প্রত্যাশা ডেস্ক: বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের পথ ধরে সংগীতে আসেননি তার দুই সন্তান। ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন ছেলেমেয়েরা। কেন তারা গানের জগতে নেই, সেই কারণ জানিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন।
সাবিনা ইয়াসমিনের দীর্ঘ সংগীত জীবন, সংগ্রাম, সাফল্য এবং স্মৃতিকথায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষ ডকুফিল্ম ‘জুঁই ফুল: সাবিনা ইয়াসমীন’। গত ৪ সেপ্টেম্বর এই গায়িকার ৭১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আগের দিন ডকুফিল্মটি চ্যানেল আইয়ে প্রচার হয়।
সেই ডকুফিল্মের কিছু ছোট ছোট ভিডিও ফেসবুকে ঘুরছে। তেমনই একটি ভিডিওতে সন্তানরা কেন গানে আসেননি-তা নিয়ে কথা বলেছেন সাবিনা ইয়াসমিন।
সাবিনা বলেছেন তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। মেয়ে ফায়রুজ বাঁধন থাকেন দেশে, কাজ করেন একটি ব্যাংকে। শিল্পী বলেন, সে টুকটাক গান করে, তেমন গায় না। সময় পায় না বলে গান করে না।
আর লন্ডন প্রবাসী ছেলে মো. রাফি হোসেন শ্রাবণ দেশে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকেন বলে জানিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, শ্রাবণও চাকরি নিয়েই ব্যস্ত।
‘জুঁই ফুল: সাবিনা ইয়াসমীন’ ডকুফিল্মটি তৈরি করেছেন চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। সেখানে তিনি সাবিনা ইয়াসমিনের কাছে জানতে চেয়েছেন তার ছেলেমেয়ে কেন সংগীতে আসেননি।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘কী জানি কেন আসেনি তবে খেয়াল করেছি যে, পৃথিবীতে বেশিরভাগ সেলিব্রেটি বাবা-মায়ের সন্তানরা কিন্তু কম এসেছে মিডিয়ায়। তারা হয়তো বাবা-মার জীবনটাকে দেখে যে মিডিয়া এত কষ্টের।’
এদিকে ভিডিও বার্তায় মায়ের গানের এই ক্যারিয়ারের দীর্ঘ যাত্রার প্রতি শুভকামনা জানিয়ে ছেলে শ্রাবণ বলেন, ‘আমি অনেক ভাগ্যবান এমন মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়ায়। তিনি আমাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছেন, সারাজীবন আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছেন। তিনি আমাদের কিছু নিয়মের মধ্যে বড় করেছেন। ধন্যবাদ মা, আমরা তোমাকে ভালোবাসি এবং অনেক অনেক যুগ ধরে তুমি তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে আগাতে থাকো।’
শিশুকাল থেকেই এক সাংস্কৃতিক পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন কিংবদন্তী শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। মা মৌলুদা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী এবং গানও গাইতেন। সাবিনা ইয়াসমিনের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। সাবিনারা পাঁচ বোন, ভাই নেই; চার বোনই সংগীত শিল্পী।
সাবিনা ইয়াসমিন এর আগে বলেছিলেন, সংগীতে হাতেখড়ি তার মায়ের কাছে। বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন এবং মেজ বোন ফওজিয়া খান যখন একটু বড় হলো তখন তারা ওস্তাদ দূর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন। এ সময় সাবিনা ইয়াসমিন এবং নিলুফার ইয়াসমিন চুপচাপ পাশে বসে শুনতেন। এর কয়েক বছর পর সাবিনা ইয়াসমিন এবং নিলুফার ইয়াসমিন ওস্তাদ পি সি গোমেজের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন। সে সময় ফরিদা ইয়াসমিন এবং ফওজিয়া খান সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। সেজ বোন নাজমা ইয়াসমিন একজন শিক্ষাবিদ এবং সংগীতবোদ্ধা।
মাত্র ৬ বছর বয়সে সাবিনা ইয়াসমিন ‘অল পাকিস্তান স্কুল মিউজিক কম্পিটিশানে’ গান গেয়ে প্রথম পুরস্কারটি জিতে নেন। এরপর একে একে বিভিন্ন সিনেমায় শিশু শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন।
১৯৬৭ সালে জহির রায়হান পরিচালিত এবং আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমিন প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন।
সাবিনা ইয়াসমিন এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের মতো গান রেকর্ড করেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই চলচ্চিত্রের গান। এ ছাড়াও রয়েছে আধুনিক বাংলা গান, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত ও গজলসহ বিভিন্ন ধরনের গান। আরো গেয়েছেন বেতার এবং টেলিভিশনে। তার গাওয়া প্রচুর দেশের গান আছে।
১৯৭১ সালে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া আজাদ রহমানের সুরে এবং নাইম গওহরের কথায় ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম প্রেরণা যুগিয়েছে। পরবর্তীতে তার গাওয়া দেশের গানগুলি বাংলাদেশিদের এবং বিদেশে বাঙালিদেরকে আবেগে আপ্লুত করেছে।
১৯৭৪ সালে লতা মঙ্গেশকর, শচীন দেব বর্মন, রাহুল দেব বর্মন, কানন দেবি, সত্যজিত রায় এবং রাজকাপুর তার গান শুনে ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৮০ সালে পাকিস্তানের স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক খলিল আহমেদ সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে ১০টি গানের একটি গীত এবং গজলের অ্যালবাম রেকর্ড করান। যেটা পাকিস্তানে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
এরপর আর ডি বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্য সাহা, সুবল দাস, আলম খান, বাপ্পি লাহিড়ী, আলী হোসেন, খন্দকার নুরুল আলম, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো সুরকারদের সুরে অসংখ্য চলচ্চিত্রের গান কণ্ঠে তুলেছেন তিনি। সহশিল্পী হিসেবে কিশোর কুমার, কুমার শানু, আশা ভোঁসলে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীকে পেয়েছেন সাবিনা।
গীতিকার নয়ীম গহরের লেখা ও সুরকার আজাদ রহমানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া দেশাত্মবোধক গান ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। নজরুল ইসলাম বাবুর কথায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে সাবিনার কণ্ঠে অমর হয়েছে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’গানটি।
তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় সংগীত পরিবেশন করতে পারেন। এর মধ্যে চায়নিজ, জাপানি, থাই, মালয়েশিয়ান, নেপালী, উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবী, পশতু এবং ইংরেজি ভাষা আছে।
১৯৮৩ সালে সাবিনা ইয়াসমিনকে ভারতের বিশ্ব উন্নয়ন সংসদ ‘সংসদ রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং ১৯৮৫ সালে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। সংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ও ১৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এই শিল্পী। [সূত্র: বিডিনিউজ]
সানা/আপ্র/১০/০৯/২০২৫