবন ও এলাকার ভেতরে রেখেছে। ইসরায়েলের হামলা নিয়ে প্রবাসী ইরানিরাও বেশ উদ্বিগ্ন। এই মুহূর্তে ইরানি হয়ে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা আসলে বোঝানো খুব কঠিন। আপনি ভেবে খুশি হতে পারেন যে, সেই শাসকগোষ্ঠীর লোকেরা, যারা নির্যাতন ও মানুষ হত্যা করেছে তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি সাধারণ মানুষও মারা যাচ্ছে। এটা এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়- বলেছেন যুক্তরাজ্যের লিডসে অবস্থানরত নারী অধিকারকর্মী ও গবেষক ডরেহ খাতিবি-হিল। তিনি এখন পরিবার, বন্ধু এবং অন্যান্য সরকারবিরোধী কর্মীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। তিনি বলেন, আসলে কী ঘটছে সে বিষয়ে ইরানিদের সঠিক তথ্যও দেওয়া হচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সর্বোচ্চ নেতা, এখনো বেঁচে আছেন, অথচ সাধারণ ইরানিরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ চায় না ইরান আরেকটি ইরাক, সিরিয়া বা আফগানিস্তানে পরিণত হোক। আমরা কেউ এই যুদ্ধ চাই না। আমরা এই শাসনব্যবস্থাও চাই না -বলেছেন এ নারী।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

‘সুন্দর তেহরানকে গাজা হতে দিও না’, বলছেন হতবাক, বিভ্রান্ত ইরানিরা

আপডেট সময় : ০৯:০০:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: পেট্রল স্টেশন, বেকারিতে মানুষের লম্বা সারি। রাজধানী ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করা গাড়ির দীর্ঘ লাইন। আর অন্তহীন, আতঙ্কের সব রাত।
শুক্রবার (১৩ জুন)ভোররাতে ইরানে ইসরায়েলের আচমকা হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়া তেহরানের বাসিন্দারা এখনো ভয় আর বিভ্রান্তির ঘোর থেকে বের হতে পারছেন না। তাদের সঙ্গে কথায় উঠে আসছে অসহায়ত্ব আর মনোজাগতিক নানান টানাপড়েনের দিক। বেশ কয়েক রাত ঘুমাইনি আমরা। সবাই (শহর) ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যাবো না। আমার বাবা বলেছে, পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে নিজের বাড়িতে মৃত্যু বেশি সম্মানের, এনক্রিপটেড সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে বিবিসির এক প্রতিবেদককে এমনটাই বলেছেন সঙ্গীত নিয়ে পড়া ২১ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী। নিজের আসল নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়ায় প্রতিবেদনে তাকে ‘দনিয়া’ নামে ডেকেছে যুক্তরাজ্যের এ সংবাদমাধ্যম। দনিয়া সেই ইরানিদের একজন, যারা দুই পক্ষের এমন এক যুদ্ধে আটকা পড়েছেন, যে যুদ্ধে কোনো পক্ষকেই তাদের পছন্দ নয়। একদিকে ইরানি শাসনব্যবস্থা, যাকে তারা ঘৃণা করেন; অন্যদিকে ইসরায়েল, যারা বছর দেড়েকের মধ্যেই গাজায় অর্ধলক্ষ বেসামরিককে মেরে ফেলেছে। আমি সত্যিই চাই না আমার চমৎকার তেহরান গাজায় পরিণত হোক -বলেছেন তিনি।
শুক্রবার ইরানে হামলা চালানোর পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানিদেরকে মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে আহ্বান জানিয়েছেন তাও ‘গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে’ এ নারীর। ইসরায়েল আমাদের রক্ষা করুক, তা চাই না আমরা। কোনো বিদেশি রাষ্ট্রই কখনো ইরানের ভালো চায়নি। আমরা ইসলামিক প্রজাতন্ত্রও চাই না, বলেছেন দনিয়া। আরেক নারী জানিয়েছেন, ইসরায়েল যখন ইরানের সামরিক কর্মকর্তাদের মারা শুরু করেছিল, তখন তার অদ্ভূত অনুভূতি হয়েছিল। তিনি একসময় ভাবতেন, ওই সামরিক কর্মকর্তারা বোধহয় এতটাই প্রভাবশালী যে তারা চিরকাল বেঁচে থাকবেন। হঠাৎই ক্ষমতার সেই ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে যখন আমি শুনলাম সাধারণ মানুষ, আমি যাদেরকে চিনি না, কিন্তু আমার মতোই সাধারণ মানুষ মারা পড়ছে, তখন আমি কষ্ট, ভয় আর দুঃখ পেতে শুরু করলাম- বলেন তিনি। এই দুঃখবোধ পরিণত হল রাগে, যখন তিনি শুনতে পেলেন সাউথ পারস গ্যাসক্ষেত্রে হামলা হয়েছে, বুঝতে পারলেন- ইসরায়েল ইরানকে ‘ধুলায় মিশিয়ে দিতে’ চেষ্টা করছে। জীবনে প্রথমবার আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম-বলেছেন তিনি।
শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ইসরায়েলের হামরায় ইরানে ২২০ জনের বেশি বেসামরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানি কর্তৃপক্ষ, এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েল বলেছে, একই সময়ের মধ্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তাদেরও অন্তত ২৪ বেসামরিকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ইসরায়েলিদের তাও আসন্ন হামলার সতর্ক সঙ্কেত বাজানোর ব্যবস্থা আছে, আছে দৌড়ে যাওয়ার মতো কাছাকাছি আশ্রয়কেন্দ্র, ইরানিদের এসব নেই। একদিকে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ছে, অন্যদিকে গাড়ি বোমা হামলা চলছে, দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ আতঙ্ক, বিভ্রান্তি। ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ায় ইরানের ভেতরেই মোল্লাতন্ত্রের অনেক সমর্থকও ভেঙে পড়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। অনেক ইরানি তো তাদের শাসকদের আগে থেকেই অবিশ্বাস করতেন।
দনিয়া আগে মোল্লাতন্ত্র আর এর কঠোর পোশাকবিধি অগ্রাহ্য করে খোলা চুলেই বাইরে যেতেন। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায়, এখন তাকে বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। রাতে খুব আতঙ্কে থাকি। আরাম বোধ করার জন্য কিছু ওষুধ খাই, ঘুমানোর চেষ্টা করি-বলেন এ নারী। ইরানের সরকার দেশটির লোকজনকে হামলার সময় মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এই পরামর্শ মেনে চলা বেশ কঠিন, কারণ কখন কোথায় বিস্ফোরণ ঘটবে, তা জানার যখন কোনো সুযোগই নেই।
তেহরান বেশ বড় শহর, তবুও প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির প্রভাব টের পাচ্ছে,” বিবিসিকে বলেছেন আরেক নারী। এখন আমরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর চেক করি, এবং যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে সেখানে থাকা আত্মীয়-বন্ধুরা জীবিত আছে কিনা, তার খোঁজ নিই। এ নারী এবং তার পরিবারের সদস্যরা এখন নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এমন এক এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে পরিচিত কোনো সরকারি ভবন নেই। কিন্তু ইরানের মতো দেশে, আপনি কখনোই জানতে পারবেন না, আপনার পাশে কারা বাস করছে। শহরটির বাসিন্দারা বলছেন, ইসরায়েলের আক্রমণ ইরানিদেরকে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে। কেউ কেউ শাসকদের ক্ষয়ক্ষতিতে উল্লাস করছে, আর অন্যরা ওই উল্লাসরতদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে। অনেক ইরানির চিন্তাভাবনাও বদলে যাচ্ছে। তিক্ত হচ্ছে ভেদাভেদ, এমনকি পরিবারের ভেতরও। অনেকটা বরফখণ্ডে টাইটানিকের আঘাত হানার পরের কয়েক ঘণ্টার মতো পরিস্থিতি। কেউ পালানোর চেষ্টা করছে, কেউ বলছে এটা বড় কোনো ব্যাপার নেই, বাকিরা নাচতেই আছে -বলেছেন এ নারী। তিনি জানান, তিনি সবসময়ই ইরানের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু নেতানিয়াহু যা করেছে তা ‘ক্ষমার অযোগ্য’। প্রত্যেকের জীবন, তা তারা এই হামলাকে সমর্থন করুক বা না করুক, চিরতরে বদলে গেছে। বেশিরভাগ ইরানিই, এমনিক যারা সরকারের বিরোধী, তারাও বুঝতে পেরেছে যে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ বাস করে যেসব শহরে সেখানে ফেলা ইসরায়েলি বোমার সঙ্গে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আসে না। পরে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে আমরা বেশিরবাগই ভীত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমরা ফার্স্ট এইডের জিনিসপত্র, খাবার, পানিসহ ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি, বলা তো যায় না পরিস্থিতি যদি আরো খারাপ হয়ে যায়।
ইসরায়েল বলছে, তারা ইরানের সামরিক স্থাপনাতেই হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের কমান্ড সেন্টার ও অস্ত্রশস্ত্র বেসরকারি ভবন ও এলাকার ভেতরে রেখেছে। ইসরায়েলের হামলা নিয়ে প্রবাসী ইরানিরাও বেশ উদ্বিগ্ন। এই মুহূর্তে ইরানি হয়ে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা আসলে বোঝানো খুব কঠিন। আপনি ভেবে খুশি হতে পারেন যে, সেই শাসকগোষ্ঠীর লোকেরা, যারা নির্যাতন ও মানুষ হত্যা করেছে তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি সাধারণ মানুষও মারা যাচ্ছে। এটা এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়- বলেছেন যুক্তরাজ্যের লিডসে অবস্থানরত নারী অধিকারকর্মী ও গবেষক ডরেহ খাতিবি-হিল। তিনি এখন পরিবার, বন্ধু এবং অন্যান্য সরকারবিরোধী কর্মীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। তিনি বলেন, আসলে কী ঘটছে সে বিষয়ে ইরানিদের সঠিক তথ্যও দেওয়া হচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সর্বোচ্চ নেতা, এখনো বেঁচে আছেন, অথচ সাধারণ ইরানিরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ চায় না ইরান আরেকটি ইরাক, সিরিয়া বা আফগানিস্তানে পরিণত হোক। আমরা কেউ এই যুদ্ধ চাই না। আমরা এই শাসনব্যবস্থাও চাই না -বলেছেন এ নারী।