অর্থনৈতিক ডেস্ক: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে সারাদেশ। সরকার পতনের পর সম্পর্কের অবনতি হয় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে। এর প্রভাব পড়েছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমেও। গত অর্থবছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ২১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা ১২ হাজার টাকা। ১ হাজার ১২২ কোটি ৪১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৯০৭ কোটি ৮০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
বন্দর সংশ্লিষ্টদের দাবি, অর্থবছরের শুরুতেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি, সরকার পতন, ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি এবং ফল, কৃষিপণ্য, পাথর ও অধিক শুল্কযুক্ত পণ্যের আমদানি কমায় রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। এছাড়াও গত কয়েক বছর ধরে কমেছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। ফলে টানা তিন বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে শূন্যের কোঠায় নেমেছে ফল আমদানি। এছাড়াও কমেছে কৃষিপণ্য, গোখাদ্য ও পাথর আমদানি। পুরো অর্থবছরজুড়েই ছিল অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এমনকি দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি, ডলার সংকটে চাহিদামতো পণ্যের অর্ডার দিতে না পারা, ব্যবসায়ীদের ভিসা না দেওয়া ও অবকাঠামোগত সমস্যায় সোনামসজিদ স্থলবন্দরে গতি কমেছে আমদানি-রফতানিতে। এমনকি পাথর ছাড়া অন্য পণ্য আমদানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম বলছেন আমদানিকারকরা।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ দশমিক ১২ শতাংশ রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। এরমধ্যে পুরো অর্থবছরে শুধু মে মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পেরেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বাকি ১১ মাসেই ঘাটতি ছিল।
আমদানিকারক তরিকুল ইসলাম বলেন, ডলার সংকট থাকায় এলসি করতে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে বিগত অর্থবছরে৷ এছাড়াও দুই দেশের সরকারের মধ্যেও সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্য স্বাভাবিক ছিল না। তবে ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে। আশা করা যায়, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় গেলে আবারও আগের মতো আমদানি-রফতানিতে গতি ফিরবে।
এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, বর্তমানে শুধু পাথরের স্থলবন্দরে পরিণত হয়েছে সোনামসজিদ স্থলবন্দর। কারণ এখানকার কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের অসহযোগিতার কারণে এই স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করতে চাই না আমদানিকারকরা। এছাড়াও অবকাঠামোগত সমস্যা ও সড়কের অবস্থা ভালো না হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক ধস নেমেছে। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য আহ্বান জানালেও তাতে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এছাড়াও সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপ, সিঅ্যান্ডএফ, শ্রমিক সংগঠন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের একে অপরের সাথে সমন্বয় নেই। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমপি ও নেতাদের প্রভাব বিস্তার ও চাঁদাবাজির কারণেও সকল সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সোনামসজিদ স্থলবন্দর।
আমদানিকারক মো. আরিফুর রহমান বলেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের ঠিকমতো এলসি দিতে পারেনি। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ছাড়া যেসব পণ্যের ওপর অধিক শুল্ক রয়েছে এমন পণ্যের কোনো এলসি দিতে পারেনি ব্যাংক। যার কারণে ওসব পণ্য বন্দর দিয়ে তেমন একটা আমদানি হয়নি। যার কারণে বন্দর থেকে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
বর্তমান সরকারের আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগের কারণে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে বলে দাবি কাস্টমস কর্মকর্তাদের। সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নুরুল হাসান জানান, আলু, পেঁয়াজ ও গুড়সহ কৃষিপণ্য না আসায় রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ। এছাড়াও রাজস্ব আদায় বেশি হওয়া মানে আমাদের দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাওয়া। এবছর দেশে বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আলুসহ নিত্যপণ্যের দাম নাগালের মধ্যে ছিল। ফলে তা আমদানির প্রয়োজন পড়েনি। এতেই রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬৩ কোটি ৬৭ লাখ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪১৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয় ৬১৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর আগে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৪২ কোটি ৩১ লাখ টাকা ও ২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছিল।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ