ঢাকা ০৭:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা বেহাল

  • আপডেট সময় : ০৮:৩০:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ অগাস্ট ২০২১
  • ৯৩ বার পড়া হয়েছে

চিররঞ্জন সরকার : ‘মিস্টার হোমস, এমন কোনও বিষয় আছে যা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, ওই রাত্রে কুকুরটার অদ্ভুত ব্যবহার।’
‘কিন্তু কুকুরটা তো ওই রাতে কিছুই করেনি।’
‘ওইটাই তো অদ্ভুত।’
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল–এর সেই বিখ্যাত গল্প ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব সিলভার ব্লেজ‘-এর উল্লিখিত কথোপকথনটিতে গোয়েন্দা শার্লক হোমস চুরির সময় পোষা কুকুরের চুপ করে থাকাটাকে রহস্যের অন্যতম সূত্র মনে করেছিলেন। আমাদের জীবনেও অনেক সময়েই এমন কিছু বিপদ আসে যার জন্য কোনও বিপদঘণ্টি কোথাও বেজে ওঠে না। ফলে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়, নিঃশব্দে। অর্থনীতিতে এই ক্ষতিকে সুযোগ ব্যয় বা ‘অপরচুনিটি কস্ট’ বলে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গল্পের কুকুরটির মতো নীরব থাকে।

করোনা–সংকটেও এ রকম আড়ালে এবং নিঃশব্দে একটা ক্ষতি হয়ে চলেছে। ছোটখাটো ব্যতিক্রম ছাড়া এর কোনও হিসাব কেউ কোথায় রাখছে বলে মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ, পাহারাদাররা নিরব, এবং তার জন্যই হয়তো গল্পের পুলিশের মতো আমরাও কোথাও কিছু অস্বাভাবিক দেখছি না। অথচ দেশের মানবসম্পদের ওপর এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

কী সেই ক্ষতি? কোভিড–চিকিৎসা এবং বিধিনিষেধের ফলে অসংখ্য মানুষ, যাদের কঠিন এবং ক্রনিক বা নন–কোভিড রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত হাসপাতাল বা ডাক্তারখানায় যেতে হয়, তারা সীমাহীন দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। আমাদের চিকিৎসা–সামর্থ্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শুধু করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের জন্য পৃথক হয়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মোট সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। অথচ কোভিডের পাশাপাশি মানুষ আরও নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বড় হাসপাতালে বর্তমানে করোনা-বহির্ভুত (অন্য রোগে আক্রান্ত) রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তারা যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আমাদের দেশের মানুষ বর্তমানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। করোনাভাইরাস রোগী ও তাদের স্বজনরা অক্সিজেন–আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) পেতে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন। আছে শয্যা ও চিকিৎসক সংকটও। ঢাকার বাইরের অনেক হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন। সব মিলিয়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতেই মহাব্যস্ত সময় পার করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্য রোগীদের বলা হচ্ছে– “আগে করোনা টেস্ট, করে আসুন, এরপর অন্য রোগের চিকিৎসা!” অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধেই এখন এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।

কোভিডের ভয়ে যখন পুরো দেশ আতঙ্কে, তখন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও। গত ছয় মাসে যে পরিমাণ আক্রান্ত ছিল, সেটি গত ১৫ দিনে তা কয়েকগুণ হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা নিতে গিয়ে এসব রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর সুষ্ঠু কোনো প্রতিকার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে যে পরিমাণ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক জনবল থাকার কথা, সে তুলনায় প্রায় এক–পঞ্চমাংশেরও বেশি পদে জনবল ঘাটতি রয়েছে। বৈশ্বিক মানদ- অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, কিন্তু বাংলাদেশে আছে মাত্র ৯ জন। এখন তাদের একটা অংশকে কোভিড মহামারী মোকাবিলার কাজে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে; তাদের মধ্যে আবার অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে হোম কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনে থাকছেন। ফলে চিকিৎসা কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে।

এ দেশের মোট হাসপাতাল শয্যার ৬৪ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালের। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকটে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য নয়। শুধু তাই নয়, কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চেম্বার চিকিৎসা সীমিত করেছে, বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সাধারণ রোগীরা বেসরকারি খাতের চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। যেসব ধনী লোক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়, এখন তাদের সেই সুযোগ নেই। ফলে তারা ভিড় জমাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। এতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার সুযোগ আরও কমে যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে ‘নন–কোভিড’ বা সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ ব্যাপকভাবে সঙ্কোচিত হয়েছে; তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়েছে। বিশেষত হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, পক্ষাঘাত, হাঁপানি–শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনির রোগ, ইত্যাদি মেয়াদি রোগব্যাধিতে যারা ভুগছেন, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়েছে। গর্ভবতী নারী, প্রসূতি ও শিশুদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেড়েছে।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং সাধারণ রোগী সবাইকেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে। পজিটিভ সার্টিফিকেট হাতে না থাকায় করোনাভাইরাস আক্রান্তরা যেমন সংক্রমণের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না, তেমনি কোভিড আক্রান্ত নন, এমন রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে রোগীরা ভর্তি হতে পারছেন না। এমনকি ঘুরে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা দিতে অনীহা দেখালে এবং এতে রোগীর মৃত্যু হলে তা ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ অর্থাৎ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে বলেছে হাই কোর্ট।

অন্যদিকে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনাও দিয়েছে। তবুও কোনো কাজ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, “সব বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিকে সন্দেহভাজন কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। জরুরী চিকিৎসার জন্য আসা কোনও রোগীকে ফেরত দেওয়া যাবে না। দেশের কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে উল্লিখিত নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধান অনুসারে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” তবে এই নির্দেশনাও কেউ মানছে না।

গত কয়েক মাসে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। করোনারোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে। আবার সংক্রমণের ভয়ে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে আসতে চাইছেন না। আবার, আসতে চাইলেও দফায় দফায় গণপরিবহন বন্ধ থাকায় হাসপাতালে পৌঁছানো অনেকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লকডাউনের ফলে আর্থিক দুর্দশা। এ সময়ের মধ্যে যে মানুষটি সদ্য কাজ হারিয়েছেন বা যার ব্যবসা লাটে উঠেছে, তারা কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করে চিকিৎসার বোঝা বইতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

আমাদের স্বাস্থ্যখাত গত দেড় বছরে তেমন কোনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। করোনাভাইরাস সামলাতে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর যতটুকু সামর্থ্য, সেটুকুও যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়নি। পরিকল্পনার অভাব, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা, দীর্ঘদিন ধরে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও উপযুক্ত প্রণোদনার ঘাটতি, উপেক্ষা, খামখেয়ালিপনা ইত্যাদির খেসারত দিতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠিকে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য–ব্যবস্থা এমনিতেই অজস্র রোগব্যাধির চাপে ভঙ্গুর। এখন করোনার চাপে তা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পেয়ে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে রোগী যেমন মারা যাচ্ছে, অন্য রোগে আক্রান্তরাও সমপরিমাণ মারা যাচ্ছেন। করোনার জন্য যদি দেশে মা ও শিশুর জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যহত হয়, অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসাসেবা না পায় তাহলে আগামী দিনে দেশের হাজার মানুষ মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে সব ধরনের অসুস্থ মানুষের স্বাভাবিক চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থাটি পুনরুদ্ধার করতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন। এজন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে জনবল অনেক বাড়াতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ৭ হাজার জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। সংখ্যাটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের জনবলের ঘাটতি অনেক বেশি। একইসঙ্গে জনবলের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোন হটলাইনের পাশাপাশি টেলিমেডিসিন ব্যবস্থার প্রসার, ভিডিও কলিং সেবা সহজলভ্য করা দরকার।

করোনা সংকটকালে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য আরও সক্রিয় করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি থাকা উচিত। সাধারণ রোগীদের যেকোনো হাসপাতালে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ সুরক্ষা অবলম্বন করতে হবে; চিকিৎসা নেওয়ার সময় রোগীর কোভিড–১৯–এর উপসর্গ থাকলে তা গোপন করা চলবে না।

সবচেয়ে বড় কথা, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর রোগীদের কাছ থেকে লাগামহীন বিল করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। বেসরকারি হাপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্রেফ ‘ডাকাতি’ করে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অতিরিক্ত ভাড়া-ফি, নানা ধরনের খাত দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা বিল করায় অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যান। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা উন্নত ও বিস্তৃত করার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের ইচ্ছেমতো বিল করার চলমান ধারার বিরুদ্ধেও কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসার সম্ভাব্য ব্যয়গুলো (যেমন, কোন টেস্ট কত টাকা, কোন অপারেশনে কত টাকা, ডাক্তারের ফি, সিট ভাড়া, ওটি চার্জ ইত্যাদি) সরকারিভাবে ধার্য করে দেওয়া যেতে পারে, যা প্রতিটি হাসপাতাল ক্লিনিকে টাঙানো এবং সে অনুযায়ী বিল করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা বেহাল

আপডেট সময় : ০৮:৩০:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ অগাস্ট ২০২১

চিররঞ্জন সরকার : ‘মিস্টার হোমস, এমন কোনও বিষয় আছে যা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, ওই রাত্রে কুকুরটার অদ্ভুত ব্যবহার।’
‘কিন্তু কুকুরটা তো ওই রাতে কিছুই করেনি।’
‘ওইটাই তো অদ্ভুত।’
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল–এর সেই বিখ্যাত গল্প ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব সিলভার ব্লেজ‘-এর উল্লিখিত কথোপকথনটিতে গোয়েন্দা শার্লক হোমস চুরির সময় পোষা কুকুরের চুপ করে থাকাটাকে রহস্যের অন্যতম সূত্র মনে করেছিলেন। আমাদের জীবনেও অনেক সময়েই এমন কিছু বিপদ আসে যার জন্য কোনও বিপদঘণ্টি কোথাও বেজে ওঠে না। ফলে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়, নিঃশব্দে। অর্থনীতিতে এই ক্ষতিকে সুযোগ ব্যয় বা ‘অপরচুনিটি কস্ট’ বলে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গল্পের কুকুরটির মতো নীরব থাকে।

করোনা–সংকটেও এ রকম আড়ালে এবং নিঃশব্দে একটা ক্ষতি হয়ে চলেছে। ছোটখাটো ব্যতিক্রম ছাড়া এর কোনও হিসাব কেউ কোথায় রাখছে বলে মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ, পাহারাদাররা নিরব, এবং তার জন্যই হয়তো গল্পের পুলিশের মতো আমরাও কোথাও কিছু অস্বাভাবিক দেখছি না। অথচ দেশের মানবসম্পদের ওপর এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

কী সেই ক্ষতি? কোভিড–চিকিৎসা এবং বিধিনিষেধের ফলে অসংখ্য মানুষ, যাদের কঠিন এবং ক্রনিক বা নন–কোভিড রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত হাসপাতাল বা ডাক্তারখানায় যেতে হয়, তারা সীমাহীন দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। আমাদের চিকিৎসা–সামর্থ্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শুধু করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের জন্য পৃথক হয়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মোট সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। অথচ কোভিডের পাশাপাশি মানুষ আরও নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বড় হাসপাতালে বর্তমানে করোনা-বহির্ভুত (অন্য রোগে আক্রান্ত) রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তারা যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আমাদের দেশের মানুষ বর্তমানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। করোনাভাইরাস রোগী ও তাদের স্বজনরা অক্সিজেন–আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) পেতে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন। আছে শয্যা ও চিকিৎসক সংকটও। ঢাকার বাইরের অনেক হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন। সব মিলিয়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতেই মহাব্যস্ত সময় পার করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্য রোগীদের বলা হচ্ছে– “আগে করোনা টেস্ট, করে আসুন, এরপর অন্য রোগের চিকিৎসা!” অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধেই এখন এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।

কোভিডের ভয়ে যখন পুরো দেশ আতঙ্কে, তখন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও। গত ছয় মাসে যে পরিমাণ আক্রান্ত ছিল, সেটি গত ১৫ দিনে তা কয়েকগুণ হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা নিতে গিয়ে এসব রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর সুষ্ঠু কোনো প্রতিকার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে যে পরিমাণ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক জনবল থাকার কথা, সে তুলনায় প্রায় এক–পঞ্চমাংশেরও বেশি পদে জনবল ঘাটতি রয়েছে। বৈশ্বিক মানদ- অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, কিন্তু বাংলাদেশে আছে মাত্র ৯ জন। এখন তাদের একটা অংশকে কোভিড মহামারী মোকাবিলার কাজে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে; তাদের মধ্যে আবার অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে হোম কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনে থাকছেন। ফলে চিকিৎসা কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে।

এ দেশের মোট হাসপাতাল শয্যার ৬৪ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালের। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকটে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য নয়। শুধু তাই নয়, কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চেম্বার চিকিৎসা সীমিত করেছে, বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সাধারণ রোগীরা বেসরকারি খাতের চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। যেসব ধনী লোক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়, এখন তাদের সেই সুযোগ নেই। ফলে তারা ভিড় জমাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। এতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার সুযোগ আরও কমে যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে ‘নন–কোভিড’ বা সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ ব্যাপকভাবে সঙ্কোচিত হয়েছে; তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়েছে। বিশেষত হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, পক্ষাঘাত, হাঁপানি–শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনির রোগ, ইত্যাদি মেয়াদি রোগব্যাধিতে যারা ভুগছেন, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়েছে। গর্ভবতী নারী, প্রসূতি ও শিশুদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বেড়েছে।

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং সাধারণ রোগী সবাইকেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে। পজিটিভ সার্টিফিকেট হাতে না থাকায় করোনাভাইরাস আক্রান্তরা যেমন সংক্রমণের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না, তেমনি কোভিড আক্রান্ত নন, এমন রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে রোগীরা ভর্তি হতে পারছেন না। এমনকি ঘুরে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা দিতে অনীহা দেখালে এবং এতে রোগীর মৃত্যু হলে তা ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ অর্থাৎ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে বলেছে হাই কোর্ট।

অন্যদিকে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনাও দিয়েছে। তবুও কোনো কাজ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, “সব বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিকে সন্দেহভাজন কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। জরুরী চিকিৎসার জন্য আসা কোনও রোগীকে ফেরত দেওয়া যাবে না। দেশের কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে উল্লিখিত নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধান অনুসারে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” তবে এই নির্দেশনাও কেউ মানছে না।

গত কয়েক মাসে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই এলোমেলো হয়ে গেছে। করোনারোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে। আবার সংক্রমণের ভয়ে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে আসতে চাইছেন না। আবার, আসতে চাইলেও দফায় দফায় গণপরিবহন বন্ধ থাকায় হাসপাতালে পৌঁছানো অনেকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লকডাউনের ফলে আর্থিক দুর্দশা। এ সময়ের মধ্যে যে মানুষটি সদ্য কাজ হারিয়েছেন বা যার ব্যবসা লাটে উঠেছে, তারা কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করে চিকিৎসার বোঝা বইতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

আমাদের স্বাস্থ্যখাত গত দেড় বছরে তেমন কোনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। করোনাভাইরাস সামলাতে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর যতটুকু সামর্থ্য, সেটুকুও যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়নি। পরিকল্পনার অভাব, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা, দীর্ঘদিন ধরে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও উপযুক্ত প্রণোদনার ঘাটতি, উপেক্ষা, খামখেয়ালিপনা ইত্যাদির খেসারত দিতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠিকে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য–ব্যবস্থা এমনিতেই অজস্র রোগব্যাধির চাপে ভঙ্গুর। এখন করোনার চাপে তা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পেয়ে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে রোগী যেমন মারা যাচ্ছে, অন্য রোগে আক্রান্তরাও সমপরিমাণ মারা যাচ্ছেন। করোনার জন্য যদি দেশে মা ও শিশুর জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যহত হয়, অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসাসেবা না পায় তাহলে আগামী দিনে দেশের হাজার মানুষ মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে সব ধরনের অসুস্থ মানুষের স্বাভাবিক চিকিৎসার নিশ্চিত ব্যবস্থাটি পুনরুদ্ধার করতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন। এজন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে জনবল অনেক বাড়াতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ৭ হাজার জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। সংখ্যাটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের জনবলের ঘাটতি অনেক বেশি। একইসঙ্গে জনবলের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোন হটলাইনের পাশাপাশি টেলিমেডিসিন ব্যবস্থার প্রসার, ভিডিও কলিং সেবা সহজলভ্য করা দরকার।

করোনা সংকটকালে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য আরও সক্রিয় করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি থাকা উচিত। সাধারণ রোগীদের যেকোনো হাসপাতালে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ সুরক্ষা অবলম্বন করতে হবে; চিকিৎসা নেওয়ার সময় রোগীর কোভিড–১৯–এর উপসর্গ থাকলে তা গোপন করা চলবে না।

সবচেয়ে বড় কথা, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর রোগীদের কাছ থেকে লাগামহীন বিল করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। বেসরকারি হাপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্রেফ ‘ডাকাতি’ করে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অতিরিক্ত ভাড়া-ফি, নানা ধরনের খাত দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা বিল করায় অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যান। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা উন্নত ও বিস্তৃত করার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের ইচ্ছেমতো বিল করার চলমান ধারার বিরুদ্ধেও কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসার সম্ভাব্য ব্যয়গুলো (যেমন, কোন টেস্ট কত টাকা, কোন অপারেশনে কত টাকা, ডাক্তারের ফি, সিট ভাড়া, ওটি চার্জ ইত্যাদি) সরকারিভাবে ধার্য করে দেওয়া যেতে পারে, যা প্রতিটি হাসপাতাল ক্লিনিকে টাঙানো এবং সে অনুযায়ী বিল করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট।