নিজস্ব প্রতিবেদক : ইয়াবা পাচারের সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মরণনেশা ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান এমফিটামিন। মিয়ানমারভিত্তিক কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্র আন্তর্জাতিক ড্রাগ রুট নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা শুধু বাংলাদেশ নয়- ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক পাচারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর নেশা ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন বা এমফিটামিনের যোগান আসে মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। মাদকের রাজধানী হিসেবে পরিচিত সান স্টেট থেকেই এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস এবং থাইল্যান্ডে এমফিটামিনের যোগান আসে। যার মধ্যে সান স্টেট-মান্দালে হয়ে সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশ আসছে ইয়াবা কিংবা এমফিটামিন। সান স্টেট থেকে ইয়াবা তুয়াঙ্গী-ইয়াঙ্গুন হয়ে নৌপথে সিত্তেই (মিয়ানমার) হয়ে বাংলাদেশের মহেশখালী আসছে। একইভাবে সিত্তেই রুট ব্যবহার করে বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় যায় ইয়াবার চালান। ইয়াবার অপর রুট হচ্ছে মান্দালে-তুয়াঙ্গী-মাগওয়ে-মিনবু-পাদান-সিত্তেই-মংডু হয়ে টেকনাফ। ইয়াবার কিছু কিছু চালান ভারত হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ রুটগুলো মধ্যে আছে মান্দালে-সাগাইং অঞ্চল-মনেয়া-কালে-মোরে (মনিপুর)-আইজল (মিজোরাম)-পানিসাগর-শিলং-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত। শিলং-লিশিগুড়ি-মালদা হয়ে যশোর এবং সাতক্ষীরার তিনটি রুট ব্যবহার করে মাফিয়ারা। সান স্টেট থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত মিয়ানমারভিত্তিক সাতটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। যার মধ্যে রয়েছে-সান স্টেটভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, ইউনাইটেড স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউসিএ), আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া বাহিনীসহ কয়েকটি চক্র।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে, সান স্টেট থেকে প্রতি বছর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, হেরোইনসহ নানান ধরনের মাদক পাচার হয়। যার বার্ষিক বাজার মূল্য ৬১ বিলিয়ন ডলার। ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট-২০২১ অনুযায়ী গত এক বছরে বাংলাদেশে ২৭৪০ কেজি মেথ, ৩২৩ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। মিয়ানমারে ১৯ হাজার ২১১ কেজি মেথ, ৬৯০ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। ভারতে ১৬২৫ কেজি মেথ, ১৪৯ কেজি এমফিটামিন, ৩২৩১ কেজি হেরোইন, চীনে ২৫ হাজার ১০২ কেজি মেথ, ৬ হাজার ১৩৬ কেজি হেরোইন, থাইল্যা-ে ৫৩ হাজার ১৯৩ কেজি মেথ এবং ৭২৩ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, জব্দ করা এসব মাদকের সিংহভাগেরই উৎস ছিল মিয়ানমারের সান স্টেট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, ইউরোপ-এশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে দেশের বিমানবন্দরকে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারীরা। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। বিমানবন্দর দিয়ে বিভিন্ন প্যাকেটের আড়ালে পাচার হচ্ছে ইয়াবার চালান। বাংলাদেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের সময় কিছু চালান আটকও করা হয়েছে। গত ২৬ মে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে আসা এলএসডির ২০০টি ব্লক আটক করা হয়। ডাক বিভাগের ঢাকা জিপিওতে যুক্তরাষ্ট্রগামী ২ হাজার ৪০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে, কুখ্যাত সংঘবদ্ধ ট্রান্সন্যাশনাল মাদক অপরাধ চক্র ‘ ঝযধস এড়ৎ ’ বা ‘ ঞযব ঈড়সঢ়ধহু ’ সহ অন্যান্য চক্র এবং মিয়ানমার সরকারের পক্ষ-বিপক্ষে থাকা বিভিন্ন জাতিগত দল ও গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে ইয়াবা এবং ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদন ও পাচার করে। তারা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ইয়াবা পাচার করে। মূলত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বা মেকং অঞ্চলের মিয়ানমারের শান স্টেট থেকে ইয়াবা বা ক্রিস্টাল মেথ বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের বিনা বাধায় চলে আসছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মাদকগুলোর কাস্টমার বিদেশি নাগরিক নয়, আমাদের দেশের নাগরিকের জন্য মাদকগুলো আসছে। যুবসমাজ মাদক সেবন করছে। এই মাদক সেবনকারীদের অন্যদিকে ধাবিত করতে পারলে আমাদের পরিবার ও সমাজ রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদকাসক্তির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব দেশে মাদক উৎপাদিত হয় সেসব দেশের চক্রের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থিত। যেমন: দক্ষিণ-পূর্বে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও লাওসে পপিগাছ (আফিম) উৎপন্ন হয়। আবার উত্তর-পশ্চিমে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান। ফলে এতদঞ্চলের মাদক ব্যবসার প্রভাব বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে। এ জন্য সরকারের প্রচেষ্টাও যেমন আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শক্তিশালী করা জরুরি। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারে ওয়া স্টেট নামে একটি স্টেট আছে। সেখানে সাউথ ওয়া ও নর্থ ওয়ার মধ্যে মূলত নর্থ ওয়াতেই এসব মাদক উৎপাদন হয়। সেখানে মিয়ানমার সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণে আছে ‘ওয়া আর্মি’। সেখানে চায়নাদের মালিকানাও আছে। ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান এমফিটামিনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের কাঁচামালসমূহ উৎপাদন করা হয় সেখানে। বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে তারা এই মাদক বিভিন্ন দেশে পাচার করে। বাংলাদেশে বেশি পাচার হয় ইয়াবা। ইউরোপ, আমেরিকায় যায় হোয়াইট সুগার। যেগুলো বিভিন্ন দেশের বড় বড় কার্টেল গ্রুপের (সন্ত্রাসী গ্রুপের) মাধ্যমে বিক্রি হয়। এটাকে দমন করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে করতে হবে, বাংলাদেশেরও কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আছে, তাদের মাধ্যমে চাইলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয় চট্টগ্রামের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, মিয়ানমারের বিভিন্ন মিলিশিয়ার সহায়তা ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বা নি¤œ মেকং দেশগুলো থেকে মেথামফিটামিন(ক্রিস্টাল মেথ) বাংলাদেশ সহ সুদূর অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মাদক বাজারে পাচার হয়। ‘ঝধস এড়ৎ’ বা ‘ঞযব ঈড়সঢ়ধহু’ সিন্ডিকেট তার ৪০%-৭০% নিয়ন্ত্রণ করে। ঝধস এড়ৎ বা ঞযব ঈড়সঢ়ধহু এর প্রধান চি সাই লপ (ঞংব ঈযর খড়ঢ়) একজন চীন বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক। তাকে এ বছর জানুয়ারি মাসে নেদারল্যান্ড পুলিশ আটক করে। তবে তার তৈরি সিন্ডিকেট এখনও বহাল রয়েছে এবং মাদকের চাহিদা ও যোগান তারা বৃদ্ধি করেছে। ‘মিয়ানমারের মিলিশিয়াদের আয়ের অন্যতম উৎস মাদক থেকে অর্জিত অর্থ। মিয়ানমারে আফিম চাষ ও হেরোইনের উৎপাদন কমে গেছে। অপরাধীচক্র মেথামফিটামিন সহ সিনথেটিক মাদকের দিকে ঝুঁকে গেছে। কারণ এতে ঝুঁকি কম এবং লাভ বেশি। অধিকন্তু এ অঞ্চলে মেথামফিটামিনের একটি বড় বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ইয়াবা বা ক্রিস্টাল মেথ আটক করলেও এগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রিকারসর ক্যামিকেল আটক কম, এগুলোর উৎস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে চীন, থাইল্যান্ড, ভারতের ভূমিকা বেশি। এছাড়াও মাদকের অর্থ পাচারকে ট্র্যাকিং করে অপরাধীদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনী অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণে’ বলেন উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সাগর, নদী ও স্থল সীমান্ত তিনদিকেই ইয়াবা আসছে। রোহিঙ্গাদের পাচারে ব্যবহার করলেও অর্থলগ্নিকারী বাংলাদেশের নাগরিক। সাগরপথে বড় মাদকের চালান আসায় এটিকে আরও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়া সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ এটি তাদেরও সমস্যা। তবে আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমাদের জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে।
সাত রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মাদক
নিজস্ব প্রতিবেদক : ইয়াবা পাচারের সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মরণনেশা ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান এমফিটামিন। মিয়ানমারভিত্তিক কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্র আন্তর্জাতিক ড্রাগ রুট নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা শুধু বাংলাদেশ নয়- ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক পাচারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর নেশা ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন বা এমফিটামিনের যোগান আসে মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। মাদকের রাজধানী হিসেবে পরিচিত সান স্টেট থেকেই এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস এবং থাইল্যান্ডে এমফিটামিনের যোগান আসে। যার মধ্যে সান স্টেট-মান্দালে হয়ে সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশ আসছে ইয়াবা কিংবা এমফিটামিন। সান স্টেট থেকে ইয়াবা তুয়াঙ্গী-ইয়াঙ্গুন হয়ে নৌপথে সিত্তেই (মিয়ানমার) হয়ে বাংলাদেশের মহেশখালী আসছে। একইভাবে সিত্তেই রুট ব্যবহার করে বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় যায় ইয়াবার চালান। ইয়াবার অপর রুট হচ্ছে মান্দালে-তুয়াঙ্গী-মাগওয়ে-মিনবু-পাদান-সিত্তেই-মংডু হয়ে টেকনাফ। ইয়াবার কিছু কিছু চালান ভারত হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ রুটগুলো মধ্যে আছে মান্দালে-সাগাইং অঞ্চল-মনেয়া-কালে-মোরে (মনিপুর)-আইজল (মিজোরাম)-পানিসাগর-শিলং-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত। শিলং-লিশিগুড়ি-মালদা হয়ে যশোর এবং সাতক্ষীরার তিনটি রুট ব্যবহার করে মাফিয়ারা। সান স্টেট থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত মিয়ানমারভিত্তিক সাতটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। যার মধ্যে রয়েছে-সান স্টেটভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, ইউনাইটেড স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউসিএ), আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া বাহিনীসহ কয়েকটি চক্র।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে, সান স্টেট থেকে প্রতি বছর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, হেরোইনসহ নানান ধরনের মাদক পাচার হয়। যার বার্ষিক বাজার মূল্য ৬১ বিলিয়ন ডলার। ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট-২০২১ অনুযায়ী গত এক বছরে বাংলাদেশে ২৭৪০ কেজি মেথ, ৩২৩ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। মিয়ানমারে ১৯ হাজার ২১১ কেজি মেথ, ৬৯০ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। ভারতে ১৬২৫ কেজি মেথ, ১৪৯ কেজি এমফিটামিন, ৩২৩১ কেজি হেরোইন, চীনে ২৫ হাজার ১০২ কেজি মেথ, ৬ হাজার ১৩৬ কেজি হেরোইন, থাইল্যা-ে ৫৩ হাজার ১৯৩ কেজি মেথ এবং ৭২৩ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়। বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, জব্দ করা এসব মাদকের সিংহভাগেরই উৎস ছিল মিয়ানমারের সান স্টেট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, ইউরোপ-এশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে দেশের বিমানবন্দরকে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারীরা। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। বিমানবন্দর দিয়ে বিভিন্ন প্যাকেটের আড়ালে পাচার হচ্ছে ইয়াবার চালান। বাংলাদেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের সময় কিছু চালান আটকও করা হয়েছে। গত ২৬ মে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে আসা এলএসডির ২০০টি ব্লক আটক করা হয়। ডাক বিভাগের ঢাকা জিপিওতে যুক্তরাষ্ট্রগামী ২ হাজার ৪০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে, কুখ্যাত সংঘবদ্ধ ট্রান্সন্যাশনাল মাদক অপরাধ চক্র ‘ ঝযধস এড়ৎ ’ বা ‘ ঞযব ঈড়সঢ়ধহু ’ সহ অন্যান্য চক্র এবং মিয়ানমার সরকারের পক্ষ-বিপক্ষে থাকা বিভিন্ন জাতিগত দল ও গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে ইয়াবা এবং ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদন ও পাচার করে। তারা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ইয়াবা পাচার করে। মূলত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বা মেকং অঞ্চলের মিয়ানমারের শান স্টেট থেকে ইয়াবা বা ক্রিস্টাল মেথ বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের বিনা বাধায় চলে আসছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মাদকগুলোর কাস্টমার বিদেশি নাগরিক নয়, আমাদের দেশের নাগরিকের জন্য মাদকগুলো আসছে। যুবসমাজ মাদক সেবন করছে। এই মাদক সেবনকারীদের অন্যদিকে ধাবিত করতে পারলে আমাদের পরিবার ও সমাজ রক্ষা পাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদকাসক্তির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব দেশে মাদক উৎপাদিত হয় সেসব দেশের চক্রের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থিত। যেমন: দক্ষিণ-পূর্বে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও লাওসে পপিগাছ (আফিম) উৎপন্ন হয়। আবার উত্তর-পশ্চিমে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান। ফলে এতদঞ্চলের মাদক ব্যবসার প্রভাব বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে। এ জন্য সরকারের প্রচেষ্টাও যেমন আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন, তেমনি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শক্তিশালী করা জরুরি। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারে ওয়া স্টেট নামে একটি স্টেট আছে। সেখানে সাউথ ওয়া ও নর্থ ওয়ার মধ্যে মূলত নর্থ ওয়াতেই এসব মাদক উৎপাদন হয়। সেখানে মিয়ানমার সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণে আছে ‘ওয়া আর্মি’। সেখানে চায়নাদের মালিকানাও আছে। ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান এমফিটামিনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের কাঁচামালসমূহ উৎপাদন করা হয় সেখানে। বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে তারা এই মাদক বিভিন্ন দেশে পাচার করে। বাংলাদেশে বেশি পাচার হয় ইয়াবা। ইউরোপ, আমেরিকায় যায় হোয়াইট সুগার। যেগুলো বিভিন্ন দেশের বড় বড় কার্টেল গ্রুপের (সন্ত্রাসী গ্রুপের) মাধ্যমে বিক্রি হয়। এটাকে দমন করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে করতে হবে, বাংলাদেশেরও কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আছে, তাদের মাধ্যমে চাইলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয় চট্টগ্রামের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, মিয়ানমারের বিভিন্ন মিলিশিয়ার সহায়তা ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বা নি¤œ মেকং দেশগুলো থেকে মেথামফিটামিন(ক্রিস্টাল মেথ) বাংলাদেশ সহ সুদূর অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মাদক বাজারে পাচার হয়। ‘ঝধস এড়ৎ’ বা ‘ঞযব ঈড়সঢ়ধহু’ সিন্ডিকেট তার ৪০%-৭০% নিয়ন্ত্রণ করে। ঝধস এড়ৎ বা ঞযব ঈড়সঢ়ধহু এর প্রধান চি সাই লপ (ঞংব ঈযর খড়ঢ়) একজন চীন বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক। তাকে এ বছর জানুয়ারি মাসে নেদারল্যান্ড পুলিশ আটক করে। তবে তার তৈরি সিন্ডিকেট এখনও বহাল রয়েছে এবং মাদকের চাহিদা ও যোগান তারা বৃদ্ধি করেছে। ‘মিয়ানমারের মিলিশিয়াদের আয়ের অন্যতম উৎস মাদক থেকে অর্জিত অর্থ। মিয়ানমারে আফিম চাষ ও হেরোইনের উৎপাদন কমে গেছে। অপরাধীচক্র মেথামফিটামিন সহ সিনথেটিক মাদকের দিকে ঝুঁকে গেছে। কারণ এতে ঝুঁকি কম এবং লাভ বেশি। অধিকন্তু এ অঞ্চলে মেথামফিটামিনের একটি বড় বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ইয়াবা বা ক্রিস্টাল মেথ আটক করলেও এগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রিকারসর ক্যামিকেল আটক কম, এগুলোর উৎস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে চীন, থাইল্যান্ড, ভারতের ভূমিকা বেশি। এছাড়াও মাদকের অর্থ পাচারকে ট্র্যাকিং করে অপরাধীদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনী অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণে’ বলেন উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সাগর, নদী ও স্থল সীমান্ত তিনদিকেই ইয়াবা আসছে। রোহিঙ্গাদের পাচারে ব্যবহার করলেও অর্থলগ্নিকারী বাংলাদেশের নাগরিক। সাগরপথে বড় মাদকের চালান আসায় এটিকে আরও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়া সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ এটি তাদেরও সমস্যা। তবে আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমাদের জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে।
সাত রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মাদক
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ