প্রত্যাশা ডেস্ক : টানা বৃষ্টি কমে আসায় সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও দেশের মধ্যাঞ্চলের নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আভাস মিলছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, দেশের অধিকাংশ প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক দিনে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনও তা বিপৎসীমার উপরেই রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, দেশের ভেতরে এবং উজানের বিভিন্ন অংশে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা কম থাকায় আগামী এক দিনে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। তবে কিশোরগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।
উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি আগামী এক দিন স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা থাকলেও বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতি সামান্য অবনতি হতে পারে বলে পূর্বাভাস এসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পানি ভাটির দিকে নামতে থাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের গাবুরজান গ্রামের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে, বানভাসী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালে।উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেট অঞ্চল গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্যা কবলিত। ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে রেকর্ড বৃষ্টিতে বন্যার কবলে পড়ে বাংলাদেশের দাক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল।
তাতে মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যায় পানিবন্দি হয়ে আছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলার ৩৫ লাখ মানুষ। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটকসহ আশ্রয়ের অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। সিলেট-সুনামগঞ্জে পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ রাখে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাতে পুরো সুনামগঞ্জ জেলাসহ ১৬ উপজেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। সোমবার থেকে আবার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরতে শুরু করেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের আটটি নদীর ১৮ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টায় যমুনা নদী ফুলছড়িতে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে ৫৫ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে ৫৯ সেন্টিমিটার, কাজীপুরে ৫৬ সেন্টিমিটার, সিরাজগঞ্জে ৪৯ সেন্টিমিটার এবং পোড়াবাড়িতে ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল। ব্রহ্মপুত্র তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে রয়েছে। এর মধ্যে নুনখাওয়ায় ২৩ সেন্টিমিটার, হাতিয়ায় ১০৭ সেন্টিমিটার ও কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরে ধরলা নদী কুড়িগ্রাম পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার, ঘাগট নদী গাইবান্ধা পয়েন্টে ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি বইছে। সিলেট অঞ্চলে সুরমা নদী কানাইঘাটে বিপৎসীমার ১০৬ সেন্টিমিটার, সিলেটে ৪১ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে ২৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ওই তিনটি পয়েন্টেই পানি কিছুটা কমেছে।
কুশিয়ারা নদী অমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৮৪ সেন্টিমিটার এবং শেওলা পয়েন্টে ৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি বইছিল মঙ্গলবার সকালে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ নদীর পানির উচ্চতায় হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেনি। তবে খোয়াই নদীর পানি বেড়ে বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার এবং সোমশ্বেরী নদী নেত্রকোণার কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমা থেকে ৮০ সেন্টিমিটার উপরে বইছিল।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৬৪ মিলিমিটার, অরুণাচলের পাসিঘাটে ৪৩ মিলিমিটার এবং জলপাইগুড়িতে ৫৭ মিলিমিটার। একই সময়ে বাংলাদেশের টেকনাফে ৭৪ মিলিমিটার, বরগুনায় ৫৫ এবং পঞ্চগড়ে ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার সঙ্গে প্রবল বিজলী চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর, খুলনা,বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে মাঝারী ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ ছাড়া আগামী ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে খুলে দেওয়া হলো ফেনী রেগুলেটরের ৪০ গেট : ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের পাহাড়ি ঢলে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলাকে সম্ভাব্য বন্যার কবল থেকে রক্ষায় সোনাগাজীর ফেনী (মুহুরী প্রজেক্ট) রেগুলেটরের ৪০টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নুর নবী জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একদিনে মুহুরী নদীতে ১২৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মুহুরী রেগুলেটরে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ২ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার হলেও বর্তমানে সেই প্রবাহ ৩ দশমিক ৯ সেন্টিমিটারে ঠেকেছে। পানির প্রবাহ ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার হলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, “সোমবার সারাদিনে মুহুরী নদীর ১২২ কিলোমিটার বাঁধের চারটি স্থান ভেঙে ফুলগাজী ও পরশুরামের কয়েকটি গ্রামে পানি প্রবেশ করায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুই উপজেলা যাতে বন্যার কবলে না পড়ে সেই বিবেচনায় অতিরিক্ত পানি সরে যেতে রেগুলেটরের সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।”
ত্রাণ নিতে হুড়োহুড়িতে আহত, হাসপাতালে মৃত্যু : সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বন্যা দুর্গতদের জন্য হেলিকপ্টারে করে দেওয়া ত্রাণ সামগ্রী নেওয়ার সময় হুড়োহুড়িতে আহত এক ব্যক্তি মারা গেছেন।
মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিপ্লব মিয়া (৪৫) নামের এই ব্যক্তি মারা যান। তিনি তাহিরপুর উপজেলা সদরের উজান তাহিরপুর গ্রামের শহীদ আলীর ছেলে। তার ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। গত সোমবার বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে দেওয়া ত্রাণ সামগ্রী নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে তিনি আহত হন। উজান তাহিরপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মতিউর রহমান মতি বলেন, সোমবার দুপুরে তাহিরপুরের শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে বিমান বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে বন্যার্তদের ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হচ্ছিল। “ত্রাণ সামগ্রী নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে বিপ্লব মিয়াসহ ছয় জন গুরুতর আহত হন। ওইদিন বিকালে বিপ্লবকে সিলেট রাগীব রাবেয়া হাসপাতালে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার সকালে তিনি সেখানে মারা যান।” তাহিরপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ সরদার বলেন, “ত্রাণ নিতে গিয়ে আহত ব্যক্তি মারা গেছেন বলে তার স্বজনরা আমাদের জানিয়েছেন।”
সিলেটে বানে ভেসে নিখোঁজ মা-ছেলের লাশ উদ্ধার : সিলেটের জৈন্তাপুরে বানের তোড়ে নিঁখোজ হওয়ার তিনদিন পর এক নারী ও তার ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের হাওর থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর জানান। মৃতরা হলেন-উপজেলার দরবস্ত ইউপির মহালীখলা গ্রামের মৃত আজব আলীর স্ত্রী নাজমুন নেছা (৫০) ও তার ছেলে আব্দুর রহমান (১৪)। ওসি বলেন, শনিবার ছেলেকে নিয়ে উপজেলার ছাতারখাই এলাকায় মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন নাজমুন। পথে বাছার খাল এলাকায় বন্যার পানিতে তলিয়ে যান মা-ছেলে। সকালে দরবস্ত হাওরের পানিতে এলাকাবাসী বোরকা পরিহিত এক নারীর লাশ ভাসতে দেখে থানায় খবর দেয়। মা-ছেলের লাশ ময়নাতদেন্তর জন্য সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
গাইবান্ধায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি : বৃষ্টি ও উজানের ঢলে গাইবান্ধায় নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এতে প্রতিদিনেই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার ১০ হাজার পরিবারের অন্তত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে শতশত বিঘা জমির পাট, বাদাম, তিল ও কাউনসহ বিভিন্ন শাকসবজির ক্ষেত। তবে কি পরিমাণ জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার কোন তথ্য নেই জেলার কৃষি বিভাগে। এছাড়া পানি উঠায় পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বাড়িঘরে পানি উঠায় অনেক পরিবার তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উচু জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। এরইমধ্যে সরকারিভাবে খোলা সদরে ২টি ও সাঘাটা উপজেলার ১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৪০০ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলের রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় অনেক এলাকায় যোগাযোগ ভেঙ্গে পড়েছে। বিশেষ করে দূর্গত এলাকার মানুষরা তাদের গবাদি পশু নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্টোল রুমের দায়িত্বরত অপারেটর খায়নুর নাহার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ঘাঘট নদীর পানি শহর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও যমুনার পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তা ও করতোয়ার পানি এখনেও নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।