প্রত্যাশা ডেস্ক: সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ক্রমেই রূপ নেয় সরকারের পতনের দাবিতে গণআন্দোলনে। ২০২৪ সালের জুলাই হয়ে ওঠে ঢাকাবাসীর জন্য এক চরম অস্থির, আতঙ্কময় মাস। প্রতিদিনের চেনা শহর যেন এক অচেনা রূপ ধারণ করে। রাজপথজুড়ে দেখা যায় পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ব্যারিকেড, টিয়ারশেলের ধোঁয়া, সশস্ত্র বাহিনীর টহল, গুলির শব্দ আর আন্দোলনকারীদের ক্ষোভে ফেটে পড়া স্লোগান। এই সময়ে রাজধানীবাসী প্রত্যক্ষ করেছে এমন এক ঢাকা, যেখানে নিরাপত্তা ছিল অনিশ্চিত, আর জীবন ছিল থমকে যাওয়ার শঙ্কায় আবদ্ধ।
১৫ থেকে ১৯ জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলো: ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার মধ্য দিয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। একই দিন হামলা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন আহতদের ওপরও। এসব ঘটনার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই রাজপথে নেমে আসে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ছাড়িয়ে আন্দোলনে যুক্ত হয় স্কুল, কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এই দিনেই রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার মৃত্যু যেন সারা দেশে আগুন ছড়িয়ে দেয়। ওই রাতেই সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু তাতে আন্দোলনের গতি থামেনি।
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। ছুটি হলেও ‘হল না ছাড়ার’ দাবিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা সেখানে গায়েবানা জানাজাও পড়েন। ওই রাতেই আন্দোলনকারীরা ১৮ জুলাই দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। একই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার।
১৮ জুলাই সকাল ১১টা থেকে শুরু হয় শাটডাউন কর্মসূচি। মিরপুর ১০ নম্বরে কর্মসূচির শুরুতেই ছাত্রলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে। দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীরা মিরপুরের পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করে, উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ফুটওভার ব্রিজেও। একপর্যায়ে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। সেদিন রাত থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও।
১৯ জুলাই দুপুরের পর থেকেই মিরপুরে জড়ো হতে থাকে আন্দোলনকারীরা। পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীরা সেখানে আসলে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। পুলিশের পক্ষ থেকে ছোড়া হয় টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড। সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের ভিতরে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ের ২৯টি বর্জ্য কনটেইনার ও কম্প্যাক্টর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ভাঙচুর হয় ১৪টি গাড়ি। আগুন দেওয়া হয় বিআরটিএ কার্যালয়ের ফটকেও।
রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ মিরপুরের আলোক হেলথ কেয়ার ও ডা. আজমল হাসপাতালে অন্তত ১৪ জনের মরদেহ আনা হয়। এই বৈরী পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। সহায়তায় মাঠে নামে সশস্ত্র বাহিনী।
মানুষের অভিজ্ঞতায় সেই বিভীষিকার ছবি: জুলাইয়ের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আলোক হেলথ কেয়ারে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. মুসফিক উস সালেহীন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি চার বছর ধরে এই হাসপাতালে কাজ করছি, এর আগে ঢাকার অন্যত্রও কাজ করেছি। কিন্তু এমন ভয়াবহতা আগে কখনও দেখিনি। ১৮ ও ১৯ জুলাই থেকে গুলিবিদ্ধ ও মারাত্মক আহত রোগী আসা শুরু হয়। আমরা চিকিৎসা দিয়েছি বিনামূল্যে, আমাদের যাদের ডিউটি ছিল না, তারাও এসে সাহায্য করেছে। আমাদের ওপর চাপ ছিল মানসিকভাবেও। রাতের পর রাত দুঃস্বপ্নে ভুগেছি আমরা। এমনকি এক রাতে পুলিশ এসে হুমকি দিয়েছিল, চিকিৎসা দিলে হাসপাতাল বন্ধ করে দেবে। গেটে সাদা পোশাকধারী লোকও রেখে গিয়েছিল। তবুও আমরা কাউকে ফিরিয়ে দেইনি।’
তিনি জানান, ‘হাসপাতালে আসা আহতদের বেশিরভাগই ছিল ছররা গুলির শিকার। তবে বড় বুলেটবিদ্ধ রোগীও এসেছিল, অনেকের বুকে ও মাথায় গুলি লেগেছিল। আমি জীবনে এমন আন্দোলন দেখিনি। মনে হয়েছিল, আমাদের দেশের মতো শান্তিপ্রিয় জায়গায় এটা অসম্ভব।’
মিরপুর ৬ নম্বর এলাকার একটি দোকানে কাজ করেন মোহাম্মদ সাব্বির। তিনি বলেন, ‘আমি ১৬ বা ১৭ জুলাই আন্দোলনে ছিলাম। একসময় মাথায় রাবার বুলেট লাগে, বুঝতেই পারিনি সেটা ভিতরে ঢুকে গেছে। দুই মাস পর কেটে বের করা হয়। জন্মের পর থেকে এমন ঢাকা দেখিনি।’ তবে দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন এই যুবক। তিনি বলেন, ‘খুব আশা নিয়ে আন্দোলনে ছিলাম, কিন্তু এখন দেখি যারা এসেছে, তারা আরো বেশি দুর্নীতিতে জড়িত।’
মিরপুর ২ নম্বরের আরেক বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান। বেসরকারি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এই কর্মী বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে চাকরি করছি, এত বড় সংঘাত দেখিনি। অফিস করতে হয়েছে ঝুঁকি নিয়ে। বনানীর অফিসে যেতে হতো রিকশায়, অনেক বেশি খরচ হতো। সময়ের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকিও ছিল। আমরা ভেবেছিলাম কিছু একটা পরিবর্তন আসবে, কিন্তু এখন মনে হয় অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। সবকিছুতে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।’
৬৫ বছর বয়সী চা বিক্রেতা গণি মিয়া বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে মিরপুরে আছি। এরশাদের পতন, লগি বৈঠার আন্দোলন-সব দেখেছি। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাইয়ের মতো আন্দোলন দেখিনি। এত মানুষ মরেছে, এত সহিংসতা-এটা আগে কখনও দেখিনি।’
জনসম্পৃক্ততায় সরকারে অশনিসংকেত: আন্দোলনের এক পর্যায়ে যখন নিহত-আহতের সংখ্যা বাড়ছিল, তখন সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ গড়ে ওঠে। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায় অভিভাবকরা। কেউ রাজপথে এসে বসে থাকেন, কেউ খাবার-পানি দিয়ে সহায়তা করেন। আন্দোলনকারীদের প্রতি এই সহানুভূতি ও সক্রিয়তা সরকার বুঝতেই পারেনি-যার ফল হয়েছিল ভয়াবহ।
মিরপুর ২ নম্বরের বাসিন্দা মহসিন রেজা বলেন, ‘আমি নিজে আন্দোলনে যাইনি, তবে দেখেছি কীভাবে সাধারণ মানুষ সহায়তা করেছে। বিভিন্ন বাসার গেটে বিস্কুট, কেক, পানি রাখা ছিল। আন্দোলনকারীরা যখন ফায়ার সার্ভিসের পেছনের গলিতে গিয়ে আগুন ধরাতে কিছু পাচ্ছিল না, তখন মানুষ জানালা-বারান্দা থেকে পুরনো খাতা, পত্রিকা ছুড়ে দিচ্ছিল। এই সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাই আওয়ামী লীগের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’ মিরপুর ১০ নম্বরের দোকানদার মাসুদ রানা বলেন, ‘আমার দোকানের একটা শাটার বন্ধ রাখতাম, আরেকটা খোলা। কখন কোথা থেকে গুলি এসে পড়ে তার নিশ্চয়তা ছিল না। আন্দোলনে যাইনি, তবে সাহায্য করেছি। ম্যাচ, কাগজ, পানি দিয়েছি-যা পেরেছি। এরকম ঢাকা আগে দেখিনি।’