গাজীপুর প্রতিনিধি: গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান। তিনি বলেছেন, সাংবাদিক হত্যার দায় আমরা এড়াতে পারি না। সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপর ছিল। আমরা প্রিভেন্ট করতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতা ও জনবল স্বল্পতা রয়েছে।
সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতারের পর শনিবার (৯ আগস্ট) দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায় জিএমপির সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। জিএমপি কমিশনার বলেন, প্রিভেনশন সবসময় করা যায় না। বিশ্বের কোনো দেশ ক্রাইম একেবারে শূন্যতে নিয়ে আসতে পারেনি। তাই, আমাদের শত চেষ্টার পরেও ক্রাইম হয়ে যেতে পারে। যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।
অপরাধ দমনে পুলিশকে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন করা সম্ভব হয় না। এখানে জনগণের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন হয়। এ সময় নিহত আসাদুজ্জামান তুহিনের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানান জিএমপি কমিশনার।
সংবাদ সম্মেলনে জিএমপি কমিশনার বলেন, সংঘবদ্ধ চক্রের অপরাধের চিত্র ধারণ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন সাংবাদিক তুহিন। এ ঘটনায় আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছেন, প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী আছে। সমস্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে। তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট দিতে পারব। আমরা আশা করি দ্রুত সময়ে তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সাজার সংস্কৃতি নিশ্চিত করা গেলে ক্রাইম দমন করা যাবে। আসামিরা যদি নাও স্বীকার তবে, এভিডেন্সই তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে।
তুহিন হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, সেদিন এই ঘটনার প্রথম ভিকটিম বাদশা মিয়া স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলেন। বিষয়টি দেখে তাকে ফাঁসানোর জন্য গোলাপি বাদশাকে হানি ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করেন।
গোলাপির সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে বাদশা মিয়া বিষয়টি বুঝতে পারেন, যে তাকে হানি ট্র্যাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং বাদশা মিয়া গোলাপিকে ঘুষি মারেন। সিসিটিভি ফুটেজে বিষয়টি দেখা যায়।
পুলিশ কমিশনার আরো বলেন, গোলাপিকে ঘুষি মারার পরপরই আগে থেকে ওৎপেতে থাকা গোলাপির সহযোগীরা ৫-৬ জন এগিয়ে এসে চাপাতি দিয়ে বাদশা মিয়াকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন সে ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন জানিয়ে নাজমুল করিম খান বলেন, তার ভিডিও ধারণ করার বিষয়টি আসামিরা দেখে ফেলে। তখন আসামিরা বুঝে যায় যে, এই ভিডিওর মাধ্যমে তাদের অপরাধ মানুষের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়বে। তারপরে আসামিরা সাংবাদিক তুহিনের ভিডিওটি কেড়ে নেয়ার জন্য তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায় এবং তাকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে সাংবাদিক তুহিন একটি চা স্টলে আশ্রয় নিলে তাকে সেখান থেকে ধরে এনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
কমিশনার আরো বলেন, ঘটনার পরপরই আমরা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করি। ফুটেজ দেখে আমরা আট জনকে চিহ্নিত করেছি। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িত সাতজনকে গ্রেফতার করেছি। বাকি একজনকেও দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে পারব। তিনি বলেন, সাংবাদিক হত্যা মামলায় গ্রেফতার আসামিরা হলেন- জামালপুরের মেলান্দহ থানার মাহমুদপুর এলাকার মোবারকের ছেলে মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৫), তার স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী (২৫), পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন (২৮), খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার ময়লাপোতার হানিফের ছেলে আল আমিন (২১), কুমিল্লার হোমনা থানার আন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে শাহজালাল (৩২), পাবনার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়ীয়া গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে মো. ফয়সাল হাসান (২৩) এবং সুমন নামের একজন।
গ্রেফতাররা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত জানিয়ে তিনি বলেন, হত্যার প্রধান আসামি কেটু মিজানের নামে ১৫টি মামলা রয়েছে। তার স্ত্রী গোলাপি হানি ট্র্যাপ কার্যক্রমে জড়িত। অপর আসামিদের মধ্য আল আমিনের দুটি, স্বাধীনের নামে দুটি, শাহজালালের বিরুদ্ধে আটটি, ফয়সাল হাসানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ এখনো তাদের মনোবল ফিরে পায়নি। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। গাজীপুরে ৫ আগস্টের পর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাইম বেড়ে যায়। এটা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি।
এছাড়াও আগের রেজিম এই জেলায় শক্তিশালী। সেই দলটি চায় না গাজীপুর স্থিতিশীল হোক। তারা গাজীপুরকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সেটিও নজরদারি করা হচ্ছে। এই নজরদারি করতে গিয়ে অন্যান্য অপরাধে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। তবে, মানুষের স্বস্তি ফেরাতে কাজ করছে জিএমপি। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮)। তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে। তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।
জিএমপির বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় বাসন থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলার বাদী হয়েছেন তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম। অপর একটি মামলার বাদী, তুহিন হত্যার আগে সংগঠিত আরেকটি হামলার ঘটনায় আহত বাদশা মিয়ার ভাই। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
শুক্রবার সকালে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়েছে। জুমার নামাজের পর গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার যেখানে তাকে হত্যা করা হয়, সেখানেই ঈদগাহ মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
এদিকে সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া স্বাধীন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে র্যাব। শনিবার সকাল ১১টায় গাজীপুরে পোড়াবাড়ী র্যাব-১ এর ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন কোম্পানি কমান্ডার একেএম এ মামুন খান চিশতি। তিনি বলেন, সাংবাদিক তুহিন খুনের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ ও গোপন তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে শুক্রবার রাতে গাজীপুর মহানগরের শিববাড়ি এলাকা থেকে স্বাধীনকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার স্বাধীন তুহিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাধীনকে বাসন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।