প্রত্যাশা ডেস্ক: দেশে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোয় ক্যানসারের রোগী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ শীর্ষে। যদিও এর সঙ্গে সংগতি রেখে বাড়ছে না চিকিৎসার সুবিধা। যেটুকু সুযোগ-সুবিধা আছে, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। ক্যানসার চিকিৎসার অবকাঠামোও পর্যাপ্ত নয়। ফলে রোগীদের বিদেশমুখী হতে হচ্ছে। ব্যয়বহুল ক্যানসার চিকিৎসা এখনো সাধারণের নাগালের বাইরে। ফলে অনেকেই অবহেলায় পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এভাবে মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে। ক্যানসার চিকিৎসার জন্য রোগীকে বিদেশে যাতে যেতে না হয়, সেজন্য দেশেই ক্যানসার রোগীর চিকিৎসাকে সহজলভ্য করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।
ল্যানসেট অনকোলজির ডিসেম্বর সংস্করণে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ‘সার্কভুক্ত দেশগুলোয় ক্যানসার চিকিৎসার বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে রেডিওথেরাপিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আছে মোট ২৪টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। এর ১৫টি সরকারি ও নয়টি বেসরকারি। এছাড়া দেশের ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য দরকার ১৮০-২০০টি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন। সে তুলনায় আছে মোটে ১৮-২০টি। সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন আছে শুধু জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে। তবে বর্তমানে সেখানকার একটি মেশিনও চালু নেই। দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বাড়ার পেছনে মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধূমপান, তামাক ও স্থূলতা ইত্যাদি। পাশাপাশি পরিবেশ ও বায়ুদূষণও জড়িত। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ফুসফুসে আক্রান্ত হয় বায়ুদূষণের কারণে। দেশে নামমাত্র মলিকুলার স্টাডির জন্য গবেষণাগার রয়েছে মোট একটি-দুটি। ফলে এ পরীক্ষার জন্য রোগীদের দেহ থেকে সংগৃহীত সেল ভারতে পাঠাতে হয়।
দেশে ক্রমেই ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো অপ্রতুল। এছাড়া ক্যানসারে আক্রান্তের কথা শুনলেই দ্রুত চিকিৎসার জন্য মানুষ বিদেশে ছোটে। প্রতিবেশী দেশগুলো ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। বৈশ্বিক ক্যানসার গবেষণা জার্নাল ল্যানসেট অনকোলজির ডিসেম্বর সংস্করণে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ। ২০৪০ সালের মধ্যে তা ২১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কমবেশি ১০ লাখের কাছাকাছি। ২০৪০ সালের মধ্যে তা ১৪ লাখে উন্নীত হবে। সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে একটি ক্যানসার কেন্দ্র দরকার। সেই হিসাবে দেশে ক্যানসার কেন্দ্রের প্রয়োজন ১৭০টি। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আছে ৩০টিরও কম। এসব ক্যানসার হাসপাতালের অধিকাংশই আবার রাজধানীকেন্দ্রিক। হাসপাতালের পাশাপাশি রয়েছে যন্ত্রপাতি সংকটও। কেমোথেরাপি কেন্দ্রও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এছাড়া এ বিপুলসংখ্যক রোগীর সেবায় মাত্র ৩০০-এর আশপাশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। নেই ক্যানসার শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ, যা ২০৩৫ সাল নাগাদ দাঁড়াবে ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৭২৬ জনে। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যানসারজনিত মৃত্যু প্রতি বছর দেড় লাখ। প্রতি বছর ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে দুই লাখ মানুষ, যা সামনের দিনগুলোয় আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা। দেশে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও জনসংখ্যা অনুপাতে তা অপ্রতুল। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ওষুধপত্র বলতে গেলে পুরোটাই কিনতে হয়। এসব ওষুধের জন্য রোগীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কারসাজিতে ওষুধ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। প্রয়োজনীয় পুষ্টিবিদ, মনোচিকিৎসকের অভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির সুযোগ থাকলেও রোগের প্রথম দিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা শূন্যের কোঠায়। ক্যানসার চিকিৎসার সুবিধা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। রোগীদের জন্য আধুনিক স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্যানসার রোগীদের জাতীয় নিবন্ধনের নিয়ম, যেন এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের তথ্য-উপাত্ত তৈরি করা যেতে পারে। যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে জাতীয় ক্যানসার প্রতিরোধ ও চিকিৎসানীতি প্রণয়ন করা সহজ এবং বাস্তবমুখী হয়। স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসারের মৌলিক প্রতিরোধী কার্যক্রমের অভাব রোগের ব্যাপ্তিকে আরো বিস্তৃত করেছে। রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যয়বহুল হওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া, চিকিৎসকের স্বল্পতা সব মিলিয়ে ক্যানসার চিকিৎসা আমাদের দেশে এখনো সাধারণের নাগালের বাইরে। অন্যদিকে এ ব্যাপারে জনসচেতনতার অভাব এ চিত্রকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। ফলে হাজার হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য বহির্মুখী হচ্ছে। ব্লাড ক্যানসারের ব্যাপ্তি ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা খুবই সীমিত। ক্যানসার চিকিৎসাকে সাধারণের নাগালে রাখতে এবং সহজলভ্য করতে দেশে দরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।
ক্রমবর্ধমান ক্যানসার রোগীর পটভূমিতে এখন প্রয়োজন ক্যানসার চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন। কেননা দেশের অধিকাংশ মানুষই সচেতন নয় ক্যানসারের উপসর্গ বিষয়ে। ফলে তারা প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ে দেরি করে ফেলে এবং তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় ক্যানসার নির্ণয়ে গবেষণাগার থাকা দরকার। সচেতনতা সৃষ্টি, রোগ নিরূপণ, চিকিৎসা এবং পরবর্তী সময়ের জন্য পরামর্শক, মনোবিজ্ঞানী, পুষ্টিবিদ ও সরকারের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টাই কেবল পারে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফলতা আনতে। সঙ্গে সঙ্গে বিনামূল্যে অথবা কম মূল্যে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঢাল ক্যানসার চিকিৎসার ব্যাপ্তি রোধ করতে। জনসচেতনতার দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারেও জোরালো কার্যক্রম প্রয়োজন।
সার্ক অঞ্চলে ক্যানসার রোগী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ শীর্ষে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ