লাইফস্টাইল ডেস্ক: ‘আগে তো বুঝিনি, সে এমন!’- আমাদের চারপাশে প্রায়ই এ ধরনের কথা শোনা যায়। যখন কেউ এসব কথা বলে, বুঝতে হবে সময়টা পেরিয়ে গেছে বেশ খানিক। কিন্তু এতেই কি সব শেষ? না। বিষয়টি তেমন নয়। যার সঙ্গে জীবন কাটাবেন, তাকে বুঝে নেওয়া শিখতে হবে। সেভাবে তার সঙ্গে নিজের আচরণের প্যারামিটার নির্ধারণ করতে হবে। সম্ভব হলে আপনার সঙ্গীর এসব লক্ষণ আগে বুঝে নিন।
‘কোভার্ট নার্সিসিজম’ বলে একটি বিষয় আছে মনোবিদ্যার জগতে। কোভার্ট নার্সিসিস্টরা সেই জগতে অনেকটা ছুপা রুস্তম। তাদের সহজে ধরতে পারা কঠিন। একে দুর্বল নার্সিসিজমও বলে। কারণ কোভার্ট নার্সিসিস্ট মানুষ অনেকটাই অন্তর্মুখী। তাদের নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতা আছে। তারা নিজেদের গুরুত্ব চাওয়ার প্রবণতাকে ঢেকে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে তারা অনেক বেশি অন্যের কাছ থেকে মনোযোগ চায়। এমনকি দেখা গেছে, বহুদিন ধরে সম্পর্কে থাকার পরও তাদের বোঝা যায় না। এ জন্য তারা খানিকটা বেশি বিপজ্জনক। ফলে তাদের সামাল দেওয়া কঠিন। কেননা তারা চট করে রাগ প্রকাশ করে না, চিৎকার-চেঁচামেচি বা প্রকাশ্যে বিবাদ না করেও বেশি প্রতিশোধ নিতে পারে। এ ধরনের মানুষ তাদের সত্যিকারের অনুভূতি গোপন রাখতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের লক্ষ্য বাকি সব নার্সিসিস্টের মতো। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, তারা মনে করে না যে, কিছু ভুল করছে।
তাদের মধ্যে আরেকটি প্রবণতা থাকে; যেটিকে বলা হয় প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন। অর্থাৎ তারা সরাসরি আপনাকে রাগ দেখাবে না। কিন্তু আচরণে ঠিকই বুঝিয়ে দেবে। আর এটাকে তারা ম্যানিপুলেশন করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। আপনার অজান্তেই তারা আপনার প্রতি নাশকতামূলক আচরণ করবে। অন্যদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করবে, সে আপনার জন্যই আগাতে পারছে না। কিন্তু সত্যিকারের ঘটনাটা আলাদা। সচেতনভাবে আপনাকে নিয়ে উপহাস অথবা বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করবে। এর প্রত্যুত্তরে আপনি যখন রেগে যাবেন, তখন বলবে- আপনি ভীষণ সেনসিটিভ এবং এত সংবেদনশীল হন যে, আপনার সঙ্গে সাধারণ রসিকতাও করা যায় না। খুব আলগোছে এমনভাবে আপনার ঘাড়ে দোষ চাপাবে যে আপনি নিজেই তার প্রতি আপনার আচরণের জন্য অপরাধবোধে ভুগবেন। আপনার কোনো কাজ যদি তাকে করে দিতে হয়, তাহলে সেটিতে সে ঢিলেমি করবে।
নার্সিসিজম কী: ‘নার্সিসিজম’ বলতে প্রচলিত অর্থে আত্মকেন্দ্রিক, আত্মরতি, আত্মমুগ্ধতা, আত্মমগ্নতা ইত্যাদি নানা ধরনের বাংলা শব্দ ব্যবহৃত হতে পারে। কারো কারো ব্যক্তিত্বে নার্সিসিস্টিক প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে এই প্রবণতা মারাত্মক পর্যায়ে গেলে সেটি ব্যক্তিত্বের ব্যাধিতে অর্থাৎ নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে পরিণত হয়; যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে অবাস্তব ধারণা পোষণ করেন। যেমন- মনে করেন, তিনি অতিরিক্ত গুরুত্ব ও প্রশংসার দাবিদার কিংবা সবাই তার কথা শুনতে বাধ্য ইত্যাদি। এ প্রবণতা মানুষের আন্তঃসম্পর্ক ও প্রাত্যহিক জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
‘ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডার’ পঞ্চম এডিশনে (ডিএসএম-৫) এই ব্যক্তিত্বের ব্যাধিকে ক্লাস্টার বি শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এর বিভিন্ন ধরন আছে। কোভার্ট নার্সিসিস্ট তার মধ্যে একটি।
যেসব কারণে মানুষ কোভার্ট নার্সিসিস্ট হয়: জেনেটিক কারণ; শৈশবের কোনো মনোসামাজিক ক্ষত; পারিবারিক পরিবেশ এবং লালন পালনের ধরন; ব্যক্তিত্ব ও স্বভাব; নিউরোবায়োলজি।
কিসে একজন কোভার্ট নার্সিসিস্ট উদ্দীপ্ত হয়: কেউ তাকে গুরুত্ব না দিলে; নিজে অসম্মানিত বোধ করলে; ইগোতে আঘাত লাগলে; লজ্জা অনুভব করলে; নিজের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার লোকজন আশপাশে থাকলে; অন্যদের থেকে কোনো কিছু কম পেলে: ঈর্ষা।
আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব: একজন কোভার্ট নার্সিসিস্ট জানে, কীভাবে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। এ জন্য হুলুস্থুল না করে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের দিকে অন্যের মনোযোগ টেনে নিতে চেষ্টা করে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার সঙ্গী কোভার্ট নার্সিসিস্ট: কোভার্ট নার্সিসিস্টদের কথাবার্তায় কিছু লক্ষণ পাওয়া যায়। যেমন- নিজের ভুল বা অপরাধ করার জন্য অন্যকে দায়ী করা; অন্য কেউ যে তার কাছে ঋণী, সেটি বারবার মনে করিয়ে দেওয়া; নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং সেটি প্রচার করা; অন্যকে নিয়ে উপহাস করা। তারা অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা আদায়ের জন্য বিভিন্নভাবে অন্যকে লজ্জা দেয়। ফলে আপনি যখন প্রত্যুত্তর দিতে যাবেন, তখন তারা আত্মরক্ষার বর্মের মধ্যে ঢুকে যাবে। এমনভাবে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকে যে, মনে হবে সব দোষ অন্যের।
কোভার্ট নার্সিসিস্টদের বৈশিষ্ট্য: অন্যের প্রতি সহানুভূতিবিহীন, অসংবেদনশীল; অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা ও গুরুত্ব দাবি করে; সবকিছু কুক্ষিগত করে রাখার একটি প্রবণতা থাকে; ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অন্যদের ব্যবহার করে।
কোভার্ট নার্সিসিস্ট দাম্পত্য বা রোমান্টিক সম্পর্ক কেমন: জীবনসঙ্গীর অনুভূতি, আচরণ ও চাহিদার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে না। কিন্তু বাইরে দেখাবে অন্যটা। আন্তসম্পর্কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে অন্যদের লজ্জা ও অনুশোচনায় ভুগতে বাধ্য করবে। আশা করবে অন্যরা তার যত্ন করবে, সমস্যার সমাধান করবে। অথচ সে জীবনসঙ্গীর সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে না। সে জানবে যে, তার কোন কোন আচরণে জীবনসঙ্গী বিরক্ত হচ্ছে। জেনেও ওই কাজগুলো বারবার করবে। তারা জীবনসঙ্গীর দুর্বল জায়গা বিষয়গুলোর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। মানুষের সামনে তারা চমৎকার, দয়ালু ও সহযোগিতার মনোভাবে পূর্ণ। নিজেদের তারা অতি উচ্চমাত্রার নৈতিকতাসম্পন্ন, ধীর, স্থির, শান্ত ও জনপ্রিয় মানুষ প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত থাকবে; এমনকি আপনার কাছের মানুষগুলোকেও তারা বিভ্রান্ত করবে। সোজা ভাষায়, তারা ঘরে এক, বাইরে আরেক! মুখে এক, মনে আরেক।
যেভাবে সামাল দেবেন কোভার্ট নার্সিসিস্ট সঙ্গীকে: তাদের ম্যানিপুলেটিভ আচরণকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, এটা তাদের বৈশিষ্ট্য। তারা কীভাবে, কোন প্যাটার্নে আপনার সঙ্গে ম্যানিপুলেশন করে, সেটি চিহ্নিত করুন। আপনাকে ও আপনার পরিচিতজনদের কাছে আপনাকে নিয়ে কীভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করে, সেটি চিহ্নিত করুন। আপনার কোন কোন ভয় বা লজ্জাকে সে ব্যবহার করে, এগুলো চিহ্নিত করুন। এবার এই ভয় ও লজ্জার অস্ত্রটিও নিজের হাতে নিয়ে নিন। কোন কোন জায়গায় তারা আপনার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করুন। অন্যের সামনে আপনার আচরণ বদলে ফেলুন, যেগুলোকে সে ব্যবহার করত আপনার বিরুদ্ধে। তারা সবকিছুতে যেন আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন। তাদের সঙ্গে আচরণের নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করুন। তাদের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। অন্যের প্রত্যয়ী দৃষ্টি তারা সহ্য করতে পারে না।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ