ঢাকা ০২:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫

সাহস ও চমক-কোনোটাই দেখা গেল না বাজেটে

  • আপডেট সময় : ০৬:৩২:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
  • ১৩ বার পড়া হয়েছে
  • বিভুরঞ্জন সরকার

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ এটিকে ‘ব্যতিক্রমী বাজেট’ বলে মন্তব্য করেন। এর পেছনে তার যুক্তি ছিল-দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণচাপ, রাজনৈতিক চাপ ও রাজস্ব ঘাটতি-বহুবিধ চাপের মধ্যে থেকেও সরকার এমন একটি বাজেট দিয়েছে, যাতে ভারসাম্য রক্ষা হতে পারে। তবে এতে ব্যতিক্রম আসলে কোথায়? সাধারণ মানুষ এই বাজেট থেকে কতটা স্বস্তি পাবে, সে প্রশ্নটি আরো গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে।
এই বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫.২ শতাংশের সমান। অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের তুলনায় বাজেটের আকার বড়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই তুলতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে। বাস্তবতা হলো, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কখনোই অর্জিত হয়নি। ফলে এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যপূরণ নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
অর্থ উপদেষ্টা বাজেটকে ‘ব্যতিক্রমী বাজেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করায় প্রশ্ন উঠেছে, এই বাজেট কতটা ব্যতিক্রমী? এবং এই ব্যতিক্রম সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? দেশের মানুষের জীবনযাত্রার খরচ, আয়ের বৈষম্য এবং ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা যখন এক সংকটজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন এই বাজেটে কী ধরনের দিকনির্দেশনা রাখা হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি।
বাজেট প্রস্তাবে আয়কর রেহাই সীমা ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা অনেকের কাছে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটি কিছুটা স্বস্তির সংবাদ। তবে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ এবং মূল্যস্ফীতির অভিঘাত দেখা যাচ্ছে, তাতে এই স্বস্তি কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, রেস্টুরেন্ট সেবা, জামাকাপড়, বিস্কুট, মিষ্টি প্রভৃতি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যা সরাসরি সাধারণ ভোক্তার কাঁধে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে। ফলে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লেও বাস্তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে অন্তত দ্বিগুণ হারে।

এই বাজেটকে ব্যতিক্রমী বলার কারণ হিসেবে যেসব দিক তুলে ধরা হয়েছে, তার একটি হলো ‘কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা’। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, আইএমএফের চাপ এবং রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের দুর্বলতা মিলে সরকারকে এক প্রকার সংযত বাজেট দিতে বাধ্য করেছে। বলা হচ্ছে, এই বাজেট রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রয়াস। কিন্তু এই ভারসাম্য যদি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কষ্টকে উপেক্ষা করে কেবল ‘পরিসংখ্যানগত’ হয়, তাহলে তা কার্যকর বাজেট নয়, বরং একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ দস্তাবেজে পরিণত হয়।

অর্থনীতির বড় একটি সংকেত হলো, দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। টানা তিন বছর ধরে এটি দেখা যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় উচ্চমূল্যে বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। চাল, ডাল, তেল, ডিম, মাছ, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নীতি হস্তক্ষেপ দরকার, সেটি বাজেটে দৃশ্যমান নয়। বরং কর কাঠামো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পরোক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যায়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই বেশি ভোগান্তিতে ফেলে। আমজনতা কর দেয় মূলত ভ্যাট ও শুল্কের মাধ্যমে। আর এই খাতেই তাদের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো স্বস্তি-বাজারে, চিকিৎসায়, শিক্ষায় এবং পরিবহন খরচে। বাজেটের বক্তব্য ও হিসাবি অংকে এই স্বস্তির প্রতিচ্ছবি খুবই দুর্বল। আবারও দেখা যাচ্ছে, বড় প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণেই বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তার খাতে বাড়তি গুরুত্ব দেখা যায়নি। এমনকি ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে, যা কৃষকদের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা।

এই বাজেটকে ব্যতিক্রমী বললে, সেটি হয়তো সরকারের অর্থনৈতিক সংকোচনের বাস্তবতা মেনে নেওয়ার দিক থেকে। কিন্তু সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে এটি ব্যতিক্রম নয়। এটি সেই চেনা বাজেট-যা পরোক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বাস্তব কার্যক্রমে যথাযথ মনোযোগ দেয় না। নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কারের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটিও অনুপস্থিত। এই বাজেট জনগণের বাজেট হয়ে উঠেছে কি না, সে প্রশ্ন এখন থেকেই উঠতে শুরু করেছে। বাজেট বক্তৃতার পরবর্তী দিন বাজারে গিয়ে যে মানুষ চাল, ডাল, তেলের দাম দেখে হাঁফ ছাড়তে পারছে না, বরং দীর্ঘশ্বাস ফেলছে-তারাই বলে দিচ্ছে বাজেট কতটা বাস্তবমুখী ছিল। সুতরাং বাজেট কতটা ব্যতিক্রমী, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে মাঠে, ঘরে ও বাজারে-টেবিলের কাগজে নয়।

এ ছাড়া বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ভর্তুকিতে কাটছাঁট করা হয়েছে, যা কৃষক ও সাধারণ ভোক্তা-উভয়ের জন্যই দুশ্চিন্তার বার্তা। গত বছরের তুলনায় এই খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ খুব সামান্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে (এবারের বরাদ্দ ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫.৮৪ শতাংশ), কিন্তু উপকারভোগীর সংখ্যা বা নতুন কর্মসূচি তেমনভাবে বাড়েনি। বাস্তবে উপকারভোগীর তুলনায় বাজেট বৃদ্ধির হার অনেক কম, ফলে প্রকৃত অর্থে নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রসার ঘটছে না।

অবশ্য বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে, যেমন আয়কর রেহাই সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ লাখ করা হয়েছে। প্রবীণদের জন্য এই সীমা ৪.৫ লাখ, নারী ও ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ৫ লাখ করা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি ও ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় এই ছাড় অত্যন্ত সামান্য, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদার বিপরীতে। আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি-এই অসমতা রয়ে গেছে।

বাজেটের আরেকটি আলোচিত দিক হলো কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে কিছু প্রকল্প গ্রহণ। যেমন, ৪৮ জেলায় তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, আইটি খাতে দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ইত্যাদি। যদিও উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়, কিন্তু বাস্তবায়নের ইতিহাস আশানুরূপ নয়। ২০২৩ সালে দুর্নীতির কারণে অনেক প্রশিক্ষণ প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই বাজেট আসলে আইএমএফের শর্ত পূরণে মনোনিবেশ করেছে। কারণ, ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্যাকেজের তৃতীয় কিস্তি পেতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে এবং বাজেট ঘাটতি নির্দিষ্ট সীমায় রাখতে হবে। বাজেট বিশ্লেষকরা এটিকে ‘চাপের বাজেট’ বলছেন-যেখানে বৈদেশিক দায় মেটানোর প্রয়োজনে জনস্বার্থের কিছু জায়গায় কাঁটছাঁট করা হয়েছে।

অতএব, এই বাজেট ‘ব্যতিক্রমী’ হয়তো অর্থ উপদেষ্টার ভাষায়, কারণ এটি কঠিন বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ব্যতিক্রম নয় বরং একই ধারার পুনরাবৃত্তি। রাজনৈতিক দলগুলোও বাজেটকে ‘গতানুগতিক’ বলেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ানো, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার খাতে সীমিত অগ্রগতি-এই সবই অতীতের বাজেটের এক পরিচিত চিত্র। এই বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবন সহজ হবে না, বরং আরো কঠিন হতে পারে।

অনেকেরই মনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, বাজেট যখন ‘ব্যতিক্রমী’, বাজেট দিচ্ছেন একজন সম্মানিত অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ, আর পেছনে আছেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রভাবশালী পরামর্শক, তখন বাজেটের মধ্যে সেই প্রত্যাশিত ‘ম্যাজিক’ কোথায়?

আসলে এখানেই বিরোধ। নাম, খ্যাতি ও অতীত অর্জন যতই উজ্জ্বল হোক, রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তবতা তা থেকে অনেক আলাদা। ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, সারা বিশ্ব তাকে সম্মান দিয়েছে। ড. সালেহ উদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বাজেট যেন তাদের দর্শনের এক বাস্তব-সংকুচিত সংস্করণ।

বাজেটে কোথাও ড. ইউনূসের ‘সামাজিক ব্যবসা’র ছায়া নেই। নেই দারিদ্র্য বিমোচনের সেই মৌলিক চিন্তার স্পর্শ, যা তাকে নোবেল এনে দিয়েছিল। ক্ষুদ্র উদ্যোগকে উৎসাহিত করার কোনো সুনির্দিষ্ট কৌশল নেই। মধ্যবিত্ত বা নিম্নআয়ের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ অর্থায়ন, কর ছাড়, অথবা প্রণোদনার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। সামাজিক সুরক্ষা, নারী উদ্যোক্তা, কৃষিজ ব্যবসা-এই জায়গাগুলোতে ‘ইউনূসীয় দর্শন’ ব্যবহার করা যেত, কিন্তু তার চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এতবড় বাজেট, অথচ মানুষের চোখে পড়ার মতো কোনো ‘নতুন ভাবনা’ নেই। যেটুকু আছে, তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শে গৃহীত আর্থিক নিয়ন্ত্রণের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজ-রাজস্ব বাড়াও, ভর্তুকি কমাও, ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখো। এর বাইরে কোনো সৃজনশীল অর্থনৈতিক চিন্তা দৃশ্যমান নয়। জনমানসে প্রশ্ন তাই উঠছে: এই বাজেট কি সত্যিই এ দেশীয় দারিদ্র্য, বৈষম্য ও জীবনযাত্রার সংকট বুঝে তৈরি? নাকি বিদেশি চাপে গৃহীত হিসাবের খেলা?

আর এটুকু সত্য, খ্যাতি আর কার্যকারিতা এক নয়। বাজেট মানে শুধু অঙ্ক নয়-বাজেট মানে দৃষ্টিভঙ্গি। যদি বাজেট একটি দেশের ভবিষ্যতের মানচিত্র হয়, তাহলে এই বাজেটে ভবিষ্যতের ঠিকানা অস্পষ্ট। নেতাদের খ্যাতি, নাম বা অতীত কৃতিত্ব বাজেটকে গণমুখী ও কার্যকর করে না, যদি তার মধ্যে মানুষের স্বস্তির ছোঁয়া না থাকে।
শেষ কথা, যাদের কাছে মানুষ ‘আলো’ খোঁজে, তাদের বাজেট যদি মানুষের জীবনে অন্ধকার বাড়ায়, তাহলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। ম্যাজিকের জন্য শুধু ম্যাজিশিয়ান নয়, চাই মানুষের বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা এবং সাহসী সিদ্ধান্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বাজেটে সেই সাহস বা সেই চমক-কোনোটিই দেখা গেল না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সাহস ও চমক-কোনোটাই দেখা গেল না বাজেটে

আপডেট সময় : ০৬:৩২:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
  • বিভুরঞ্জন সরকার

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ এটিকে ‘ব্যতিক্রমী বাজেট’ বলে মন্তব্য করেন। এর পেছনে তার যুক্তি ছিল-দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণচাপ, রাজনৈতিক চাপ ও রাজস্ব ঘাটতি-বহুবিধ চাপের মধ্যে থেকেও সরকার এমন একটি বাজেট দিয়েছে, যাতে ভারসাম্য রক্ষা হতে পারে। তবে এতে ব্যতিক্রম আসলে কোথায়? সাধারণ মানুষ এই বাজেট থেকে কতটা স্বস্তি পাবে, সে প্রশ্নটি আরো গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে।
এই বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫.২ শতাংশের সমান। অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের তুলনায় বাজেটের আকার বড়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই তুলতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে। বাস্তবতা হলো, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কখনোই অর্জিত হয়নি। ফলে এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যপূরণ নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
অর্থ উপদেষ্টা বাজেটকে ‘ব্যতিক্রমী বাজেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করায় প্রশ্ন উঠেছে, এই বাজেট কতটা ব্যতিক্রমী? এবং এই ব্যতিক্রম সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? দেশের মানুষের জীবনযাত্রার খরচ, আয়ের বৈষম্য এবং ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা যখন এক সংকটজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন এই বাজেটে কী ধরনের দিকনির্দেশনা রাখা হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি।
বাজেট প্রস্তাবে আয়কর রেহাই সীমা ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা অনেকের কাছে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটি কিছুটা স্বস্তির সংবাদ। তবে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ এবং মূল্যস্ফীতির অভিঘাত দেখা যাচ্ছে, তাতে এই স্বস্তি কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, রেস্টুরেন্ট সেবা, জামাকাপড়, বিস্কুট, মিষ্টি প্রভৃতি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যা সরাসরি সাধারণ ভোক্তার কাঁধে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে। ফলে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লেও বাস্তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে অন্তত দ্বিগুণ হারে।

এই বাজেটকে ব্যতিক্রমী বলার কারণ হিসেবে যেসব দিক তুলে ধরা হয়েছে, তার একটি হলো ‘কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা’। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, আইএমএফের চাপ এবং রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের দুর্বলতা মিলে সরকারকে এক প্রকার সংযত বাজেট দিতে বাধ্য করেছে। বলা হচ্ছে, এই বাজেট রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রয়াস। কিন্তু এই ভারসাম্য যদি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কষ্টকে উপেক্ষা করে কেবল ‘পরিসংখ্যানগত’ হয়, তাহলে তা কার্যকর বাজেট নয়, বরং একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ দস্তাবেজে পরিণত হয়।

অর্থনীতির বড় একটি সংকেত হলো, দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। টানা তিন বছর ধরে এটি দেখা যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় উচ্চমূল্যে বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। চাল, ডাল, তেল, ডিম, মাছ, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নীতি হস্তক্ষেপ দরকার, সেটি বাজেটে দৃশ্যমান নয়। বরং কর কাঠামো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পরোক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যায়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই বেশি ভোগান্তিতে ফেলে। আমজনতা কর দেয় মূলত ভ্যাট ও শুল্কের মাধ্যমে। আর এই খাতেই তাদের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।

বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো স্বস্তি-বাজারে, চিকিৎসায়, শিক্ষায় এবং পরিবহন খরচে। বাজেটের বক্তব্য ও হিসাবি অংকে এই স্বস্তির প্রতিচ্ছবি খুবই দুর্বল। আবারও দেখা যাচ্ছে, বড় প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণেই বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তার খাতে বাড়তি গুরুত্ব দেখা যায়নি। এমনকি ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে, যা কৃষকদের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা।

এই বাজেটকে ব্যতিক্রমী বললে, সেটি হয়তো সরকারের অর্থনৈতিক সংকোচনের বাস্তবতা মেনে নেওয়ার দিক থেকে। কিন্তু সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে এটি ব্যতিক্রম নয়। এটি সেই চেনা বাজেট-যা পরোক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের বাস্তব কার্যক্রমে যথাযথ মনোযোগ দেয় না। নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কারের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটিও অনুপস্থিত। এই বাজেট জনগণের বাজেট হয়ে উঠেছে কি না, সে প্রশ্ন এখন থেকেই উঠতে শুরু করেছে। বাজেট বক্তৃতার পরবর্তী দিন বাজারে গিয়ে যে মানুষ চাল, ডাল, তেলের দাম দেখে হাঁফ ছাড়তে পারছে না, বরং দীর্ঘশ্বাস ফেলছে-তারাই বলে দিচ্ছে বাজেট কতটা বাস্তবমুখী ছিল। সুতরাং বাজেট কতটা ব্যতিক্রমী, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে মাঠে, ঘরে ও বাজারে-টেবিলের কাগজে নয়।

এ ছাড়া বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ভর্তুকিতে কাটছাঁট করা হয়েছে, যা কৃষক ও সাধারণ ভোক্তা-উভয়ের জন্যই দুশ্চিন্তার বার্তা। গত বছরের তুলনায় এই খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ খুব সামান্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে (এবারের বরাদ্দ ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫.৮৪ শতাংশ), কিন্তু উপকারভোগীর সংখ্যা বা নতুন কর্মসূচি তেমনভাবে বাড়েনি। বাস্তবে উপকারভোগীর তুলনায় বাজেট বৃদ্ধির হার অনেক কম, ফলে প্রকৃত অর্থে নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রসার ঘটছে না।

অবশ্য বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে, যেমন আয়কর রেহাই সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ লাখ করা হয়েছে। প্রবীণদের জন্য এই সীমা ৪.৫ লাখ, নারী ও ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ৫ লাখ করা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি ও ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় এই ছাড় অত্যন্ত সামান্য, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদার বিপরীতে। আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি-এই অসমতা রয়ে গেছে।

বাজেটের আরেকটি আলোচিত দিক হলো কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে কিছু প্রকল্প গ্রহণ। যেমন, ৪৮ জেলায় তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, আইটি খাতে দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ইত্যাদি। যদিও উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়, কিন্তু বাস্তবায়নের ইতিহাস আশানুরূপ নয়। ২০২৩ সালে দুর্নীতির কারণে অনেক প্রশিক্ষণ প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ কারণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই বাজেট আসলে আইএমএফের শর্ত পূরণে মনোনিবেশ করেছে। কারণ, ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্যাকেজের তৃতীয় কিস্তি পেতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে এবং বাজেট ঘাটতি নির্দিষ্ট সীমায় রাখতে হবে। বাজেট বিশ্লেষকরা এটিকে ‘চাপের বাজেট’ বলছেন-যেখানে বৈদেশিক দায় মেটানোর প্রয়োজনে জনস্বার্থের কিছু জায়গায় কাঁটছাঁট করা হয়েছে।

অতএব, এই বাজেট ‘ব্যতিক্রমী’ হয়তো অর্থ উপদেষ্টার ভাষায়, কারণ এটি কঠিন বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ব্যতিক্রম নয় বরং একই ধারার পুনরাবৃত্তি। রাজনৈতিক দলগুলোও বাজেটকে ‘গতানুগতিক’ বলেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ানো, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার খাতে সীমিত অগ্রগতি-এই সবই অতীতের বাজেটের এক পরিচিত চিত্র। এই বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবন সহজ হবে না, বরং আরো কঠিন হতে পারে।

অনেকেরই মনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, বাজেট যখন ‘ব্যতিক্রমী’, বাজেট দিচ্ছেন একজন সম্মানিত অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ, আর পেছনে আছেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রভাবশালী পরামর্শক, তখন বাজেটের মধ্যে সেই প্রত্যাশিত ‘ম্যাজিক’ কোথায়?

আসলে এখানেই বিরোধ। নাম, খ্যাতি ও অতীত অর্জন যতই উজ্জ্বল হোক, রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তবতা তা থেকে অনেক আলাদা। ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, সারা বিশ্ব তাকে সম্মান দিয়েছে। ড. সালেহ উদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বাজেট যেন তাদের দর্শনের এক বাস্তব-সংকুচিত সংস্করণ।

বাজেটে কোথাও ড. ইউনূসের ‘সামাজিক ব্যবসা’র ছায়া নেই। নেই দারিদ্র্য বিমোচনের সেই মৌলিক চিন্তার স্পর্শ, যা তাকে নোবেল এনে দিয়েছিল। ক্ষুদ্র উদ্যোগকে উৎসাহিত করার কোনো সুনির্দিষ্ট কৌশল নেই। মধ্যবিত্ত বা নিম্নআয়ের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ অর্থায়ন, কর ছাড়, অথবা প্রণোদনার কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। সামাজিক সুরক্ষা, নারী উদ্যোক্তা, কৃষিজ ব্যবসা-এই জায়গাগুলোতে ‘ইউনূসীয় দর্শন’ ব্যবহার করা যেত, কিন্তু তার চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এতবড় বাজেট, অথচ মানুষের চোখে পড়ার মতো কোনো ‘নতুন ভাবনা’ নেই। যেটুকু আছে, তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শে গৃহীত আর্থিক নিয়ন্ত্রণের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজ-রাজস্ব বাড়াও, ভর্তুকি কমাও, ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখো। এর বাইরে কোনো সৃজনশীল অর্থনৈতিক চিন্তা দৃশ্যমান নয়। জনমানসে প্রশ্ন তাই উঠছে: এই বাজেট কি সত্যিই এ দেশীয় দারিদ্র্য, বৈষম্য ও জীবনযাত্রার সংকট বুঝে তৈরি? নাকি বিদেশি চাপে গৃহীত হিসাবের খেলা?

আর এটুকু সত্য, খ্যাতি আর কার্যকারিতা এক নয়। বাজেট মানে শুধু অঙ্ক নয়-বাজেট মানে দৃষ্টিভঙ্গি। যদি বাজেট একটি দেশের ভবিষ্যতের মানচিত্র হয়, তাহলে এই বাজেটে ভবিষ্যতের ঠিকানা অস্পষ্ট। নেতাদের খ্যাতি, নাম বা অতীত কৃতিত্ব বাজেটকে গণমুখী ও কার্যকর করে না, যদি তার মধ্যে মানুষের স্বস্তির ছোঁয়া না থাকে।
শেষ কথা, যাদের কাছে মানুষ ‘আলো’ খোঁজে, তাদের বাজেট যদি মানুষের জীবনে অন্ধকার বাড়ায়, তাহলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। ম্যাজিকের জন্য শুধু ম্যাজিশিয়ান নয়, চাই মানুষের বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা এবং সাহসী সিদ্ধান্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বাজেটে সেই সাহস বা সেই চমক-কোনোটিই দেখা গেল না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট