ঢাকা ০৫:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস

সহিংসতায় থেমে যাচ্ছে কন্যাশিশুর স্বপ্ন

  • আপডেট সময় : ০৩:১৬:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: ঢাকার একটি এলাকায় বেড়ে ওঠা নবম শ্রেণির ছাত্রী রাইহানার (ছদ্মনাম) স্বপ্ন ছিল একদিন শিক্ষক হবে। কিন্তু গত জুনে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিবেশী এক যুবক ও তার সহযোগীদের হাতে সে ধর্ষণের শিকার হন। সামাজিক লজ্জা, পরিবারের চাপ ও প্রশাসনের উদাসীনতায় মাসখানেক পরই আত্মহত্যা করেন রাইহানা। ভণ্ডুল হয়ে যায় তার স্বপ্ন। পরিবারের নীরব কান্না এখনও থামেনি।

রাইহানার মতো অসংখ্য কন্যাশিশু প্রতিদিনই নীরবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কারও মর্মন্তুদ কাহিনি প্রকাশ্যে এলেও, অনেকেই থেকে যায় অন্ধকারের আড়ালে। ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, নিপীড়ন ও পারিবারিক নিপীড়নের মতো ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। সেইসঙ্গে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে কন্যাশিশুদের অরক্ষিত জীবনের গল্প।

আজ ১১ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। ‘আমি কন্যাশিশু: স্বপ্ন গড়ি, সাহসে লড়ি, দেশের কল্যাণে কাজ করি’- চলতি বছর এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে কন্যাশিশুদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা, সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা এবং দেশের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বার্তা দেওয়া হয়েছে। দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো—কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়ন, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং তাদের প্রতি সমাজে বিদ্যমান ভেদাভেদ ও বৈষম্য দূর করা।

জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে কন্যাশিশুদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়, যাতে তারা নিজের যোগ্যতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

বছর ঘুরে বাড়ছে নির্যাতন, পরিসংখ্যানে ভয়াবহ চিত্র

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রকাশিত “ভায়োলেন্স এগেইনস্ট গার্ল চিলড্রেন মনিটরিং রিপোর্ট” অনুসারে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের (জানুয়ারি-আগস্ট) মধ্যে কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে দেশে ২২৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, হত্যা ৮১টি, আত্মহত্যা ১৩৩টি। পরের বছর ২০২৪ সালে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯০টিতে, হত্যা ৮৩টি এবং আত্মহত্যা ১০৪টি। সর্বশেষ ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত কন্যাশিশু ধর্ষণের সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫৮টিতে। একই সময়ে হত্যার শিকার ৮৩টি এবং আত্মহত্যা করেছে ১০৪টি শিশু।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সংখ্যাগুলো শুধু কাগজে-কলমে থাকা পরিসংখ্যান নয়, বরং সমাজের গভীরে থাকা নারী ও শিশুবিদ্বেষের প্রতিচ্ছবি। যেসব সংখ্যা পত্র-পত্রিকায় আসছে, প্রকৃত ঘটনা তার কয়েকগুণ বেশি।

ধর্ষণ, প্রতারণা ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

২০২৫ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ২২৮টি কন্যাশিশু ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে বা প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৮টি কন্যাশিশু। ২৯ জন ছিল শারীরিকভাবে অক্ষম শিশু, যাদের ওপর এই পাশবিক নির্যাতন চলে।

২০২৪ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৩৩টি। অর্থাৎ, এক বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণের পর হত্যা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

হত্যা ও আত্মহত্যার ভয়াবহ প্রবণতা

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ৮৩টি কন্যাশিশুকে হত্যা এবং ১০৪টি আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক কলহ, যৌন নিপীড়নের পর মানসিক ট্রমা এবং প্রেমে ব্যর্থতা বা সামাজিক লজ্জার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

২০২৪ সালের তুলনায় আত্মহত্যার সংখ্যা সামান্য কমলেও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা এবং রহস্যজনক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৫ সালে ৫০ জন কন্যাশিশুর মৃত্যু রহস্যজনকভাবে ঘটেছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

পারিবারিক নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ: নিরাপদ নয় ঘরও

পারিবারিক নির্যাতন কন্যাশিশুর জন্য বড় এক ঝুঁকির জায়গা হয়ে উঠছে। ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে ১৯ জন কন্যাশিশু নিজ পরিবারের মধ্যেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯।

এছাড়া চলতি বছর ৭ জন কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, আগের বছর উদ্ধার করা হয়েছিল মাত্র ১ জনকে। শিশুদের বিয়ের ঘটনা প্রকাশ্যে না এলেও গবেষকরা বলছেন, সামাজিক চাপ ও দারিদ্র্যের কারণে শিশু বিবাহের বাস্তব সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে মিলে যাচ্ছে একই চিত্র

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৯৩টি কন্যাশিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৯টি কন্যাশিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে মোট ২ হাজার ২৩৭ নারী ও কন্যাশিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

কন্যাশিশুদের নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন গত ৮ অক্টোবর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, সরকার কাজ করছে, যাতে দেশের যেকোনও জায়গায় কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন ঘটলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সহায়তা পৌঁছায়। তবে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, সমাজ ও পরিবারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নারীর প্রতি অবহেলা ও নির্যাতন এখন সমাজে এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এটা ভাঙা ছাড়া কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে এখনও মেয়েশিশুকে দুর্বল ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আইনি পদক্ষেপ বা প্রশাসনিক উদ্যোগ কোনোটি দিয়েই কন্যাশিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, পরিবার থেকেই পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানদের—বিশেষ করে মেয়েশিশুদের মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস ও নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। একইসঙ্গে সমাজে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে একটি মেয়েশিশু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে, নিজের স্বপ্ন দেখতে পারে এবং ভয় ছাড়াই তা পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারে। কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—এই তিনটির মধ্যে সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য।

কেন বাড়ছে সহিংসতা

বিশ্লেষকদের মতে, কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ার পেছনে রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক সহিংসতা, দারিদ্র্য, অনলাইন পর্নোগ্রাফি এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগ।

গবেষকরা বলছেন, বেশির ভাগ পরিবার মামলা বা অভিযোগ করতে ভয় পায়। সামাজিক লজ্জা, আর্থিক অক্ষমতা এবং পুলিশের প্রাথমিক অনীহা অনেক ঘটনাকে চিরতরে চাপা দিয়ে দেয়।

জানতে চাইলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, অনলাইন গ্রুমিং, ব্ল্যাকমেইলিং এবং প্রেমে প্রতারণা এখন কন্যাশিশু নির্যাতনের নতুন মুখ। ডিজিটাল নিরাপত্তার পাশাপাশি মানসিক সহায়তা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এসি/আপ্র/১১/১০/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস

সহিংসতায় থেমে যাচ্ছে কন্যাশিশুর স্বপ্ন

আপডেট সময় : ০৩:১৬:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: ঢাকার একটি এলাকায় বেড়ে ওঠা নবম শ্রেণির ছাত্রী রাইহানার (ছদ্মনাম) স্বপ্ন ছিল একদিন শিক্ষক হবে। কিন্তু গত জুনে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিবেশী এক যুবক ও তার সহযোগীদের হাতে সে ধর্ষণের শিকার হন। সামাজিক লজ্জা, পরিবারের চাপ ও প্রশাসনের উদাসীনতায় মাসখানেক পরই আত্মহত্যা করেন রাইহানা। ভণ্ডুল হয়ে যায় তার স্বপ্ন। পরিবারের নীরব কান্না এখনও থামেনি।

রাইহানার মতো অসংখ্য কন্যাশিশু প্রতিদিনই নীরবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কারও মর্মন্তুদ কাহিনি প্রকাশ্যে এলেও, অনেকেই থেকে যায় অন্ধকারের আড়ালে। ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, নিপীড়ন ও পারিবারিক নিপীড়নের মতো ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। সেইসঙ্গে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে কন্যাশিশুদের অরক্ষিত জীবনের গল্প।

আজ ১১ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। ‘আমি কন্যাশিশু: স্বপ্ন গড়ি, সাহসে লড়ি, দেশের কল্যাণে কাজ করি’- চলতি বছর এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে কন্যাশিশুদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা, সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা এবং দেশের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বার্তা দেওয়া হয়েছে। দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো—কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়ন, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং তাদের প্রতি সমাজে বিদ্যমান ভেদাভেদ ও বৈষম্য দূর করা।

জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে কন্যাশিশুদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়, যাতে তারা নিজের যোগ্যতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।

বছর ঘুরে বাড়ছে নির্যাতন, পরিসংখ্যানে ভয়াবহ চিত্র

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রকাশিত “ভায়োলেন্স এগেইনস্ট গার্ল চিলড্রেন মনিটরিং রিপোর্ট” অনুসারে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের (জানুয়ারি-আগস্ট) মধ্যে কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে দেশে ২২৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, হত্যা ৮১টি, আত্মহত্যা ১৩৩টি। পরের বছর ২০২৪ সালে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯০টিতে, হত্যা ৮৩টি এবং আত্মহত্যা ১০৪টি। সর্বশেষ ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত কন্যাশিশু ধর্ষণের সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫৮টিতে। একই সময়ে হত্যার শিকার ৮৩টি এবং আত্মহত্যা করেছে ১০৪টি শিশু।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সংখ্যাগুলো শুধু কাগজে-কলমে থাকা পরিসংখ্যান নয়, বরং সমাজের গভীরে থাকা নারী ও শিশুবিদ্বেষের প্রতিচ্ছবি। যেসব সংখ্যা পত্র-পত্রিকায় আসছে, প্রকৃত ঘটনা তার কয়েকগুণ বেশি।

ধর্ষণ, প্রতারণা ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

২০২৫ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ২২৮টি কন্যাশিশু ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে বা প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৮টি কন্যাশিশু। ২৯ জন ছিল শারীরিকভাবে অক্ষম শিশু, যাদের ওপর এই পাশবিক নির্যাতন চলে।

২০২৪ সালে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৩৩টি। অর্থাৎ, এক বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণের পর হত্যা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

হত্যা ও আত্মহত্যার ভয়াবহ প্রবণতা

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ৮৩টি কন্যাশিশুকে হত্যা এবং ১০৪টি আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক কলহ, যৌন নিপীড়নের পর মানসিক ট্রমা এবং প্রেমে ব্যর্থতা বা সামাজিক লজ্জার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

২০২৪ সালের তুলনায় আত্মহত্যার সংখ্যা সামান্য কমলেও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা এবং রহস্যজনক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৫ সালে ৫০ জন কন্যাশিশুর মৃত্যু রহস্যজনকভাবে ঘটেছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

পারিবারিক নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ: নিরাপদ নয় ঘরও

পারিবারিক নির্যাতন কন্যাশিশুর জন্য বড় এক ঝুঁকির জায়গা হয়ে উঠছে। ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে ১৯ জন কন্যাশিশু নিজ পরিবারের মধ্যেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯।

এছাড়া চলতি বছর ৭ জন কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, আগের বছর উদ্ধার করা হয়েছিল মাত্র ১ জনকে। শিশুদের বিয়ের ঘটনা প্রকাশ্যে না এলেও গবেষকরা বলছেন, সামাজিক চাপ ও দারিদ্র্যের কারণে শিশু বিবাহের বাস্তব সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে মিলে যাচ্ছে একই চিত্র

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৯৩টি কন্যাশিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৯টি কন্যাশিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে মোট ২ হাজার ২৩৭ নারী ও কন্যাশিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

কন্যাশিশুদের নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন গত ৮ অক্টোবর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সেখানে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, সরকার কাজ করছে, যাতে দেশের যেকোনও জায়গায় কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন ঘটলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সহায়তা পৌঁছায়। তবে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, সমাজ ও পরিবারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নারীর প্রতি অবহেলা ও নির্যাতন এখন সমাজে এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এটা ভাঙা ছাড়া কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে এখনও মেয়েশিশুকে দুর্বল ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আইনি পদক্ষেপ বা প্রশাসনিক উদ্যোগ কোনোটি দিয়েই কন্যাশিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, পরিবার থেকেই পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানদের—বিশেষ করে মেয়েশিশুদের মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস ও নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। একইসঙ্গে সমাজে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে একটি মেয়েশিশু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে, নিজের স্বপ্ন দেখতে পারে এবং ভয় ছাড়াই তা পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারে। কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—এই তিনটির মধ্যে সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য।

কেন বাড়ছে সহিংসতা

বিশ্লেষকদের মতে, কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ার পেছনে রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক সহিংসতা, দারিদ্র্য, অনলাইন পর্নোগ্রাফি এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগ।

গবেষকরা বলছেন, বেশির ভাগ পরিবার মামলা বা অভিযোগ করতে ভয় পায়। সামাজিক লজ্জা, আর্থিক অক্ষমতা এবং পুলিশের প্রাথমিক অনীহা অনেক ঘটনাকে চিরতরে চাপা দিয়ে দেয়।

জানতে চাইলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, অনলাইন গ্রুমিং, ব্ল্যাকমেইলিং এবং প্রেমে প্রতারণা এখন কন্যাশিশু নির্যাতনের নতুন মুখ। ডিজিটাল নিরাপত্তার পাশাপাশি মানসিক সহায়তা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এসি/আপ্র/১১/১০/২০২৫