নিজস্ব প্রতিবেদক : সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে, তাতে দেশের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন’ হওয়ার আশঙ্কা দেখছে বিএনপি। এজন্য শিগগিরই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আগের দিন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত জানাতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ফখরুল।
তিনি বলেন, “সম্প্রতি শেখ হাসিনার ভারত সফরে দেশটির সঙ্গে দুটি চুক্তি, পাঁচটি নতুন সমঝোতা ও তিনটি চুক্তি নবায়নসহ ১০টি চুক্তি সমঝোতা স্বাক্ষর হওয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সম্পাদিত চুক্তিগুলোতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ‘‘চুক্তিগুলো বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী হওয়ায় বিএনপি এই চুক্তিগুলো প্রত্যাখান করছে। আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, বিএনপির সৃষ্টির হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে। বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে আমরা ২৮ তারিখে সংবাদ সম্মেলন করব। এরপরে আমরা প্রয়োজন হলে যে কর্মসূচি নেব, সেটা আপনারা জানতে পারবেন।”
আন্দোলন ভারতের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে: এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, “তবে আমাদের কথা পরিষ্কার, আমাদের এই যে বক্তব্য বা আমাদের যে আন্দোলন এটা কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নয়, এটা সরকারের বিরুদ্ধে। সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে ভারতকে রিচ করতে বা তার কাছ থেকে দাবিগুলো আদায় করে নিয়ে আসতে। “আপনি (সরকার) অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা না পেয়ে চুক্তি সই করতে চাচ্ছেন। তিস্তার পানি আমাদের সবচেয়ে আগে দরকার, কিন্তু তিস্তা প্রকল্পের কাজ করতে চায় সরকার। কারণ প্রকল্প হলে অনেক টাকা। সেই টাকাই তাদের (সরকার) আসলে উদ্দেশ্যে।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে পত্রিকায় দেখলাম, পরিষ্কার করেই মমতা ব্যানার্জি বলে দিয়েছেন যে, পশ্চিমবাংলাকে বাদ দিয়ে এটা করা যাবে না, তারা দেবে না। এজন্য আপনাকে তো অবশ্যই চাপ প্রয়োগ করা দরকার। ফারাক্কা তো একদিনে হয়নি, যতটুকু পাওয়া গেছে সেটা আন্দোলন করেই পাওয়া গেছেৃফারাক্কার ইস্যুটি দেশে-বিদেশে-ইউনাইটেড ন্যাশনসে তোলা হয়েছিল। ‘‘এই সরকার এসব বিষয়ে (অভিন্ন নদী-তিস্তার পানির হিস্যা) জাতিসংঘে উত্থাপন করে নাই। আমরা অভিন্ন নদীর পানি পাচ্ছি না। এটাতে সমগ্র দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা থেকেৃ তাদের সব কিছু নির্ভর করে এসব নদীর উপরে।”
ফখরুল বলেন, “কোটি কোটি মানুষ এই পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিস্তা এসব নদীর অববাহিকায় বাস করে। তাদের মাছ ধরা, পানি আনা সবকিছু নির্ভর করে এই নদীগুলোর উপরে..সেখানে এসব নদীর হিস্যার ব্যাপারে কোনো কথাই নাই। দেখবেন এসব চুক্তিতে কোথাও এই হিস্যা নিয়ে একটা কথাও নাই। এটা থেকে বোঝা যায়-আসলে এই সরকার দেশপ্রেমিক সরকার নয়, বাংলাদশ বিরোধী একটা সরকার।”
এসব চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভ কী? মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আপনার চিকেন নেককে (শিলিগুড়ি করিডোর) বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর তৈরি করা- এটাতে বাংলাদেশের লাভ কী, কোথায় বলতে পারেন? সম্পূর্ণ লাভ তার (ভারতের)। ‘‘এটা ভারত বিরোধী নয়..। আমাদের প্রশ্ন- আমাদের স্বার্থে। দরকার কখনো বন্ধ হবে না, খোলা থাকবে। কানেক্টিভিটি আমার স্বার্থে হতে হবে, আমার স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে হবে না। আমার নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাকে বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি হবে না।”
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনি অভিন্ন নদীর পানির ব্যাপারে কোনো কিছুই করছেন না। সীমান্তে মানুষ হত্যা করছেৃ আপনি কিছুই বলছেন না। আপনি কী করেছেন? চুক্তি করছে। এই চুক্তিতে এসব বিষয়ে একটা কথা আছেৃ একটাও নাই।
‘‘আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, একজন দেশপ্রেমিককে তার দেশের স্বার্থ আগে দেখতে হবে। উনি নিজেই বলেছেন যে, আমি সবকিছু উজাড় করে দিয়ে দিয়েছি। উজাড় করে দিয়ে তো রেজাল্ট পেয়েছেন। এবারও উজাড় করে দিয়ে এসেছেনৃ আবার রেজাল্ট পাবেন।” মির্জা ফখরুল জানান, সোমবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারতের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, সীমান্ত হত্যা, কানেক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত রেল যোগাযোগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগের সমঝোতা, কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতা, ঔষধ সংক্রান্ত সমঝোতা, বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতের অবাধ বিচরণ এবং ভারতের ইনস্পেস ও বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা, রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা, সমুদ্র বিষয়ক গবেষণায় দুই দেশের সমঝোতাগুলোতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। “ভারতকে সকল প্রকার সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ আদায় করতে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এটা ম্যান্ডেটবিহীন অবৈধ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির বহিপ্রকাশ। এই সরকার পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে ভারতের উপর নির্ভরশীল করে ফেলেছে।”
গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার থেকে আমরা সরে যাইনি: মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আমরা কোনো আন্দোলন থেকে সরে যাইনি। বিএনপি গত ১৫/১৬ বছরে যে আন্দোলন করেছে, এই আন্দোলনগুলোকে খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘আমরা কখনো ওই আন্দোলন থেকে সরে যাইনি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছেন গণতন্ত্রের প্রতীক। তাকে মুক্তি করার অর্থ প্রাথমিকভাবে গণতন্ত্র মুক্ত করার মতোই। “আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন থেকে সরে যাইনি, দেশনেত্রীর মুক্তির আন্দোলন থেকে আমরা সরে যাইনি…এটা বাস্তবতা। শি ইজ সিম্বল অব ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট…দুই আন্দোলনকে আলাদা করে দেখা যাবে না।”
খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘স্থিতিশীল’: হৃদযন্ত্রে ‘পেসমেকার’ বসানোর পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘স্থিতিশীল’ বলে জানিয়েছেন দলের মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংবাদ সম্মেলনে তিনি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সাংবাদিকদের জানান। ফখরুল বলেন, “সকাল পর্যন্ত আমি যতটুকু জানি, গতকালকে তাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে.. তা করার কথা না। তিনি সিসিইউতে ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা অ্যাডজাস্ট করতে পারেন না, সে কারণে সিসিইউর ফ্যাসিলিটিজগুলো কেবিনে নিয়ে তাকে শিফট করা হয়েছে। সেখানে তিনি এখন পর্যন্ত স্টেবেল আছেন।”
কর্মসূচি হবে: গত ২৪ জুন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান ফখরুল। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দি করে রাখা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও সংবিধানবিরোধী। অবৈধ সরকার তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে দেশনেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করছে। “দলের স্থায়ী কমিটির সভায় অনতিবিলম্বে দেশনেত্রীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়, একই সঙ্গে তার মুক্তির আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।”