ঢাকা ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
কর্মবিরতিতে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা

সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ, ভোগান্তিতে যাত্রীরা

  • আপডেট সময় : ০৬:০৯:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • ৩৮ বার পড়া হয়েছে

ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: রেলওয়ের রানিং স্টাফরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ১২টা থেকে তারা কর্মবিরতিতে গেছেন। মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স (ভাতা) যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে জটিলতার নিরসন না হওয়ায় ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি’ এই কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করছে।

এদিকে, ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। রাজধানীর কমলাপুরসহ সারা দেশের রেল স্টেশনগুলোতে বহু যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে ফিরে গেছেন।

বেলা সাড়ে ১১টার অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ধরে জামালপুরে যাওয়ার কথা হাসান আলীর। কিন্তু কর্মীদের ধর্মঘটে ট্রেন চলাচল যে বন্ধ, সেটা তিনি জানতে পেরেছেন কমলাপুর স্টেশনে আসার পর।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে কমলাপুরের প্ল্যাটফর্মে একটি সংবাদসংস্থার প্রতিবেদক যখন হাসান আলীর কাছে জানতে চান, তার চোখেমুখে তখন রাজ্যের বিরক্তি। হাসান বলেন-আমি জানতাম না ট্রেন চলাচল বন্ধ। গতকাল বিকেলেই টিকিট কাটলাম। পরিস্থিতি একদম বাজে। কথাবার্তা নাই, সবাই আন্দোলনে নেমে যাচ্ছে। হাসান আলী বলেন, আজ আমার বন্ধুকে মেয়েপক্ষ দেখতে আসবে। দুপুর ১টায় সেখানে যাওয়ার কথা। না হয় একদিন পরে গেলেও সমস্যা হত না। এখন বেকাদায় পড়লাম। এখন ডবল ভাড়া দিয়ে বাসে যেতে হবে।
একইরকম ভোগান্তিতে পড়েছেন দিনাজপুরের যাত্রী সোহরাব হোসেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সকালে কমলাপুর থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণায় তিনিও বিপাকে পড়েছেন।

কক্সবাজারে যেতে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ৯ কিশোর। তাদের একজন মো. নাদিম বলেন, সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে পর্যটন এক্সপ্রেসে কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। এখন এখানে এসে শুনি ট্রেন যাবে না। আগে জানলে আমরা টিকিট কাটতাম না।

বেসরকারি চাকুরে শফিকুল ইসলাম বলেন, বেনাপোল যাওয়ার জন্য গত ২৪ তারিখে টিকিট কেটেছিলাম। ১০টা ৪৫ মিনিটে রূপসী বাংলা ট্রেনে বেনাপোল যাওয়ার কথা ছিল। আমি বাসে যাতায়াত করতে পারব না। ট্রেন যদি নাই যাবে, তাহলে টিকিট বিক্রি করল কেন? আমি তো মহাবিপদে পড়লাম।

অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মো. মজিবুর রহমান বলেন, আমরা রার্নিং স্টাফরা রাত ১২টা থেকে কর্মবিরতি পালন করছি। এ কারণে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমাদের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।

মঙ্গলবার সকালে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনরত রেলকর্মীরা ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে ঘুরে-ঘুরে স্লোগান দিচ্ছেন। পাশেই রেলের লাইনের কাজ করছেন কয়েকজন। লাইনের উপর অন্তত তিনটি ট্রেন দাঁড়ানো রয়েছে। আশপাশে কিছু যাত্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। কেউ কেউ টিকেটের টাকা ফেরত নেওয়ার খোঁজ করছেন, কেউ আবার বিআরটিসির বাসে করে গন্তব্যে যাচ্ছেন।

বন্ধ থাকা ট্রেনের যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বিআরটিসির এসব বাসের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলপথ মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এসব বাস ঢাকার কমলাপুর এবং বিমানবন্দর স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া ও ময়মনসিংহে যাত্রী পৌঁছে দেবে। যাত্রীরা তাদের রেলের টিকেট ব্যবহার করে এসব বাসে চড়তে পারবেন। আর যাত্রী চাইলে টিকিটের টাকা রেলের কাউন্টার থেকে ফেরত নিতে পারবেন।

এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, রার্নিং স্টাফরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এ কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি। কর্মবিরতি পালনকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রার্নিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি এবং কোনো ট্রেন আসেনি। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টায় ঢাকার উদ্দেশে চট্টলা, ৭টায় কক্সবাজারগামী স্পেশাল, সাড়ে ৭টায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস, ৭টা ৪০ মিনিটে সাগরিয়া এক্সপ্রেস ও ৭টা ৫০ মিনিটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। রার্নিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে এসব ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খান বলেন, রেলের রানিং স্টাফরা বিভিন্ন দাবিতে সোমবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে কর্মবিরতিতে যায়। এরপর থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে অবস্থান করছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ৩৭ আপটন ভোর ৩টার সময় এসে ময়মনসিংহে অবস্থান করছে। আরেকটি ট্রেন ভুয়াপুর থেকে ছেড়ে এসেছে। চট্টগ্রামগামী থার্টি এইট ডাউন ট্রেনটিও স্টেশনে রয়েছে। রেলের চালক, সহকারী চালকসহ অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় এ কর্মবিরতিতে আছেন।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে রানিং স্টাফ কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, দাবি আদায়ে এর আগেও আমরা কর্মবিরতিতে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আমরা কর্মবিরতি স্থগিত রেখেছিলাম। এরপরও আমাদের দাবি আদায় না হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সারা দেশের মতো ময়মনসিংহ সোমবার রাত ১২টা এক মিনিট থেকে আমরা ট্রেন চালানো বন্ধ রেখেছি। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজে যোগ দেবো না।
রাজশাহী রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজশাহীতে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। আমাদের অধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম বলেন, ভোর ৬টার দিকে কালনি এক্সপ্রেস ও সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাহাড়িকা ছাড়ার কথা থাকলে কর্মবিরতির কারণে ছাড়া সম্ভব হয়নি। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় হওয়ায় আমরা টিকেট ফেরত নিচ্ছি। সেই সঙ্গে যদি সমস্যা সমাধান হয়ে যায় তা হলে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।

রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে হলে আট ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময় কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়; যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।

২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনো ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা।
মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে তিন বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন তারা। কয়েক দফায় অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলসচিব, রেলমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন।

গত ২২ জানুয়ারি দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বটতলী পুরাতন রেলস্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মজিবুর রহমান বলেন, ‘রেলওয়ের রানিং স্টাফরা ১৬০ বছর ধরে অবসরের পর মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পেয়ে আসছেন। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক যেকোনও দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ট্রেন সচল রাখেন রানিং স্টাফরা। তাদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি বা জাতীয় দিবসের বন্ধ নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেদের দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় ঢাকতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বেতন, পেনশন ও আনুতোষিক কমিয়ে দেয়।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বর্তমান সরকারকে তিনবার সময় দেওয়া হয়েছে। তারা স্থায়ী সমাধান চান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পত্র এবং নতুন নিয়োগ পাওয়া রানিং স্টাফদের বৈষম্যমূলক শর্ত প্রত্যাহার করতে হবে।

কমলাপুর স্টেশনে পড়ে আছে পণ্য: মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পার্সেল শাখার সামনে সোফা, চেয়ার, ফ্রিজসহ নানা পণ্য পড়ে আছে। পণ্যের সঙ্গে আসা কেউ কেউ আবার ক্লান্ত হয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
পার্সেল শাখার দায়িত্বরত এক কর্মচারী বলেন, ট্রেন চলাচল না করায় এই পণ্যগুলো পাঠানো যায়নি। ফলে স্টেশনে পড়ে আছে। ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পরই এগুলো পাঠানো হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

কর্মবিরতিতে রেলওয়ের রানিং স্টাফরা

সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ, ভোগান্তিতে যাত্রীরা

আপডেট সময় : ০৬:০৯:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: রেলওয়ের রানিং স্টাফরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ১২টা থেকে তারা কর্মবিরতিতে গেছেন। মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স (ভাতা) যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে জটিলতার নিরসন না হওয়ায় ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতি’ এই কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করছে।

এদিকে, ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। রাজধানীর কমলাপুরসহ সারা দেশের রেল স্টেশনগুলোতে বহু যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে ফিরে গেছেন।

বেলা সাড়ে ১১টার অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ধরে জামালপুরে যাওয়ার কথা হাসান আলীর। কিন্তু কর্মীদের ধর্মঘটে ট্রেন চলাচল যে বন্ধ, সেটা তিনি জানতে পেরেছেন কমলাপুর স্টেশনে আসার পর।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে কমলাপুরের প্ল্যাটফর্মে একটি সংবাদসংস্থার প্রতিবেদক যখন হাসান আলীর কাছে জানতে চান, তার চোখেমুখে তখন রাজ্যের বিরক্তি। হাসান বলেন-আমি জানতাম না ট্রেন চলাচল বন্ধ। গতকাল বিকেলেই টিকিট কাটলাম। পরিস্থিতি একদম বাজে। কথাবার্তা নাই, সবাই আন্দোলনে নেমে যাচ্ছে। হাসান আলী বলেন, আজ আমার বন্ধুকে মেয়েপক্ষ দেখতে আসবে। দুপুর ১টায় সেখানে যাওয়ার কথা। না হয় একদিন পরে গেলেও সমস্যা হত না। এখন বেকাদায় পড়লাম। এখন ডবল ভাড়া দিয়ে বাসে যেতে হবে।
একইরকম ভোগান্তিতে পড়েছেন দিনাজপুরের যাত্রী সোহরাব হোসেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সকালে কমলাপুর থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণায় তিনিও বিপাকে পড়েছেন।

কক্সবাজারে যেতে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ৯ কিশোর। তাদের একজন মো. নাদিম বলেন, সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে পর্যটন এক্সপ্রেসে কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। এখন এখানে এসে শুনি ট্রেন যাবে না। আগে জানলে আমরা টিকিট কাটতাম না।

বেসরকারি চাকুরে শফিকুল ইসলাম বলেন, বেনাপোল যাওয়ার জন্য গত ২৪ তারিখে টিকিট কেটেছিলাম। ১০টা ৪৫ মিনিটে রূপসী বাংলা ট্রেনে বেনাপোল যাওয়ার কথা ছিল। আমি বাসে যাতায়াত করতে পারব না। ট্রেন যদি নাই যাবে, তাহলে টিকিট বিক্রি করল কেন? আমি তো মহাবিপদে পড়লাম।

অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মো. মজিবুর রহমান বলেন, আমরা রার্নিং স্টাফরা রাত ১২টা থেকে কর্মবিরতি পালন করছি। এ কারণে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমাদের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।

মঙ্গলবার সকালে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনরত রেলকর্মীরা ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে ঘুরে-ঘুরে স্লোগান দিচ্ছেন। পাশেই রেলের লাইনের কাজ করছেন কয়েকজন। লাইনের উপর অন্তত তিনটি ট্রেন দাঁড়ানো রয়েছে। আশপাশে কিছু যাত্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। কেউ কেউ টিকেটের টাকা ফেরত নেওয়ার খোঁজ করছেন, কেউ আবার বিআরটিসির বাসে করে গন্তব্যে যাচ্ছেন।

বন্ধ থাকা ট্রেনের যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বিআরটিসির এসব বাসের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলপথ মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এসব বাস ঢাকার কমলাপুর এবং বিমানবন্দর স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া ও ময়মনসিংহে যাত্রী পৌঁছে দেবে। যাত্রীরা তাদের রেলের টিকেট ব্যবহার করে এসব বাসে চড়তে পারবেন। আর যাত্রী চাইলে টিকিটের টাকা রেলের কাউন্টার থেকে ফেরত নিতে পারবেন।

এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, রার্নিং স্টাফরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এ কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি। কর্মবিরতি পালনকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রার্নিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি এবং কোনো ট্রেন আসেনি। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টায় ঢাকার উদ্দেশে চট্টলা, ৭টায় কক্সবাজারগামী স্পেশাল, সাড়ে ৭টায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস, ৭টা ৪০ মিনিটে সাগরিয়া এক্সপ্রেস ও ৭টা ৫০ মিনিটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। রার্নিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে এসব ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খান বলেন, রেলের রানিং স্টাফরা বিভিন্ন দাবিতে সোমবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে কর্মবিরতিতে যায়। এরপর থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে অবস্থান করছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ৩৭ আপটন ভোর ৩টার সময় এসে ময়মনসিংহে অবস্থান করছে। আরেকটি ট্রেন ভুয়াপুর থেকে ছেড়ে এসেছে। চট্টগ্রামগামী থার্টি এইট ডাউন ট্রেনটিও স্টেশনে রয়েছে। রেলের চালক, সহকারী চালকসহ অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় এ কর্মবিরতিতে আছেন।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে রানিং স্টাফ কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, দাবি আদায়ে এর আগেও আমরা কর্মবিরতিতে গিয়েছিলাম। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে আমরা কর্মবিরতি স্থগিত রেখেছিলাম। এরপরও আমাদের দাবি আদায় না হওয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সারা দেশের মতো ময়মনসিংহ সোমবার রাত ১২টা এক মিনিট থেকে আমরা ট্রেন চালানো বন্ধ রেখেছি। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজে যোগ দেবো না।
রাজশাহী রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজশাহীতে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। আমাদের অধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম বলেন, ভোর ৬টার দিকে কালনি এক্সপ্রেস ও সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাহাড়িকা ছাড়ার কথা থাকলে কর্মবিরতির কারণে ছাড়া সম্ভব হয়নি। ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় হওয়ায় আমরা টিকেট ফেরত নিচ্ছি। সেই সঙ্গে যদি সমস্যা সমাধান হয়ে যায় তা হলে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।

রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে হলে আট ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময় কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়; যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।

২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনো ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা।
মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে তিন বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন তারা। কয়েক দফায় অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলসচিব, রেলমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন।

গত ২২ জানুয়ারি দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বটতলী পুরাতন রেলস্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মজিবুর রহমান বলেন, ‘রেলওয়ের রানিং স্টাফরা ১৬০ বছর ধরে অবসরের পর মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পেয়ে আসছেন। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক যেকোনও দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ট্রেন সচল রাখেন রানিং স্টাফরা। তাদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি বা জাতীয় দিবসের বন্ধ নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেদের দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় ঢাকতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বেতন, পেনশন ও আনুতোষিক কমিয়ে দেয়।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বর্তমান সরকারকে তিনবার সময় দেওয়া হয়েছে। তারা স্থায়ী সমাধান চান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পত্র এবং নতুন নিয়োগ পাওয়া রানিং স্টাফদের বৈষম্যমূলক শর্ত প্রত্যাহার করতে হবে।

কমলাপুর স্টেশনে পড়ে আছে পণ্য: মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পার্সেল শাখার সামনে সোফা, চেয়ার, ফ্রিজসহ নানা পণ্য পড়ে আছে। পণ্যের সঙ্গে আসা কেউ কেউ আবার ক্লান্ত হয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
পার্সেল শাখার দায়িত্বরত এক কর্মচারী বলেন, ট্রেন চলাচল না করায় এই পণ্যগুলো পাঠানো যায়নি। ফলে স্টেশনে পড়ে আছে। ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পরই এগুলো পাঠানো হবে।