আনিস আলমগীর : প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে সোমবার, ১৭ মে ২০২১, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক উপসচিব। অভিযোগ তিনি তাদের কিছু নথি চুরি করেছেন। একজন সাংবাদিকের যেমন তথ্য নেওয়ার অধিকার আছে, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মামলা করারও অধিকার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু যে কায়দায় ঘটনাটি ঘটলো সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, লুটপাট এবং যাবতীয় কলঙ্কের মধ্যে নিকৃষ্টতম একটি ঘটনা। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা সাংবাদিকতার ওপর যেমন হামলা তেমনই আমলাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কেরও অন্তরায়। পরস্পরের সংবাদ বিনিময়ের ক্ষেত্রে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হলো। এই ঘটনায় রোজিনার দায় কতটুকু আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দায় কতটকু- সেটা এখন আদালতের বিবেচ্য বিষয়।
পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী রোজিনাকে বিকেল তিনটার দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে ওই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করেছে। ৫ ঘণ্টা পর রাত আটটার দিকে তাকে শাহবাগ থানার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাত পৌনে ১২টায় শাহবাগ থানায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় মামলা হয়েছে। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশে সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার বহু নজির অতীতে রয়েছে। সেটা স্বৈরশাসকদের আমলে যেমন ঘটেছে তেমনি গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলেও হয়েছে। কিন্তু পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্য সচিবালয়ে গিয়ে আমলা-কর্মচারিদের দ্বারা ৫ ঘণ্টা আটক থাকার ঘটনা কখনও ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এই ঘটনায় স্বাস্থ্য সেবা সচিব, তার পিএস যার কক্ষ থেকে রোজিনা নথি ‘চুরি’ করেছেন বা ছবি তুলেছেন বলা হচ্ছে সেই কর্মকর্তা, এমনকি মামলার বাদী মিডিয়ার সামনে আসেননি। আবার যখন তারা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন তখন সাংবাদিকরা তা বর্জন করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনও বিবৃতিও রোজিনাকে আদালতে তোলার আগ পর্যন্তও আমার চোখে পড়েনি। রোজিনা এখন কারাগারে।
রোজিনা একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় কাজ করেন। একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ নানা কিছু ঘটতে পারে। এটাকে পেশাগত বিড়ম্বনা জেনেই রোজিনা সাংবাদিকতায় এসেছেন। কিন্তু তাকে ৫ ঘণ্টার ওপর মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে পুলিশ দিয়ে আটকে রাখার অধিকার কর্মকর্তারা কীভাবে রাখেন! তারা যদি মনে করেন রোজিনা কোনও গর্হিত অপরাধ করেছেন তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য মন্ত্রণালয়কে জড়িত করে সমাধানের উপায় বের করতে পারতেন। কিন্তু আটক রাখার এই সংস্কৃতি তারা কোথায় পেয়েছেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতিবাজদের দখলে বলে অনেক রিপোর্ট বের হয়েছে। এখনতো মানুষ ভাববে এটি দুর্বৃত্তদেরও দখলে।
অবরুদ্ধ অবস্থায় রোজিনার সঙ্গে কারও কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে তার বেহাল অবস্থার কয়েকটি ছবি এবং ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। শাহবাগ থানায় রোজিনা ইসলামের সঙ্গে দেখা করে তার বোন সাংবাদিকদের জানান- রোজিনা সেদিনই করোনার টিকা নিয়েছেন। তার সোর্সের কাছে একটা কাগজ নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যান। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তার ব্যাগ ও মোবাইল নিয়ে নেওয়া হয়। ব্যাগ থেকে তার সোর্সের দেওয়া কাগজটা বের করে অন্য কাগজপত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় রোজিনাকে কনস্টেবল মিজান নামে একজন বলেন, আপনি অনেক রিপোর্ট করেছেন। আজকে আপনাকে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হবে। এরপর নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
আমি ধরে নিলাম রোজিনা কোনও ফাইল থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য মোবাইলে ধারণ করেছেন। মাঠের সংবাদকর্মীর অভিজ্ঞতায় এটাতো আমার কাছে একটি মামুলি বিষয় মনে হচ্ছে। এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরের নথি তো আমি সোর্স দিয়ে ফটোকপি করিয়েছি। অবশ্য কখনও নথি চুরি করিনি, তথ্য চুরি করেছি। সেই তথ্যের সত্যতা নিয়ে ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য নিয়েছি। এখনও মোবাইলে অনেক নথি ধারণ করি বা সোর্স আমাকে পাঠায়। জনম্বার্থে তথ্য ফাঁস করাইতো সাংবাদিকের কাজ।
আর রোজিনা যদি সত্যি সত্যি অনুমতি ছাড়া স্বাস্থ্য সচিবের পিএস-এর টেবিলে পড়ে থাকা নথি তার অনুপস্থিতিতে হাতিয়ে নেন- সেটা সাংবাদিক হিসেবে আমি সমর্থন করি না। এর মাধ্যমে সাংবাদিক এবং সোর্সের আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়। রোজিনার কারণে সেটা এখন সাংবাদিক-আমলা সম্পর্কের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। সাংবাদিকদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কের কর্তারা কথা বলতে অস্বস্তিতে পড়বেন। কারণ অফিসে তার শত্রুরা বড় কর্তার কান ভারী করে বলবে তিনিতো সাংবাদিকদের চা-নাস্তা খাইয়ে তথ্য পাচার করেন। রোজিনার প্রতি যে আচরণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারি-কর্মকতারা করেছেন সেটা যেমন ন্যাক্কারজনক তেমনি তিনি নথি চুরি করলে সেটাও বেআইনি। এখানে স্ব-জাতি প্রেমের সুযোগ কম।
কিন্তু কী এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল রোজিনা যা চুরি করেছেন বলা হচ্ছে? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোপণীয় তথ্য তো নয়। এই মুহূর্তে করোনার টিকা নিয়ে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির গোপনীয়তার কথা তুলতে পারেন কর্মকর্তারা। কিন্তু এই তথ্যতো জনস্বার্থে আজ না হয় কাল মিডিয়ায় আপনাকে বলতে হবে। যদি না বলার হয় তাহলেতো আপনাদের বিরুদ্ধে গোপন চুক্তির অভিযোগ আসবে। কোনও রিপোর্টার না হয় সেটা এক্সক্লুসিভ পেলো। রিপোর্টাররা কি সারা বছর আপনার ধরিয়ে দেওয়া, বস্তা পঁচা তথ্য বিবরণী ছাপার কাজ করবে! সে কারণে বেতন পাবে অফিস থেকে?
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তারা একের পর এক ফাঁস হওয়া তাদের দুর্নীতি, অযোগ্যতার তথ্যকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে চালিয়ে দিলে কি তা মানতে হবে আমাদেরকে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়তো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজ করে না। আর জাতীয় স্বার্থ কেবল আমলারাই বুঝবেন কেন! সাংবাদিকরা কি অবুঝ! যাদের হাত ধরে এই সংবাদ প্রকাশিত হবে মিডিয়ার সেই গেটকিপাররা আমলাদের থেকে দেশের স্বার্থ কম বুঝে ধরে নিবেন কেন! যদি তাই হয় মামলা করার ১০১টা অযুহাততো রাষ্ট্র আপনাদেরকে দিয়ে রেখেছে।
আমি সরকারি কর্মকর্তাদের কাজকে কখনও ছোট করে দেখি না। কিন্তু অস্বস্তিকর হলেও বলতে হচ্ছে বিগত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে রাষ্ট্রে যেভাবে আমলাতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাতে কিছু আমলা ভাবতে পারেন যে রাষ্ট্রের কল্যাণের সোল এজেন্সি তারা নিয়েছেন। করোনাকালে সরকারের ত্রাণ কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বও এমপিদের বাদ দিয়ে জেলাওয়ারি সচিব স্তরের আমলাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেও স্পষ্ট ছিল রাষ্ট্রের আমলা নির্ভরতা বা আমলাদের মাথায় তোলার বিষয়টি। অবশ্য এই তদারকির কাজটি কার্যত এমপিরও না, সচিবদেরও না। এমপির কাজ বরাদ্দপত্রের সুপারিশ করা আর মূলত জেলা প্রশাসকের কাজ এসব তদারকি করা।
দুঃখজনক হচ্ছে যে, আমাদের সংবাদকর্মী, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং পাঠকের সংবাদ পাওয়ার অধিকার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য শুধু সরকার নয়, মালিক এবং সাংবাদিক পক্ষেরও হাত রয়েছে। এই করোনাকালে ত্রাণ নয়-ছয় করা নিয়ে লিখলে সংবাদকর্মীরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন ত্রাণখোরদের হাতে। সাংবাদিক নেতারা তখন দেখে না দেখার ভান করেছেন। সাংবাদিক নির্যাতিত হলে কেন নির্যাতিত সেই খোঁজ নেওয়ার চেয়ে সে কোন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা দেখা হয় আগে। সাংবাদিক নেতারা অযোগ্যতা, রাজনৈতিক অন্ধত্ব, বিশেষ গোষ্ঠীর লাঠিয়াল হিসেবে অভিযুক্ত হচ্ছেন সাধারণ সাংবাদিকদের কাছে। রোজিনার ঘটনায় বড় কোনও নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। সংবাদপত্রে সেল্ফ সেন্সরশিপ বেড়ে গেছে। গ্রাম থেকে শহরে সাংবাদিকতার নামে দুর্বৃত্তায়ন বেড়েছে। মিথ্যা সংবাদ বেড়েছে। কেউ দেখার নেই। তথ্য নির্ভর, সৎ সাংবাদিকতা হচ্ছে না বলে সরকারও জানতে পারছে না সঠিক সংবাদ। ডিজিটাল আইনের খড়্গও ঝুলছে সাংবাদিকদের সামনে। আর তাতে দেশজুড়ে দুর্নীতিবাজরা, দুবৃত্তরা উৎসাহিত হচ্ছে।
আমার কাছে আরেকটি বিষয় আশ্চর্য লেগেছে রোজিনাকে সচিবালয়ের কক্ষে আটকের পর ৫/৬ ঘণ্টা ধরে বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিড সয়লাব হয়ে গেলেও কোনও মূলধারার মিডিয়ায় তা খবর হয়নি। এমনকি তার নিজের পত্রিকা প্রথম আলো সংবাদটি অনলাইনে প্রকাশ করতে সময় নিয়েছে সাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার আগে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্রের এই বেহাল অবস্থাকেও বিবেচনায় আনতে হবে। মূলধারার সংবাদপত্র কি তাহলে পাঠকের প্রত্যাশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? সোশ্যাল মিডিয়ার সংবাদের ওপর পূর্ণ ভরসা করাতো আরেক বিপদ, যেখানে এডিটরিয়াল জাজমেন্টের কোনও সুযোগ নেই।
আমরা মূল সংবাদ গায়েব করে দিয়ে ঘটনার শিকারকে পাল্টা অভিযুক্ত করে সংবাদ প্রকাশ করছি। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের কথা বলতে দলীয় এবং গোষ্ঠীর অনুগত সাংবাদিক নেতা নির্বাচন করছি। নিজেদের ভাগের সুবিধার জন্য সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত করেছি। দুর্বৃত্ত মিডিয়া মালিকদের সঙ্গে পোশা সাংবাদিকদের সন্ধিকে সংবাদপত্রের বাস্তবতা বলে জায়েজ করছি। অন্যদিকে, যেসব প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিক সৎ সাংবাদিকতা করছে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতার পরিবর্তে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছি- তাহলে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ আমরা ঠেকাতে পারবো কীভাবে!
মালিক-সাংবাদিকরা সংবাদের গলা চেপে ধরলে ক্ষতিটা সংবাদপত্র শিল্পের, পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার, যা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে তলানিতে আছে। আর সরকার যদি সংবাদের গলা চেপে ধরে সে ক্ষতিটা সবার আগে সরকারের। যে রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ সে রাষ্ট্রে সবার আগে সরকার পরিচালনায় জড়িতরাই তথ্য-বঞ্চিত। পৃথিবীর কোথাও সরকার প্রধানদের জন্য সরকারি সংস্থার রিপোর্ট সংবাদপত্রের রিপোর্টের পরিপূরক না। সরকারি সংস্থাও নিজেদের রিপোর্টের জন্য সংবাপদপত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার, বিরোধী দল, সব পক্ষকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদপত্রের উপরই ভরসা রাখতে হয়। সুতরাং সাংবাদিকদের গলা চেপে ধরে দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের ছাড়া কারও লাভ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।