নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীসহ দেশের অনেক অঞ্চলে বুধবার (১৮ জুন) সকাল থেকে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে সাগরে সৃষ্টি হওয়া সুস্পষ্ট লঘুচাপ অন্যদিকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এই বৃষ্টি অব্যাহত আছে। আগামী কয়েকদিন এই বৃষ্টি চলতে পারে। এদিকে আকাশে মেঘের কারণে সমুদ্র বন্দরে ৩ এবং নদীবন্দরে ১ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বস এবং নি¤œাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে বলে আবহাওয়া অধিদফতর সতর্ক করেছে। আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, একদিকে লঘুচাপ অন্যদিকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সারা দেশেই বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আগামী চার-পাঁচ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। তবে টানা নয়, থেমে থেমে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে সারা দেশে।
সতর্কবার্তা: সমুদ্র বন্দরের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বজ্রমেঘ তৈরি হচ্ছে এবং বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিসহ দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এই কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলজেলার ওপর দিয়ে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমটার বেগে বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টিসহ অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কবার্তায় বলা হয়, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয়তার কারণে বুধবার সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (২৪ ঘণ্টায় ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (১৮৮ মিলিমিটার) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও কক্সবাজারে পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধ্বসের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারী বর্ষণজনিত কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগরীর কোথাও কোথাও অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে খুলনায় ১১১ মিলিমিটার। এছাড়া পটুয়াখালী খেপুপাড়া ৮৬, নারায়নগঞ্জে ৮৫, কক্সবাজার ৮১, চট্টগ্রামে ৭৮, নোয়াখালীর হাতিয়া ৬৮, গোপালগঞ্জে ৬২, ফেনী ৫৮, ভোলা ৫৬, কয়রা ও মাইজদীকোর্ট ৫৫, কুমিল্লায় ৫৩, মোংলা ৪৮, পটুয়াখালী ৪৯, বরিশাল ৩৭, ঈশ্বরদীতে ৪৩, কুতুবদিয়া ৩৮, ঢাকায় ৩৬, চুয়াডাঙ্গা ৩২, সাতক্ষীরা ৩০, কুমারখালি ২৯, যশোর ২২, চাঁদপুর ২০, রাঙ্গামাটিরমতে ১৮, বান্দরবান ১৬, টাঙ্গাইলে ১২, ফরিদপুরে ১৫, নীলফামারীর ডিমলা ১৩, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ১১, নেত্রকোনা ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর বাইরে প্রায় সারা দেশে কম বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
পূর্বাভাস: আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘণীভূত হয়ে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। এটি উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষ বিহার, সুস্পষ্ট লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল ও বাংলাদেশের দক্ষিণাংশ হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।
বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো বা হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারা দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভবানা রয়েছে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।
একইভাবে বৃহস্পতিবারের পূর্বাভাসে বলা হয়, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো বা হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারা দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। শুক্রবারের পূর্বাভাসে বলা হয়, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো বা হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারা দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
৩ ঘণ্টার বৃষ্টিতে ডুবল চট্টগ্রাম: তিন ঘণ্টার অতি ভারি বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীর কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নগরীর আমবাগান আবহাওয়া কেন্দ্রে ৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত নথিবদ্ধ হয়েছে । এর আগে মঙ্গলবার রাত ২টা থেকে নগরীতে বৃষ্টি শুরু হয়। ভোরের দিকে বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে থাকে। সকালে অঝোর ধারায় ঝরে আষাঢ়ের বৃষ্টি। বুধবার সকাল ৯টার পর থেকে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে শুরু করে। দুপুরেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।
আবহাওয়া অফিসের আমবাগান কেন্দ্র জানায়, বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘন্টায় ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার সকাল ৬টা থেকে তিন ঘণ্টায় ঝরেছে ৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টি। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানায়, বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ওই কেন্দ্রে ৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত নথিবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা ভারি এবং ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি রেকর্ড হলে সেটিকে বলা হয়ে থাকে অতিভারি বৃষ্টিপাত। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা বশীর আহমদ বলেন, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় আছে। তাই অতি ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রামে আগামী কয়েকদিন এরকম ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে।
সকালের তিন ঘণ্টায় অতি ভারি বৃষ্টিতে নগরীর জিইসি মোড়, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, কাপাসগোলা ও হালিশহরের দুয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিস-আদালতগামী মানুষ। নগরীর কাতালগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল আলম বলেন, বৃষ্টি কম হোক বা বেশি কাতালগঞ্জে পানি উঠবেই। শহরের অনেক জায়গায় এখন পানি ওঠে না। কিন্তু এখানে উঠে নিয়মিত। সকালে বাসা থেকে বেরিয়েই দেখি রাস্তায় পানি। অফিসের কাজে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় যাওয়া মঈন উদ্দিন বলেন, আজকে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে তাই পানি উঠেছে বুঝলাম। কিন্তু এখানে গতকালও (মঙ্গলবার) পানি উঠেছিল। অথচ শহরের অন্য কোথাও কালকে পানি উঠেনি। এই এলাকায় কোন গাড়ি এখন আসতে চায় না বৃষ্টি হলে। পানির ভিতর হেঁটে চলাচল করতে হয়। নগরীর কয়েক দশকের জলাবদ্ধতা সংকট কাটাতে সিডিএর মেগা প্রকল্পসহ চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান। এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৩৬টি খাল নিয়ে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ। ৩৬টি খালের মধ্যে ২৫টি খালের কাজ শতভাগ শেষ। বাকিগুলোর মধ্যে ছয়টি খালের কাজ ৯০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। আর পাঁচটি খালের কাজ ৯০ শতাংশের নিচে। নগরীর কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ ও মুরাদপুর এলাকা হিজড়া খাল ঘিরে। সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের অধীনে খালটির খনন ও সংস্কার কাজ শেষ হয়নি এখনো। অন্যদিকে আগ্রাবাদ এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ বক্স কালভার্টের আবর্জনাভরা দশাকে দায়ী করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এখন খালটি পরিষ্কারের কাজ চলছে।