ঢাকা ০৪:৩১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

সহিংসতার শিকার নারীর ১ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেন

  • আপডেট সময় : ১২:১৬:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১
  • ৭৪ বার পড়া হয়েছে

নারী ও শিশু ডেস্ক : বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হন বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী। বাকি জীবনটা তাঁরা পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে পার করেন। জীবনসঙ্গী দ্বারা যৌন নির্যাতনের হারও বেশি। একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ৮৩ শতাংশ নারী। জরিপে অংশগ্রহণ করেন ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীরা। যাঁদের প্রতি তিনজনের একজনই নিরক্ষর। জীবনসঙ্গী বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার এই নারীরা বিবাহবিচ্ছেদ এবং আরও নির্যাতনের ভয়ে সহজে কোনো পদক্ষেপ নিতে চান না।
জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন সহিংসতার প্রধান কারণগুলো হলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, জোরপূর্বক বিয়ে, ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা, সামাজিক সংস্কৃতি ও মানুষের মূল্যবোধ।
জরিপে দেখা যায়, মাত্র ২৯ শতাংশ নারী তাঁদের এই যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। ১৩ দশমিক ২ শতাংশ নারী এটা নিয়ে কোনো কথা বলেন না। ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ পরিজনদের কাছে শেয়ার করেন। ১ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেন, স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। প্রতিবেদনের বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পারিবারিক নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। ৮৯ শতাংশ বাল্যবিবাহের কারণ ইভটিজিং। ৮২ দশমিক ৭১ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবক ভীত হয়ে কন্যাকে বিয়ে দিয়ে দেন। অর্থনৈতিক কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হয় ৭ শতাংশ কিশোরী। ৩ শতাংশ কিশোরী পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। কিশোরী বয়সেই (১৮ বছরের নিচে) তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয় সংসারের বোঝা। স্বামীকে বন্ধু, জীবনসঙ্গী ভাবার আগেই তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এই অবস্থায় অনেক কিশোরীই স্বামী-সংসারের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে না। একদিকে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দ্বারা পারিবারিক নির্যাতন, অন্যদিকে স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতন, তারপরও সে অসহায়। কারণ, এই ঘটনার পর যখন সে তার বাবার বাড়ির আশ্রয় প্রার্থনা করে, তখন তাকে বোঝানো হয়, স্বামীর বাড়িই নিজের বাড়ি। মাটি কামড়ে সে যেন সেখানেই পড়ে থাকে। আর এভাবেই একজন কিশোরী বৃদ্ধা হওয়া পর্যন্ত মুখ বুঝে সব সহ্য করে যায়।
তার মধ্যেও অনেক নারী প্রতিবাদ করেন। যার কারণে শারীরিক নির্যাতন হয় তাঁদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবেদনে জানানো হয়, পারিবারিক ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার ২০০ নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৭৩ জনকে শারীরিক নির্যাতনের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসা নিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মনের দাগ কিন্তু থেকে যায়। সেই কালো দাগ দূর করার কথা কেউ ভাবে না।
নির্যাতন যখন অসহ্য হয়ে ওঠে, তখনই নারীরা কেবল আইনের আশ্রয় নেন। নির্যাতিত নারীদের আইনের আশ্রয় নেওয়া বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারীরা নানাভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ে ক্রমাগত নির্যাতন হতে হতে গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই যখন তাঁদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখনই তাঁরা বিচারের জন্য আসেন। অথচ প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন, সহিংসতার শিকার নারীদের আইনি সাহায্য দেওয়ার জন্য নানা সংগঠন আছে। তাঁরা সেবাটা নিতে আসেন না। সচেতন মানুষদের এই বিষয়ে তৃণমূলের নারীদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।
তৃণমূলের নারীরা ভয়াবহভাবে পারিবারিক সহিংসতার শিকার তো হনই, সমানতালে শহুরে শিক্ষিত নারীরাও এই সহিংসতাকে সঙ্গী করে জীবন যাপন করেন। জীবনসঙ্গী; শ্বশুরবাড়ি, রাস্তাঘাট, অফিসের লোকজন দ্বারা প্রতিনিয়ত তাঁরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। বহু বছর ধরে চলা এসব সহিংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনাকালীন এবং করোনা–পরবর্তী সময়ে। সেগুলো কাটিয়ে কীভাবে জাতীয়ভাবে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব, তারই দিকনির্দেশনা এই গবেষণা। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বিষয়ে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত।
নারীকে মুখ বুজে সব সহ্য না করে মুখ খুলতে হবে, সমস্যার কথাটি জানাতে হবে, তাহলেই সমাধানের পথ পাওয়া যাবে। নাগরিক জীবনে একতাবদ্ধ হয়ে সমস্যার মোকাবিলা করার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আইন, মানবাধিকার সংস্থার সাহায্যে পরবর্তী প্রজন্মের পথ সুন্দর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে ২০২১-২২ জেন্ডার বাজেটে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবা, জাতীয়ভাবে সহিংসতার ওপর নজরদারি, অতিদরিদ্র নারীদের জন্য সন্তানসম্ভবা ও প্রসূতি ভাতা প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সহিংসতার শিকার নারীর ১ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেন

আপডেট সময় : ১২:১৬:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১

নারী ও শিশু ডেস্ক : বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হন বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী। বাকি জীবনটা তাঁরা পারিবারিক নির্যাতনের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে পার করেন। জীবনসঙ্গী দ্বারা যৌন নির্যাতনের হারও বেশি। একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ৮৩ শতাংশ নারী। জরিপে অংশগ্রহণ করেন ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীরা। যাঁদের প্রতি তিনজনের একজনই নিরক্ষর। জীবনসঙ্গী বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার এই নারীরা বিবাহবিচ্ছেদ এবং আরও নির্যাতনের ভয়ে সহজে কোনো পদক্ষেপ নিতে চান না।
জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন সহিংসতার প্রধান কারণগুলো হলো পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, জোরপূর্বক বিয়ে, ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা, সামাজিক সংস্কৃতি ও মানুষের মূল্যবোধ।
জরিপে দেখা যায়, মাত্র ২৯ শতাংশ নারী তাঁদের এই যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। ১৩ দশমিক ২ শতাংশ নারী এটা নিয়ে কোনো কথা বলেন না। ৩১ দশমিক ৮ শতাংশ পরিজনদের কাছে শেয়ার করেন। ১ শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেন, স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। প্রতিবেদনের বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পারিবারিক নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। ৮৯ শতাংশ বাল্যবিবাহের কারণ ইভটিজিং। ৮২ দশমিক ৭১ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবক ভীত হয়ে কন্যাকে বিয়ে দিয়ে দেন। অর্থনৈতিক কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হয় ৭ শতাংশ কিশোরী। ৩ শতাংশ কিশোরী পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। কিশোরী বয়সেই (১৮ বছরের নিচে) তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয় সংসারের বোঝা। স্বামীকে বন্ধু, জীবনসঙ্গী ভাবার আগেই তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এই অবস্থায় অনেক কিশোরীই স্বামী-সংসারের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে না। একদিকে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দ্বারা পারিবারিক নির্যাতন, অন্যদিকে স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতন, তারপরও সে অসহায়। কারণ, এই ঘটনার পর যখন সে তার বাবার বাড়ির আশ্রয় প্রার্থনা করে, তখন তাকে বোঝানো হয়, স্বামীর বাড়িই নিজের বাড়ি। মাটি কামড়ে সে যেন সেখানেই পড়ে থাকে। আর এভাবেই একজন কিশোরী বৃদ্ধা হওয়া পর্যন্ত মুখ বুঝে সব সহ্য করে যায়।
তার মধ্যেও অনেক নারী প্রতিবাদ করেন। যার কারণে শারীরিক নির্যাতন হয় তাঁদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবেদনে জানানো হয়, পারিবারিক ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার ২০০ নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৭৩ জনকে শারীরিক নির্যাতনের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসা নিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মনের দাগ কিন্তু থেকে যায়। সেই কালো দাগ দূর করার কথা কেউ ভাবে না।
নির্যাতন যখন অসহ্য হয়ে ওঠে, তখনই নারীরা কেবল আইনের আশ্রয় নেন। নির্যাতিত নারীদের আইনের আশ্রয় নেওয়া বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারীরা নানাভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ে ক্রমাগত নির্যাতন হতে হতে গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই যখন তাঁদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখনই তাঁরা বিচারের জন্য আসেন। অথচ প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন, সহিংসতার শিকার নারীদের আইনি সাহায্য দেওয়ার জন্য নানা সংগঠন আছে। তাঁরা সেবাটা নিতে আসেন না। সচেতন মানুষদের এই বিষয়ে তৃণমূলের নারীদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।
তৃণমূলের নারীরা ভয়াবহভাবে পারিবারিক সহিংসতার শিকার তো হনই, সমানতালে শহুরে শিক্ষিত নারীরাও এই সহিংসতাকে সঙ্গী করে জীবন যাপন করেন। জীবনসঙ্গী; শ্বশুরবাড়ি, রাস্তাঘাট, অফিসের লোকজন দ্বারা প্রতিনিয়ত তাঁরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। বহু বছর ধরে চলা এসব সহিংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনাকালীন এবং করোনা–পরবর্তী সময়ে। সেগুলো কাটিয়ে কীভাবে জাতীয়ভাবে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব, তারই দিকনির্দেশনা এই গবেষণা। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বিষয়ে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত।
নারীকে মুখ বুজে সব সহ্য না করে মুখ খুলতে হবে, সমস্যার কথাটি জানাতে হবে, তাহলেই সমাধানের পথ পাওয়া যাবে। নাগরিক জীবনে একতাবদ্ধ হয়ে সমস্যার মোকাবিলা করার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আইন, মানবাধিকার সংস্থার সাহায্যে পরবর্তী প্রজন্মের পথ সুন্দর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে ২০২১-২২ জেন্ডার বাজেটে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবা, জাতীয়ভাবে সহিংসতার ওপর নজরদারি, অতিদরিদ্র নারীদের জন্য সন্তানসম্ভবা ও প্রসূতি ভাতা প্রদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।