ঢাকা ১২:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সরকারি তহবিলে কৃচ্ছ্রতা, ডিসিদের ২৫ নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর

  • আপডেট সময় : ০২:৩৮:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • ৩১ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : জনগণের জন্য কতটুকু কার্যকর হবে সেটি বিবেচনায় কেবল ‘প্রয়োজনীয়’ প্রকল্প গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে সরকারি তহবিল ব্যবহারে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তিনি কৃচ্ছ্র সাধনের কথাও বলেছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাসস। সরকারের মেয়াদের শেষ বছরের শুরুতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা দিতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানে তিনি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ২৫ দফা নির্দেশনা এসেছে সরকার প্রধানদের কাছ থেকে। শেখ হাসিনা বলেন, “ডিসিদের বিবেচনা করতে হবে, যখনই কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়, সেটা ওই এলাকার জন্য কতটুকু কার্যকর। এতে মানুষ কতটুকু লাভবান হবে এবং অপচয় কতটুকু বন্ধ করা যায়, সেদিকে আপনাদের নজরদারি থাকা উচিত। যেহেতু একটা জেলার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। স্বাভাবিকভাবে এগুলো আপনারা দেখবেন। কারণ, যত্রতত্র শুধু পয়সা খরচের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা আমি পছন্দ করি না।“
কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের যেন সেটা মোকাবেলা করতে না হয় সেজন্যই আমরা কৃচ্ছ্র সাধনের ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলেছি এবং সে ব্যাপারেও আপনারা সচেতন থাকবেন।” বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর আর্থিক সংকটের বিবেচনায় ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার নতুন প্রকল্প আপাতত স্থগিতের কথাও সম্মেলনে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আর্থিক সংকট অবশ্যই সারা বিশ্বের মত আমাদেরও আছে। কিন্তু এমন পর্যায়ে নাই যে আমরা চলতে পারব না। আমাদের অগ্রাধিকার আমাদেরই বিবেচনা করতে হবে।“ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সরকারে অগ্রাধিকারে আছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে আমাদের কৃষি উৎপাদন যাতে বাড়ে সেজন্য যা খরচ লাগে আমরা করব।“
জনকল্যাণমূলক কাজে বিনামূল্য করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দিতে সরকারে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের উদাহরণ দেন শেখ হাসিনা। কার্গো বিমান কেনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নিজেদের জন্য কার্গো বিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কিন্তু অর্থনৈতিক এ অবস্থায় কিনতে পারছি না। ভবিষ্যতে কিনব পরিকল্পনা আছে।”
জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “একটা কথাই বলব, আমি আসার (ক্ষমতায়) পর আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এই যে জনমুখী বা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বা জনগণকে সেবা দেওয়ার যে একটা আন্তরিকতা থাকা উচিত, সে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিবর্তন আমি দেখেছি আপনাদের মাঝে। আর সেটা যদি না হত.. আমরা জনপ্রতিনিধিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই ক্ষমতায় আসিৃ”
মাঠ প্রশাসনের কর্মকতাদের কাজের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, “মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ, অগ্নিসন্ত্রাস বা গাছকাটা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।“ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধ না বাঁধলে বাংলাদেশ আরও ‘এগিয়ে’ যেত বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। ডিসিদের তিনি নির্দেশনা দেন: “কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটা পরিহার করতে হবে। আমিদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে নিজেদের চাহিদা নিজেতেরই পূরণ করতে হবে।”
এ সময় তিনি কোরবানির গরুর উদাহরণ দিয়ে বলেন, “এক সময় তো ভারতীয় গরু ছাড়া আমাদের কোরবানিই হত না। এখন হচ্ছে না? হচ্ছে। আমরা এখন নিজেদের উৎপাদনে ওপর নির্ভর করছি।“ জেলা প্রশাসকদের জনগণের ‘সেবক’ হওয়ার তাগিদ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাই, বা আপনারা সরকারি আমলা হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পান, এগুলোর অবদান কিন্তু জনগণের। কারণ, জনগণের অর্থ এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকাতেই সবকিছু চলে। এর জন্য আমরা একেবারে তৃণমূল থেকে জনগণকে শক্তিশালী করে আনতে চাই। সরকার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা এনে দিতে চায় মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “যাতে করে মানুষের শহরমুখী প্রবণতা কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রাণ চাঞ্চল্য তৈরি হয়।” উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরুল্লাহ এবং জেলা প্রশাসকদের পক্ষে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নাঈম মোহাম্মদ মারুফ খান ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভিন তিবরিজি। অনুষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক উন্নয়নের উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখানো হয়।
ডিসিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ২৫ দফা নির্দেশনা:
১. খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পতিত জমিতে ফসল ফলাতে হবে। কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে সে লক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে;
২. নিজেরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং জনগণকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৩. সরকারি অফিসসমূহে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘেœ যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সেবা প্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত;
৪. সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে।
৫. এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে;
৬. দেশে একজনও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জমি ও ঘর প্রদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে;
৭. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে;
৮. কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রসমূহ যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করতে হবে;
৯. শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীল চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
১০. নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে;
১১. পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে;
১২. সরকারি দপ্তরসমূহের ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। নিজ নিজ জেলার সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরতে হবে;
১৩. জনসাধারণের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে;
১৪. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনোভাবেই অবনতি না হয়, সেদিকে নজরদারি জোরদার করতে হবে;
১৫. মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে;
১৬. মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িত না হয় সে জন্য সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। যুব সমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে হবে;
১৭. বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে;
১৮. বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে, কৃত্রিম সঙ্কট রোধকল্পে ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে;
১৯. সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে;
২০. নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্লুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে;
২১. বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় তালগাছ রোপণ করতে হবে;
২২. পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে;
২৩. জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার, বিপণন এবং ব্রান্ডিং করতে হবে;
২৪. জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে সেবার মনোভাব নিয়ে যেন সরকারি দপ্তরগুলো পরিচালিত হয়, সে লক্ষে মনিটরিং জোরদার করতে হবে;
২৫. জেলার সকল সরকারি দপ্তরের কার্যক্রমসমূহ যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ তথা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার লার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সরকারি তহবিলে কৃচ্ছ্রতা, ডিসিদের ২৫ নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর

আপডেট সময় : ০২:৩৮:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : জনগণের জন্য কতটুকু কার্যকর হবে সেটি বিবেচনায় কেবল ‘প্রয়োজনীয়’ প্রকল্প গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে সরকারি তহবিল ব্যবহারে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তিনি কৃচ্ছ্র সাধনের কথাও বলেছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বাসস। সরকারের মেয়াদের শেষ বছরের শুরুতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা দিতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানে তিনি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ২৫ দফা নির্দেশনা এসেছে সরকার প্রধানদের কাছ থেকে। শেখ হাসিনা বলেন, “ডিসিদের বিবেচনা করতে হবে, যখনই কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়, সেটা ওই এলাকার জন্য কতটুকু কার্যকর। এতে মানুষ কতটুকু লাভবান হবে এবং অপচয় কতটুকু বন্ধ করা যায়, সেদিকে আপনাদের নজরদারি থাকা উচিত। যেহেতু একটা জেলার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। স্বাভাবিকভাবে এগুলো আপনারা দেখবেন। কারণ, যত্রতত্র শুধু পয়সা খরচের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা আমি পছন্দ করি না।“
কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের যেন সেটা মোকাবেলা করতে না হয় সেজন্যই আমরা কৃচ্ছ্র সাধনের ঘোষণা দিয়েছি। আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলেছি এবং সে ব্যাপারেও আপনারা সচেতন থাকবেন।” বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর আর্থিক সংকটের বিবেচনায় ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার নতুন প্রকল্প আপাতত স্থগিতের কথাও সম্মেলনে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আর্থিক সংকট অবশ্যই সারা বিশ্বের মত আমাদেরও আছে। কিন্তু এমন পর্যায়ে নাই যে আমরা চলতে পারব না। আমাদের অগ্রাধিকার আমাদেরই বিবেচনা করতে হবে।“ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সরকারে অগ্রাধিকারে আছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে আমাদের কৃষি উৎপাদন যাতে বাড়ে সেজন্য যা খরচ লাগে আমরা করব।“
জনকল্যাণমূলক কাজে বিনামূল্য করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দিতে সরকারে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের উদাহরণ দেন শেখ হাসিনা। কার্গো বিমান কেনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নিজেদের জন্য কার্গো বিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কিন্তু অর্থনৈতিক এ অবস্থায় কিনতে পারছি না। ভবিষ্যতে কিনব পরিকল্পনা আছে।”
জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “একটা কথাই বলব, আমি আসার (ক্ষমতায়) পর আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এই যে জনমুখী বা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বা জনগণকে সেবা দেওয়ার যে একটা আন্তরিকতা থাকা উচিত, সে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিবর্তন আমি দেখেছি আপনাদের মাঝে। আর সেটা যদি না হত.. আমরা জনপ্রতিনিধিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই ক্ষমতায় আসিৃ”
মাঠ প্রশাসনের কর্মকতাদের কাজের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, “মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ, অগ্নিসন্ত্রাস বা গাছকাটা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।“ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধ না বাঁধলে বাংলাদেশ আরও ‘এগিয়ে’ যেত বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। ডিসিদের তিনি নির্দেশনা দেন: “কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটা পরিহার করতে হবে। আমিদানি নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে নিজেদের চাহিদা নিজেতেরই পূরণ করতে হবে।”
এ সময় তিনি কোরবানির গরুর উদাহরণ দিয়ে বলেন, “এক সময় তো ভারতীয় গরু ছাড়া আমাদের কোরবানিই হত না। এখন হচ্ছে না? হচ্ছে। আমরা এখন নিজেদের উৎপাদনে ওপর নির্ভর করছি।“ জেলা প্রশাসকদের জনগণের ‘সেবক’ হওয়ার তাগিদ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাই, বা আপনারা সরকারি আমলা হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পান, এগুলোর অবদান কিন্তু জনগণের। কারণ, জনগণের অর্থ এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকাতেই সবকিছু চলে। এর জন্য আমরা একেবারে তৃণমূল থেকে জনগণকে শক্তিশালী করে আনতে চাই। সরকার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা এনে দিতে চায় মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “যাতে করে মানুষের শহরমুখী প্রবণতা কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রাণ চাঞ্চল্য তৈরি হয়।” উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরুল্লাহ এবং জেলা প্রশাসকদের পক্ষে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নাঈম মোহাম্মদ মারুফ খান ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভিন তিবরিজি। অনুষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক উন্নয়নের উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখানো হয়।
ডিসিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ২৫ দফা নির্দেশনা:
১. খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পতিত জমিতে ফসল ফলাতে হবে। কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে সে লক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে;
২. নিজেরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং জনগণকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৩. সরকারি অফিসসমূহে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘেœ যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সেবা প্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত;
৪. সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে।
৫. এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে;
৬. দেশে একজনও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জমি ও ঘর প্রদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে;
৭. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে;
৮. কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রসমূহ যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করতে হবে;
৯. শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীল চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
১০. নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে;
১১. পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে;
১২. সরকারি দপ্তরসমূহের ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। নিজ নিজ জেলার সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরতে হবে;
১৩. জনসাধারণের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে;
১৪. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনোভাবেই অবনতি না হয়, সেদিকে নজরদারি জোরদার করতে হবে;
১৫. মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে;
১৬. মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িত না হয় সে জন্য সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। যুব সমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে হবে;
১৭. বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে;
১৮. বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে, কৃত্রিম সঙ্কট রোধকল্পে ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে;
১৯. সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে;
২০. নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্লুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে;
২১. বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় তালগাছ রোপণ করতে হবে;
২২. পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে;
২৩. জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার, বিপণন এবং ব্রান্ডিং করতে হবে;
২৪. জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে সেবার মনোভাব নিয়ে যেন সরকারি দপ্তরগুলো পরিচালিত হয়, সে লক্ষে মনিটরিং জোরদার করতে হবে;
২৫. জেলার সকল সরকারি দপ্তরের কার্যক্রমসমূহ যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ তথা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।