ঢাকা ০৫:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

সিনহা হত্যায় ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের ফাঁসি, ৬ জনের যাবজ্জীবন

  • আপডেট সময় : ০২:০৫:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২২
  • ৭৫ বার পড়া হয়েছে

কক্সবাজার প্রতিনিধি : আইনি বাহিনীর বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে দেড় বছর আগে সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার যে ঘটনা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, সেই মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। সিনহাকে হত্যায় সহযোগিতা এবং ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্য এবং পুলিশের তিন সোর্সকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। মামলার ১৫ আসামির মধ্যে বাকি চার পুলিশ সদস্য এবং তিন এপিবিএন সদস্যকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল গতকাল সোমবার বিকালে জনাকীর্ণ আদালতে এই আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন। ৩০০ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে’ হত্যা করা হয় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে। আর তাতে আট আসামির সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
ধূসর জ্যাকেট পরে কাঠগড়ায় থাকা প্রদীপ এবং তার পাশে থাকা লিয়াকতের মুখে এ সময় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন, কয়েকজন উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানান। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রদীপের আইনজীবী মহিউদ্দিন খান বলেন, “আমরা রায়ের কপি পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে যাব।”
সিনহার বোন, এ মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস তার স্বামীকে নিয়ে রায় শুনতে এসেছিলেন কক্সবাজারের আদালতে। প্রধান দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় আংশিক প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
“প্রথম থেকে আমরা ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেছি। সেটা আজকে রায়ে দেখেছি, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তবে যে সাতজন একদম খালাস পেয়েছেন, তাদের কিছুটা সাজা হলেও দেওয়া যেত। কারণ ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। সেটা হলে প্রত্যাশা বেশি পূরণ হত।”
এক প্রশ্নের উত্তরে সিনহার বোন বলেন, “সেদিনই আমরা সন্তুষ্ট হব, যেদিন সাজা কার্যকর হবে।” সাতজনের খালাসের বিরুদ্ধে আপলি করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যদিকে খালাস পাওয়া তিনি এপিবিএন সদস্যের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই রায়ে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। প্রমাণ হয়েছে যে,এই দেশে আইনের শাসন আছে, ন্যায়বিচার আছে। এই ন্যায়বিচারের নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।”
করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুর দিকে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে গুলি করে হত্যা করা হয় সিনহা মো. রাশেদ খানকে। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর, যিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর একদল তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ বিষয়ক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। ওই হত্যাকা-ের পর বেরিয়ে আসে, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কীভাবে বন্দুকযুদ্ধ সাজিয়ে খুন করে যাচ্ছিলেন পোশাকী বাহিনীর কর্মকর্তা প্রদীপ।
তথ্যচিত্র নির্মাণে কক্সবাজারে গিয়ে সিনহা ও তার সঙ্গীরা টেকনাফের নিরীহ মানুষের উপর ওসি প্রদীপের ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী’ জেনে গিয়েছিলেন। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে প্রদীপের পরিকল্পনায় সিনহাকে হত্যা করা হয়। প্রদীপের নির্দেশে সিনহাকে গুলি করেন লিয়াকত। বাকিরা তাদের সহযোগিতা করেন।
সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুন হওয়ার পর প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিজেদের ক্ষোভ নিয়ে এসেছিলেন প্রকাশ্যে। সেই পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান ও পুলিশ প্রধান ঘটনাস্থলে গিয়ে বিরল এক সংবাদ সম্মেলনে একসঙ্গে বসে রাষ্ট্রীয় দুই বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্কে অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এক মাসের মধ্যে কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ বদলে ফেলা হয়। সব পরিদর্শককে সরানোর পর পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়। সেই ঘটনার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও কমে যায় লক্ষ্যণীয় হারে। সিনহা হত্যার আগের সাত মাসে যেখানে ১৮৪ জন মারা গিয়েছিলেন; পরের পাঁচ মাসে তা চারজনে নেমে আসে। হত্যাকা-ের ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস যে মামলা করেন, তার কাজও চলে দ্রুত গতিতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের পর র‌্যাব তদন্তভার নিয়ে পাঁচ মাসে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর অভিযোগ গঠন করে ২৯ কার্যদিবসে শুনানি করে গত ১২ জানুয়ারি রায়ের দিন ঠিক করে দেন বিচারক ইসমাইল। ৩৬ বছর বয়সী সিনহা ছিলেন রোমাঞ্চপ্রিয় এক যুবক। খুন হওয়ার দুই বছর আগে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়েন অন্যভাবে জীবন শুরু করার জন্য।
ছোটবেলা থেকেই ছিল ভ্রমণের শখ, ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গিয়েছিলেন কক্সবাজারে। তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ। সিনহার মৃত্যুর পর তাদেরও নির্যাতন ও হয়রানিতে ফেলেছিল পুলিশ।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই সিনহা হত্যাকা-ের পর ৫ আগস্ট ওসি প্রদীপ দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয়জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন তার বোন। সাড়ে চার মাস পর ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরের বছর ২০২১ সালের ২৭ জুন সব আসামির উপস্থিতিতে বিচারক ইসমাইল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। প্রায় দুই মাস পর ২৩ অগাস্ট বাদী শারমিন ফেরদৌসের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। মামলায় মোট সাক্ষী ছিলেন ৮৩ জন। তার মধ্যে নয়জন প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৬৫ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় দিল আদালত।
যেভাবে ঘটে সিনহা হত্যা : ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভের সামলাপুরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি থামানোর পর তিনি বের হলেই তাকে হত্যা করা হয়। অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছিলেন সিনহা; পানি চেয়েছিলেন, তা না দিয়ে তার বুকে লাথি মারেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, মুখ চেপে ধরেন মাটিতে। এরপর ওসি প্রদীপ এসে বুকে আবার লাথি মারার পর নিসাড় হয়ে পড়েন তরতাজা এই য্বুক। অভিযোগপত্রে বলা হয়, পুলিশের তিন সোর্সকে আগে থেকে সিনহার গতিবিধি দেখতে বলা হয়েছিল। ‘ডাকাত’ বলে তাদের উপর হামলার পরিকল্পনাও ছিল প্রদীপের। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল না হওয়ার পর সিনহা গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার পথে সাড়ে ৯টা ২৫ মিনিটে শামলাপুর চেকপোস্টে তাকে আটকানো হয়। তখন গাড়িতে সিনহার সঙ্গে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত। অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, সিনহার পরিচয় শোনা মাত্রই লিয়াকত চিৎকার করে গাড়ির সামনে আসেন এবং উত্তেজিত হয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন। তখন এপিবিএন সদস্যরাও লিয়াকতকে রাস্তা আটকাতে সহায়তা করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “ওই সময় পরিদর্শক লিয়াকত আলী খুবই উত্তেজিত ছিলেন। পুলিশের নির্দেশ পেয়ে সিনহার সঙ্গী সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন।
“চালকের আসনে বসা সিনহা দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কামডাউন, কামডাউন’ বলে লিয়াকতকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এসময় সিনহাকে প্রথমে দুই রাউন্ড এবং কয়েক কদম এগিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত।”
এর পরই মাটিতে পড়ে যান সিনহা। গুলি করার পর সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন লিয়াকত আলী। এসআই নন্দ দুলাল গুলিবিদ্ধ সিনহাকে এ সময় হাতকড়া পরান। রশি এনে সিফাতকে বাঁধা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওসি প্রদীপকে ফোনে ঘটনা জানান পরিদর্শক লিয়াকত।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “মেজর সিনহা তখনও জীবিত ও সচেতন ছিলেন- ব্যথায় গোঙাচ্ছিলেন, পানির জন্য মিনতি করছিলেন। লিয়াকত তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কী পানি খাওয়ানোর জন্য’। “এরপর গুলিবিদ্ধ সিনহার বুকের বামপাশে জোরে জোরে লাথি মারেন এবং পা দিয়ে মাথা চেপে ধরেন লিয়াকত।” এর মধ্যে ওসি প্রদীপ একটি মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ ভ্যানে ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে আসেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “এসেই লিয়াকতের সঙ্গে ‘একান্ত আলাপ’ করেন ওসি প্রদীপ। আলাপ সেরে রাস্তায় পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান ওসি। সিনহা তখনও জীবিত, পানি চাচ্ছিলেন। এসময় সিনহাকে গালিগালাজ করে তার বুকের বাম দিকে জোরে লাথি মারেন প্রদীপ। “একপর্যায়ে পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলায় পাড়া দিয়ে ধরলে তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরও কিছুক্ষণ সিনহার দেহ ঘটনাস্থলে ফেলে রাখে পুলিশ।”
রাত সাড়ে ১০টার পর সিনহাকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেসময় পুলিশের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি গাড়ি ছিল। এগুলোর কোনোটিতেই সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়নি। গুলি করার পর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল।
হত্যাকা-ের নেপথ্য কারণ : মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ওসি প্রদীপ টেকনাফে যে খুন ও চাঁদাবাজি করতেন, তা ফাঁস হওয়ার ভয়েই সিনহাকে হত্যা করা হয় বলে আদালতে যুক্তি দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানায় নিরীহ মানুষের উপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী’ জেনে গিয়েছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা ও তার সঙ্গীরা। প্রদীপের অত্যাচারের শিকার কিছু মানুষের সাক্ষাৎকারও তারা নিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে প্রদীপের সঙ্গেও সিনহা এবং তার সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের কথাও হয়। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে সিনহা ও তার দলকে ‘ধ্বংস করার’ সুযোগ খুঁজতে থাকেন প্রদীপ। তার পরিকল্পনাতেই চেকপোস্টে হত্যা করা হয় সিনহাকে।
আলোচিত এই হত্যাকা-ের তদন্ত শেষে র‌্যাবের তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ বলেছিলেন, “সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল। প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।”
প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে ‘হত্যার কারিগর’ ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার থাকাকালে ২০০৪ সালে পাথরঘাটায় এক বিধবা নারীর জমি দখলের অভিযোগে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন।
কক্সবাজার যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে আরও অভিযোগ ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে। নিজের সৎ বোনের জমি দখল, আইনজীবীকে মারধর এবং একটি বেসরকারি তেল শোধনাগারের লরি আটকে ও চালককে গ্রেপ্তার করে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এরপর কক্সবাজারের মহেশখালী থানায় দুই বছর ওসিগিরি করার পর টেকনাফ থানার দায়িত্ব নিয়ে প্রদীপ মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে হত্যার কারিগর ছিলেন তিনি। সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অপরাধ কর্মের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটি ‘পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ। “ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ ভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা,” প্রদীপকে নিয়ে বলা হয়েছ সিনহা হত্যামামলার অভিযোগপত্রে।
ব্যাপক আলোচনা ওঠার পর পুলিশ থেকে বরখাস্ত হয়ে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট আদালতের মাধ্যমে প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ অগাস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়া নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক সাংবাদিকও প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে।
সিনহার সঙ্গীদের ফাঁসানোর চেষ্টা : সিনহাকে হত্যা করার পর তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে এবং হোটেল থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করে চালানো হয় নির্যাতন, চলে মামলার হয়রানি। সিনহা খুন হওয়ার পরপরই সেনাবাহিনীর রামু ক্যান্টনমেন্টের সার্জেন্ট আইউব আলী ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পুলিশ সদস্যরা তাড়িয়ে দেন, যা পরে তিনি আদালতে সাক্ষ্যে বলেন। সিনহা মারা যাওয়ার পর ওসি প্রদীপের সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা তার গাড়ি তল্লাশি করে মাদক পাওয়ার ঘোষণা দেন। হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ, যা বানোয়াট ছিল বলে পরে তদন্তে উঠে আসে। তবে সিনহা হত্যাকা-ের পর তাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ যা যা পুলিশ জব্দ করেছিল, সেগুলো র‌্যাবের হাতে যাওয়ার পর তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি বলে জানান বাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ। তার ধারণা, ডিজিটাল কনটেন্ট যা ছিল, তা ‘আগেই ধ্বংস করা হয়’। তখন পুলিশের দেওয়া বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে ওই সব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে র‌্যাব জানায়, অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সিনহা হত্যায় ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের ফাঁসি, ৬ জনের যাবজ্জীবন

আপডেট সময় : ০২:০৫:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২২

কক্সবাজার প্রতিনিধি : আইনি বাহিনীর বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে দেড় বছর আগে সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার যে ঘটনা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, সেই মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। সিনহাকে হত্যায় সহযোগিতা এবং ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্য এবং পুলিশের তিন সোর্সকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। মামলার ১৫ আসামির মধ্যে বাকি চার পুলিশ সদস্য এবং তিন এপিবিএন সদস্যকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল গতকাল সোমবার বিকালে জনাকীর্ণ আদালতে এই আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন। ৩০০ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে’ হত্যা করা হয় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে। আর তাতে আট আসামির সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
ধূসর জ্যাকেট পরে কাঠগড়ায় থাকা প্রদীপ এবং তার পাশে থাকা লিয়াকতের মুখে এ সময় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন, কয়েকজন উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানান। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রদীপের আইনজীবী মহিউদ্দিন খান বলেন, “আমরা রায়ের কপি পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে যাব।”
সিনহার বোন, এ মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস তার স্বামীকে নিয়ে রায় শুনতে এসেছিলেন কক্সবাজারের আদালতে। প্রধান দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় আংশিক প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
“প্রথম থেকে আমরা ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেছি। সেটা আজকে রায়ে দেখেছি, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তবে যে সাতজন একদম খালাস পেয়েছেন, তাদের কিছুটা সাজা হলেও দেওয়া যেত। কারণ ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। সেটা হলে প্রত্যাশা বেশি পূরণ হত।”
এক প্রশ্নের উত্তরে সিনহার বোন বলেন, “সেদিনই আমরা সন্তুষ্ট হব, যেদিন সাজা কার্যকর হবে।” সাতজনের খালাসের বিরুদ্ধে আপলি করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যদিকে খালাস পাওয়া তিনি এপিবিএন সদস্যের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এই রায়ে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। প্রমাণ হয়েছে যে,এই দেশে আইনের শাসন আছে, ন্যায়বিচার আছে। এই ন্যায়বিচারের নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।”
করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুর দিকে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে গুলি করে হত্যা করা হয় সিনহা মো. রাশেদ খানকে। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর, যিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর একদল তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ বিষয়ক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। ওই হত্যাকা-ের পর বেরিয়ে আসে, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কীভাবে বন্দুকযুদ্ধ সাজিয়ে খুন করে যাচ্ছিলেন পোশাকী বাহিনীর কর্মকর্তা প্রদীপ।
তথ্যচিত্র নির্মাণে কক্সবাজারে গিয়ে সিনহা ও তার সঙ্গীরা টেকনাফের নিরীহ মানুষের উপর ওসি প্রদীপের ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী’ জেনে গিয়েছিলেন। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে প্রদীপের পরিকল্পনায় সিনহাকে হত্যা করা হয়। প্রদীপের নির্দেশে সিনহাকে গুলি করেন লিয়াকত। বাকিরা তাদের সহযোগিতা করেন।
সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খুন হওয়ার পর প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিজেদের ক্ষোভ নিয়ে এসেছিলেন প্রকাশ্যে। সেই পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান ও পুলিশ প্রধান ঘটনাস্থলে গিয়ে বিরল এক সংবাদ সম্মেলনে একসঙ্গে বসে রাষ্ট্রীয় দুই বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্কে অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এক মাসের মধ্যে কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ বদলে ফেলা হয়। সব পরিদর্শককে সরানোর পর পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়। সেই ঘটনার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও কমে যায় লক্ষ্যণীয় হারে। সিনহা হত্যার আগের সাত মাসে যেখানে ১৮৪ জন মারা গিয়েছিলেন; পরের পাঁচ মাসে তা চারজনে নেমে আসে। হত্যাকা-ের ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস যে মামলা করেন, তার কাজও চলে দ্রুত গতিতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের পর র‌্যাব তদন্তভার নিয়ে পাঁচ মাসে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর অভিযোগ গঠন করে ২৯ কার্যদিবসে শুনানি করে গত ১২ জানুয়ারি রায়ের দিন ঠিক করে দেন বিচারক ইসমাইল। ৩৬ বছর বয়সী সিনহা ছিলেন রোমাঞ্চপ্রিয় এক যুবক। খুন হওয়ার দুই বছর আগে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়েন অন্যভাবে জীবন শুরু করার জন্য।
ছোটবেলা থেকেই ছিল ভ্রমণের শখ, ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গিয়েছিলেন কক্সবাজারে। তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ। সিনহার মৃত্যুর পর তাদেরও নির্যাতন ও হয়রানিতে ফেলেছিল পুলিশ।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই সিনহা হত্যাকা-ের পর ৫ আগস্ট ওসি প্রদীপ দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয়জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন তার বোন। সাড়ে চার মাস পর ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরের বছর ২০২১ সালের ২৭ জুন সব আসামির উপস্থিতিতে বিচারক ইসমাইল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। প্রায় দুই মাস পর ২৩ অগাস্ট বাদী শারমিন ফেরদৌসের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। মামলায় মোট সাক্ষী ছিলেন ৮৩ জন। তার মধ্যে নয়জন প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৬৫ জনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় দিল আদালত।
যেভাবে ঘটে সিনহা হত্যা : ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মেরিন ড্রাইভের সামলাপুরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি থামানোর পর তিনি বের হলেই তাকে হত্যা করা হয়। অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছিলেন সিনহা; পানি চেয়েছিলেন, তা না দিয়ে তার বুকে লাথি মারেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, মুখ চেপে ধরেন মাটিতে। এরপর ওসি প্রদীপ এসে বুকে আবার লাথি মারার পর নিসাড় হয়ে পড়েন তরতাজা এই য্বুক। অভিযোগপত্রে বলা হয়, পুলিশের তিন সোর্সকে আগে থেকে সিনহার গতিবিধি দেখতে বলা হয়েছিল। ‘ডাকাত’ বলে তাদের উপর হামলার পরিকল্পনাও ছিল প্রদীপের। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল না হওয়ার পর সিনহা গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার পথে সাড়ে ৯টা ২৫ মিনিটে শামলাপুর চেকপোস্টে তাকে আটকানো হয়। তখন গাড়িতে সিনহার সঙ্গে ছিলেন সাহেদুল ইসলাম সিফাত। অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, সিনহার পরিচয় শোনা মাত্রই লিয়াকত চিৎকার করে গাড়ির সামনে আসেন এবং উত্তেজিত হয়ে সামনে গিয়ে ব্যারিকেড টেনে রাস্তা বন্ধ করে দেন। তখন এপিবিএন সদস্যরাও লিয়াকতকে রাস্তা আটকাতে সহায়তা করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “ওই সময় পরিদর্শক লিয়াকত আলী খুবই উত্তেজিত ছিলেন। পুলিশের নির্দেশ পেয়ে সিনহার সঙ্গী সিফাত দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামেন।
“চালকের আসনে বসা সিনহা দুই হাত উঁচু করে নেমে ইংরেজিতে ‘কামডাউন, কামডাউন’ বলে লিয়াকতকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এসময় সিনহাকে প্রথমে দুই রাউন্ড এবং কয়েক কদম এগিয়ে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত।”
এর পরই মাটিতে পড়ে যান সিনহা। গুলি করার পর সিনহা ও সিফাতকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন লিয়াকত আলী। এসআই নন্দ দুলাল গুলিবিদ্ধ সিনহাকে এ সময় হাতকড়া পরান। রশি এনে সিফাতকে বাঁধা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওসি প্রদীপকে ফোনে ঘটনা জানান পরিদর্শক লিয়াকত।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “মেজর সিনহা তখনও জীবিত ও সচেতন ছিলেন- ব্যথায় গোঙাচ্ছিলেন, পানির জন্য মিনতি করছিলেন। লিয়াকত তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তোকে গুলি করেছি কী পানি খাওয়ানোর জন্য’। “এরপর গুলিবিদ্ধ সিনহার বুকের বামপাশে জোরে জোরে লাথি মারেন এবং পা দিয়ে মাথা চেপে ধরেন লিয়াকত।” এর মধ্যে ওসি প্রদীপ একটি মাইক্রোবাস এবং একটি পিকআপ ভ্যানে ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে আসেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, “এসেই লিয়াকতের সঙ্গে ‘একান্ত আলাপ’ করেন ওসি প্রদীপ। আলাপ সেরে রাস্তায় পড়ে থাকা মেজর সিনহার কাছে যান ওসি। সিনহা তখনও জীবিত, পানি চাচ্ছিলেন। এসময় সিনহাকে গালিগালাজ করে তার বুকের বাম দিকে জোরে লাথি মারেন প্রদীপ। “একপর্যায়ে পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলায় পাড়া দিয়ে ধরলে তার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরও কিছুক্ষণ সিনহার দেহ ঘটনাস্থলে ফেলে রাখে পুলিশ।”
রাত সাড়ে ১০টার পর সিনহাকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেসময় পুলিশের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি গাড়ি ছিল। এগুলোর কোনোটিতেই সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়নি। গুলি করার পর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল।
হত্যাকা-ের নেপথ্য কারণ : মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ওসি প্রদীপ টেকনাফে যে খুন ও চাঁদাবাজি করতেন, তা ফাঁস হওয়ার ভয়েই সিনহাকে হত্যা করা হয় বলে আদালতে যুক্তি দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানায় নিরীহ মানুষের উপর ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী’ জেনে গিয়েছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা ও তার সঙ্গীরা। প্রদীপের অত্যাচারের শিকার কিছু মানুষের সাক্ষাৎকারও তারা নিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে প্রদীপের সঙ্গেও সিনহা এবং তার সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের কথাও হয়। এরপর বিপদ আঁচ করতে পেরে সিনহা ও তার দলকে ‘ধ্বংস করার’ সুযোগ খুঁজতে থাকেন প্রদীপ। তার পরিকল্পনাতেই চেকপোস্টে হত্যা করা হয় সিনহাকে।
আলোচিত এই হত্যাকা-ের তদন্ত শেষে র‌্যাবের তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ বলেছিলেন, “সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল। প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।”
প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে ‘হত্যার কারিগর’ ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার থাকাকালে ২০০৪ সালে পাথরঘাটায় এক বিধবা নারীর জমি দখলের অভিযোগে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন।
কক্সবাজার যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে আরও অভিযোগ ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে। নিজের সৎ বোনের জমি দখল, আইনজীবীকে মারধর এবং একটি বেসরকারি তেল শোধনাগারের লরি আটকে ও চালককে গ্রেপ্তার করে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এরপর কক্সবাজারের মহেশখালী থানায় দুই বছর ওসিগিরি করার পর টেকনাফ থানার দায়িত্ব নিয়ে প্রদীপ মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য। তার চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হত। পুলিশের পোশাক পরে এভাবে শতাধিক মানুষকে হত্যার কারিগর ছিলেন তিনি। সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অপরাধ কর্মের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটি ‘পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ। “ভয় দেখিয়ে মামলা প্রতি লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ ভাবে আদায় করাই ছিল তার নেশা ও পেশা,” প্রদীপকে নিয়ে বলা হয়েছ সিনহা হত্যামামলার অভিযোগপত্রে।
ব্যাপক আলোচনা ওঠার পর পুলিশ থেকে বরখাস্ত হয়ে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট আদালতের মাধ্যমে প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ওই বছরের ১২ অগাস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে ১২টি মামলায় ১৫টি হত্যার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়া নির্যাতনের অভিযোগে কক্সবাজারের এক সাংবাদিকও প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে।
সিনহার সঙ্গীদের ফাঁসানোর চেষ্টা : সিনহাকে হত্যা করার পর তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে এবং হোটেল থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করে চালানো হয় নির্যাতন, চলে মামলার হয়রানি। সিনহা খুন হওয়ার পরপরই সেনাবাহিনীর রামু ক্যান্টনমেন্টের সার্জেন্ট আইউব আলী ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পুলিশ সদস্যরা তাড়িয়ে দেন, যা পরে তিনি আদালতে সাক্ষ্যে বলেন। সিনহা মারা যাওয়ার পর ওসি প্রদীপের সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা তার গাড়ি তল্লাশি করে মাদক পাওয়ার ঘোষণা দেন। হত্যার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পর পর তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ, যা বানোয়াট ছিল বলে পরে তদন্তে উঠে আসে। তবে সিনহা হত্যাকা-ের পর তাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ যা যা পুলিশ জব্দ করেছিল, সেগুলো র‌্যাবের হাতে যাওয়ার পর তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি বলে জানান বাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ। তার ধারণা, ডিজিটাল কনটেন্ট যা ছিল, তা ‘আগেই ধ্বংস করা হয়’। তখন পুলিশের দেওয়া বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে ওই সব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে র‌্যাব জানায়, অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি।