নিজস্ব প্রতিবেদক : পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাফে কুইন ভবনে আরও দুইজনের মরদেহ পেয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আখতারুজ্জামান গতকাল বুধবার বিকালে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ভবনের বেজমেন্টে দুজন পুরুষের মৃতদেহ পেয়েছেন আমাদের উদ্ধারকর্মীরা। দুটোই উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।”
গত মঙ্গলবার ওই বিস্ফোরণের পর রাতে মোট ১৭ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। স্বজনরা মোট তিনজনের নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছিলেন জেলা প্রশাসনকে।”ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, “ভেতরে আর কারও মৃতদেহ আছে কি না, তা আমরা জানার চেষ্টা করছি।”
মঙ্গলবার বিকালে নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাত তলা ওই ভবনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনে থাকা বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীদের পাশাপাশি সামনে রাস্তায় থাকা যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরাও হতাহত হন। বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হল, তাদের মধ্যে ১৭ জনের মরদেহ পরিবারের সদস্যরা বুঝে পেয়েছেন। বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত মোট ৬৫ জনকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২১ জন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ১০ জন ভর্তি রয়েছেন। যারা দগ্ধ হয়েছেন, তাদের অবস্থাও ভালো নয়।
বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন – মো. সুমন (২১), ইসহাক মৃধা (৩৫), মুনসুর হোসেন (৪০), মো. ইসমাইল (৪২), আল আমিন (২৩), রাহাত (১৮), মমিনুল ইসলাম (৩৮), নদী বেগম (৩৬), মাঈন উদ্দিন (৫০), নাজমুল হোসেন (২৫), ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), আকুতি বেগম (৭০), মো. ইদ্রিস (৬০), নুরুল ইসলাম ভূইয়া (৫৫), হৃদয় (২০), সম্রাট ও সিয়াম (১৮)।
প্রধানমন্ত্রীর শোক: রাজধানীর গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) রাতে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব কে এম সাখাওয়াত মুন বিষয়টি জানিয়েছেন। শোক বার্তায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
দুর্ঘটনা পরবর্তী কাজে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান তাপসের: দুর্ঘটনা পরবর্তী উদ্ধার কাজের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) রাতে গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ প্রসঙ্গে তিনি এ কথা বলেন। ডিএনসিসি মেয়র বলেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহে ঢাকা সিটি রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের স্বেচ্ছাসেবকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, যেকোনো দুর্ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষত এ ধরনের দুর্ঘটনা যখন বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় তখন তা সত্যিকার অর্থেই মেনে নেওয়া কষ্টকর। মেয়র তাপস বলেন, দুর্ঘটনা পরবর্তী উদ্ধার কাজে ডিএসসিসি সহযোগিতা করে চলেছে। আমরা ফায়ার সার্ভিসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে একটি হুইল এক্সক্যাভেটর দুর্ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছি। এছাড়াও উদ্ধার কাজে আরও কোনো ধরনের যান-যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হলে তা দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি, উদ্ধারকাজে ডগ স্কোয়াড: পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার জানান, পরিচালক (অপারেশনস ও মেনটেইনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত ৪ সদস্যের এই কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে উপপরিচালক দিনমনি শর্মাকে। আর ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কম্প্লেক্সের প্রিন্সিপাল আনোয়ারুল হক এবং উপসহকারী পরিচালক শামস আরমান আছেন সদস্য হিসেবে।
সীতাকু-ে অক্সিজেন কারখানা এবং ঢাকার মিরপুরে রোডে ভবনে বিস্ফোরণের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটল। সিদ্দিকবাজারে এতবড় বিস্ফোরণের কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা শাহজাহান মোল্লা বলেন, “ডগ স্কোয়াড দিয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে কোনো মরদেহ রয়েছে কিনা তা খোঁজা হচ্ছে। কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে না।” ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে এসে বলেন, “বিস্ফোরণে কারণ অনুসন্ধান চলছে। তবে এখনও বিস্ফোরকের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থল ডগ স্কোয়াড কাজ করছে।”জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদও বুধবার ঘটনারস্থলে যান। তিনিও বলেন, “একের পর এক ঘটনা ঘটছে। তা খতিয়ে দেখা দরকার। এটা নিছক দুর্ঘটনা না নাশকতা খতিয়ে দেখা উচিত।”
মাছির আনাগোনা দেখে দুটি মরদেহের সন্ধান: ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত সিদ্দিক বাজারের ক্যাফে কুইন ভবনের বেজমেন্টে নেমে তল্লাশি চালানোর সুযোগ না থাকলেও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর দুজনের মৃতদেহের খোঁজ পাওয়া যায় মাছির আনাগোনা দেখে। বিস্ফোরণে ওই ভবনের নিচের দুটি ফ্লোরের ছাদের একাংশ ধসে বেজমেন্টে পড়ে। ভবনটির কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নিচে নেমে তল্লাশি চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সেখানে উদ্ধারকাজ স্থগিত করে ফায়ার সার্ভিস। বুধবার সকাল থেকে ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইট-কংক্রিট সরানো হলেও নিচে নেমে উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। সে কারণে ডগ স্কোয়াড এনে মৃতদেহ খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু হয়। এদিকে ওই ভবনের দুই দোকানকর্মীসহ তিনজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন স্বজনরা। সকাল থেকেই তারা ভবনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন, যদি কোনো খোঁজ পাওয়া যায় এই আশায়। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “উদ্ধার কাজে কোনো ভারী যন্ত্র আরা ব্যবহার করতে পারছি না। লক কাটার যন্ত্র ব্যবহার করে যতটা পারা যায় সেই চেষ্টা করছি। এদিকে বেজমেন্টে পানি জমে আছে। মেশিনের মাধ্যমে সেচে পানি কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। এভাবে যতটা পারা যায় আমরা তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। “এর মধ্যে একটু ভেতরের দিকে বেজমেন্টে অনেক মাছির ভনভন শুনতে পান আমাদের কর্মীরা। ডগ স্কোয়াড দিয়ে তল্লাশি করলে কুকুরগুলো ওই মাছিগুলোর কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। তখন আমাদের ধারণা হয়, ভেতরে নিশ্চয় কিছু আছে।”
আখতারুজ্জামান জানান, প্রথমে কোনো মৃতদেহ দেখা যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ভাঙা কংক্রিট সরানো হয়। প্রায় চার ফুট গভীর কংক্রিট সরানোর পর দুটি মরদেহ দেখতে পাওয়া যায়। পরে ভবনের বেজমেন্ট থেকে ওই দুই পুরুষের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় একে একে। অ্যাম্বুলেন্সে করে সেগুলো পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “আমাদের উদ্ধার অভিযান বন্ধ হয়নি। তবে ভবনের কাঠামো ভাঙা যাচ্ছে না ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে। লক কাটার যন্ত্র ব্যবহার করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে যতটুকু পারা যায় উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। ভেতরে আর কারও মৃতদেহ আছে কি না, তা আমরা জানার চেষ্টা করছি আমরা।”
দগ্ধ ও আহতরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে: সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে দগ্ধ ও আহত ব্যক্তিরা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের অনেকেই এখন মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। তাদের শরীরের ৪০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত বার্ন বা দগ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে যাদের শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাই বেশি ঝুঁকিতে আছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১০ জনের কেউই শঙ্কামুক্ত নন। কালকের দুর্ঘটনায় আমাদের এখানে ১১ জন রোগী ছিলেন। এর মধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়েছে। কারণ, তিনি দগ্ধ হননি। যে ১০ জন আছেন, তাদের মধ্যে তিনজন আইসিই্উতে, দুজন লাইফ সাপোর্টে, বাকিরা এসডিইউতে ভর্তি আছেন। চিকিৎসাধীন ১০ জনের কারও ৮০ শতাংশ, কারও ৯০ শতাংশ; কারও ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এদের সবার শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়া তাদের অবস্থা সংকটজনক।
সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে মৃত্যু বেড়ে ১৯
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ