ঢাকা ০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে অগ্রগতি কতদূর?

  • আপডেট সময় : ০১:৫০:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১
  • ৯৩ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : সেন্ট পিটার্সবুর্গ সম্মেলনের লক্ষ্য পূরণে অগ্রগতি হয়নি কিছুই; বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা স্থিতিশীল থাকাই ‘বড় সুখবর’। বন কর্মকর্তারা বলছেন, বাঘের সংখ্যা সেভাবে বাড়ানো না গেলেও পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় বন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও তৎপরতা ‘আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি’। স্থানীয়দের নিয়ে বিভিন্ন কমিটি করে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করছেন তারা।
প্রায় দশ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার অংশ বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় পড়েছে; বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। এই বিচিত্র প্রাণ সম্ভারের বড় স্বাতন্ত্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একক জায়গা হিসেবে সুন্দরবনেই এক সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাঘ ছিল।

২০০৪ সালে বন বিভাগের জরিপে পায়ের ‘ছাপ’ গণনা করে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। এরপর ক্যামেরা ট্র্যাপিংয় পদ্ধতিতে ২০১৫ সালে করা শুমারিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নেমে আসে ১০৬টিতে। ২০১৮ সালের শুমারিতে তা বেড়ে ১১৪টি হয়।
এর মধ্যেই বাঘ রয়েছে এমন ১৩টি দেশের নেতারা ২০১০ সালে মিলিত হয়েছিলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে। ১২ বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার এসেছিল সেই সম্মেলন থেকে। সেই সময় শেষ হতে হাতে আছে আর এক বছর। অর্জনের ঘর একপ্রকার খালি রেখেই গতকাল বৃহস্পতিবার ‘আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস’ পালন করলো বাংলাদেশ।
সরকারিভাবে এবারের বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছিল ‘বাঘ বাঁচায় সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচায় লক্ষ জীবন’। তো সেই বাঘের জন্য সুন্দরবনকে কতটুকু নিরাপদ করতে পেরেছে বাংলাদেশ?
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বললেন, আগে বাঘ লোকালয়ে এলে শত শত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ত মেরে ফেলার জন্য। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
“বাঘ সুরক্ষায় বিভিন্ন কমিটি ও গ্রুপ কাজ করছে। কোনো বাঘ লোকালয়ে এলে মানুষ আর মেরে ফেলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। তারা বনকর্মীদের প্রতি আস্থা রেখে খবর দিচ্ছে, বাঘকে বনের ভেতরে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
অধ্যাপক আনোয়ারুল বলেন, সর্বশেষ জরিপে বৈজ্ঞানিক কোনো কৌশল অবলম্বন করে বাঘের সংখ্যা দেখা হয়নি। তারপরও দেখা গেছে সংখ্যার দিক থেকে আটটি বাঘ বেড়েছে। “এই কয়েক বছরে বাঘের সংখ্যা স্থিতিশীল আছে ধরে নিলেও তা আমাদের জন্য অনেক বড় সুখবর।” ‘যা হয়নি’, তার বদলে ‘যা হতে পারে’- সেই সম্ভাবনার দিকে নজর দিতে চান ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী। তার ভাষায়, “হরিণ সারা সুন্দরবনে আছে, বাঘও সারা সুন্দরবনে বিচরণ করে। বাঘ বৃদ্ধির জন্য এটাই এখন সম্ভাবনার জায়গা।”
বন উজাড় ও অবৈধ শিকারের ফলে বেঙ্গল টাইগার বিশ্বে ‘বিপদাপন্ন’ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে বুনো পরিবেশে টিকে থাকা বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩৮৯০টি। এর মধ্যে সুন্দরবনের দুই অংশ মিলিয়ে বেঙ্গল টাইগার আছে দুইশর কিছু বেশি।
গত কয়েক বছরে লোকালয়ে চলে আসা বাঘের মৃত্যু কমলেও চোরাশিকারির উৎপাত থেমে নেই। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন সংশোধন করে সরকার বাঘ হত্যায় শাস্তি ও অর্থদ- বাড়িয়েছে, কিন্তু গত জানুয়ারি মাসেও সুন্দরবন থেকে শিকার করা একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও বনবিভাগ।
পিটার্সবুর্গ সম্মেলনের অঙ্গীকার পূরণে অন্য দেশগুলো কী করছে? নেচার কনজারভেশন সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সেই সম্মেলনে অংশ নেওয়া ভারত, রাশিয়া, নেপাল ও ভুটান লক্ষ্য পূরণে আংশিকভাবে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ সালের জরিপে এ চারটি দেশেই বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ২০১০ সালের তুলনায় কমেছে। “সুন্দরবনে বাঘ যেসব প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকে, তার মধ্যে চিত্রা হরিণ, শূকর ও বানর রয়েছে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে এদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এখনি সকলকে আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বিলুপ্তি ঠেকানো যাবে না।”
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানেই আছে। এখন দরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রতিটি মানুষের সচেতনতা। পাশাপাশি সুন্দরবনের ওপর স্থানীয় জনগণের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। “বাঘের প্রজননের সময় বনে নির্ভরশীলদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সময়টি যাদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাদের দিকটিও আমাদের দেখতে হবে। এখন আমরা কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি তা যোগ-বিয়োগ করে দেখা দরকার।”
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের (বাগেরহাট) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বাঘসহ বন্য প্রাণীর সুরক্ষায় সুন্দরবনে তাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে সাতটি ক্যাম্প ও এসব ক্যাম্পের অধীন ৩৪টি স্টেশন থেকে বাঘ ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণী সুরক্ষায় বিভিন্ন কর্মকা- অব্যাহত রয়েছে। “ইতোমধ্যে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এলাকা দ্বিগুণ করা হয়েছে। বনের ভেতরে বাঘের খাবার জন্য মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করতে পুকুর খনন চলছে। যারা বনের ওপর নির্ভরশীল ছিল, বনে জীবীকা নির্বাহ করত, তাদের সংখ্যাও কমে এসেছে। “বনের আশপাশে যেসব বনজীবী রয়েছেন, তাদের সাথে বন কর্মকর্তারা নিয়মিত সভা-সমাবেশ করে বন ও প্রাণী রক্ষায় সব ধরনের কর্মকা- অব্যাহত রেখেছেন।”
বেলায়েত হোসেন বলেন, লোকালয়ে বাঘ চলে এলে তাকে আবার বনে ফেরত পাঠাতে কমিউনিটি পেট্রল টিম, কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাথে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম কাজ করে যাচ্ছে।
ঢাকার বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, “সুন্দরবনে বাঘ সুরক্ষায় বন অধিদপ্তর এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ডায়নামিক ও দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজ করছে। এখন যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন, তারা অনেক দায়িত্বশীল।” বর্তমানে করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে মানুষ সুন্দরবনে কম যাচ্ছে, এটা প্রাণীদের জন্য ‘একটি ভাল দিক’ বলে মন্তব্য করেন মোল্যা রেজাউল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুন্দরবনের ওপর দিয়ে যেসব ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে, তাতে বাঘের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি বলেও জানান তিনি।
এ বন কর্মকর্তা বলেন, “এখনও যারা সুন্দরবন এলাকায় বসবাস করছেন, তারা অনেকটাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদেরকে যদি সমাজের মূল অংশের সাথে সম্পৃক্ত করে সেখান থেকে বের করে আনা যায়, তাহলে তারা যেমন উপকৃত হবে, তাতে করে বনের প্রাণীরাও সুরক্ষিত থাকবে।”

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে অগ্রগতি কতদূর?

আপডেট সময় : ০১:৫০:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : সেন্ট পিটার্সবুর্গ সম্মেলনের লক্ষ্য পূরণে অগ্রগতি হয়নি কিছুই; বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা স্থিতিশীল থাকাই ‘বড় সুখবর’। বন কর্মকর্তারা বলছেন, বাঘের সংখ্যা সেভাবে বাড়ানো না গেলেও পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় বন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও তৎপরতা ‘আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি’। স্থানীয়দের নিয়ে বিভিন্ন কমিটি করে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করছেন তারা।
প্রায় দশ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার অংশ বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় পড়েছে; বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। এই বিচিত্র প্রাণ সম্ভারের বড় স্বাতন্ত্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একক জায়গা হিসেবে সুন্দরবনেই এক সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাঘ ছিল।

২০০৪ সালে বন বিভাগের জরিপে পায়ের ‘ছাপ’ গণনা করে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। এরপর ক্যামেরা ট্র্যাপিংয় পদ্ধতিতে ২০১৫ সালে করা শুমারিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নেমে আসে ১০৬টিতে। ২০১৮ সালের শুমারিতে তা বেড়ে ১১৪টি হয়।
এর মধ্যেই বাঘ রয়েছে এমন ১৩টি দেশের নেতারা ২০১০ সালে মিলিত হয়েছিলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে। ১২ বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার এসেছিল সেই সম্মেলন থেকে। সেই সময় শেষ হতে হাতে আছে আর এক বছর। অর্জনের ঘর একপ্রকার খালি রেখেই গতকাল বৃহস্পতিবার ‘আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস’ পালন করলো বাংলাদেশ।
সরকারিভাবে এবারের বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছিল ‘বাঘ বাঁচায় সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচায় লক্ষ জীবন’। তো সেই বাঘের জন্য সুন্দরবনকে কতটুকু নিরাপদ করতে পেরেছে বাংলাদেশ?
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বললেন, আগে বাঘ লোকালয়ে এলে শত শত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ত মেরে ফেলার জন্য। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
“বাঘ সুরক্ষায় বিভিন্ন কমিটি ও গ্রুপ কাজ করছে। কোনো বাঘ লোকালয়ে এলে মানুষ আর মেরে ফেলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। তারা বনকর্মীদের প্রতি আস্থা রেখে খবর দিচ্ছে, বাঘকে বনের ভেতরে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
অধ্যাপক আনোয়ারুল বলেন, সর্বশেষ জরিপে বৈজ্ঞানিক কোনো কৌশল অবলম্বন করে বাঘের সংখ্যা দেখা হয়নি। তারপরও দেখা গেছে সংখ্যার দিক থেকে আটটি বাঘ বেড়েছে। “এই কয়েক বছরে বাঘের সংখ্যা স্থিতিশীল আছে ধরে নিলেও তা আমাদের জন্য অনেক বড় সুখবর।” ‘যা হয়নি’, তার বদলে ‘যা হতে পারে’- সেই সম্ভাবনার দিকে নজর দিতে চান ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী। তার ভাষায়, “হরিণ সারা সুন্দরবনে আছে, বাঘও সারা সুন্দরবনে বিচরণ করে। বাঘ বৃদ্ধির জন্য এটাই এখন সম্ভাবনার জায়গা।”
বন উজাড় ও অবৈধ শিকারের ফলে বেঙ্গল টাইগার বিশ্বে ‘বিপদাপন্ন’ প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে বুনো পরিবেশে টিকে থাকা বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩৮৯০টি। এর মধ্যে সুন্দরবনের দুই অংশ মিলিয়ে বেঙ্গল টাইগার আছে দুইশর কিছু বেশি।
গত কয়েক বছরে লোকালয়ে চলে আসা বাঘের মৃত্যু কমলেও চোরাশিকারির উৎপাত থেমে নেই। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন সংশোধন করে সরকার বাঘ হত্যায় শাস্তি ও অর্থদ- বাড়িয়েছে, কিন্তু গত জানুয়ারি মাসেও সুন্দরবন থেকে শিকার করা একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও বনবিভাগ।
পিটার্সবুর্গ সম্মেলনের অঙ্গীকার পূরণে অন্য দেশগুলো কী করছে? নেচার কনজারভেশন সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সেই সম্মেলনে অংশ নেওয়া ভারত, রাশিয়া, নেপাল ও ভুটান লক্ষ্য পূরণে আংশিকভাবে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ সালের জরিপে এ চারটি দেশেই বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ২০১০ সালের তুলনায় কমেছে। “সুন্দরবনে বাঘ যেসব প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকে, তার মধ্যে চিত্রা হরিণ, শূকর ও বানর রয়েছে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে এদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এখনি সকলকে আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বিলুপ্তি ঠেকানো যাবে না।”
ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানেই আছে। এখন দরকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রতিটি মানুষের সচেতনতা। পাশাপাশি সুন্দরবনের ওপর স্থানীয় জনগণের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। “বাঘের প্রজননের সময় বনে নির্ভরশীলদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সময়টি যাদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাদের দিকটিও আমাদের দেখতে হবে। এখন আমরা কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি তা যোগ-বিয়োগ করে দেখা দরকার।”
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের (বাগেরহাট) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বাঘসহ বন্য প্রাণীর সুরক্ষায় সুন্দরবনে তাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে সাতটি ক্যাম্প ও এসব ক্যাম্পের অধীন ৩৪টি স্টেশন থেকে বাঘ ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণী সুরক্ষায় বিভিন্ন কর্মকা- অব্যাহত রয়েছে। “ইতোমধ্যে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এলাকা দ্বিগুণ করা হয়েছে। বনের ভেতরে বাঘের খাবার জন্য মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করতে পুকুর খনন চলছে। যারা বনের ওপর নির্ভরশীল ছিল, বনে জীবীকা নির্বাহ করত, তাদের সংখ্যাও কমে এসেছে। “বনের আশপাশে যেসব বনজীবী রয়েছেন, তাদের সাথে বন কর্মকর্তারা নিয়মিত সভা-সমাবেশ করে বন ও প্রাণী রক্ষায় সব ধরনের কর্মকা- অব্যাহত রেখেছেন।”
বেলায়েত হোসেন বলেন, লোকালয়ে বাঘ চলে এলে তাকে আবার বনে ফেরত পাঠাতে কমিউনিটি পেট্রল টিম, কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাথে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম কাজ করে যাচ্ছে।
ঢাকার বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, “সুন্দরবনে বাঘ সুরক্ষায় বন অধিদপ্তর এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ডায়নামিক ও দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজ করছে। এখন যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন, তারা অনেক দায়িত্বশীল।” বর্তমানে করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে মানুষ সুন্দরবনে কম যাচ্ছে, এটা প্রাণীদের জন্য ‘একটি ভাল দিক’ বলে মন্তব্য করেন মোল্যা রেজাউল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুন্দরবনের ওপর দিয়ে যেসব ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে, তাতে বাঘের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি বলেও জানান তিনি।
এ বন কর্মকর্তা বলেন, “এখনও যারা সুন্দরবন এলাকায় বসবাস করছেন, তারা অনেকটাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদেরকে যদি সমাজের মূল অংশের সাথে সম্পৃক্ত করে সেখান থেকে বের করে আনা যায়, তাহলে তারা যেমন উপকৃত হবে, তাতে করে বনের প্রাণীরাও সুরক্ষিত থাকবে।”