মো. খালিদ হাসান রাতুল : বাংলাদেশে সম্প্রতি সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার জন্য আন্দোলন করছে একদল শিক্ষার্থী। তাদের মতে করোনা মহামারিতে শিক্ষাকার্যক্রম স্থগিত হয়ে পড়ে। ফলাফলস্বরূপ সেশনজটে পড়ে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী। এছাড়া বিগত সরকারের আমলে অনিয়মের কথাও বলছে চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মতে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বর্তমানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন শিক্ষার্থীর স্নাতক সম্পন্ন করতে ২৩ থেকে ২৪ বছর বয়স হয়ে থাকে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জটের কারণে এর ব্যত্যয় দেখা যায়। অতএব প্রতিবছর বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষা নিয়মিত হলে সে ন্যূনতম ৬টি বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারে। একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য এটি যথেষ্ট বলেই প্রতীয়মান হয়। এরপরও চাকরিপ্রার্থীরা আরও বেশি সংখ্যক বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে চায়। এর মূল কারণ বর্তমান তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি প্রবল আগ্রহ। যার কারণে তারা মনে করছে যদি আরও বেশিসংখ্যক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তবে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিসিএস এর জন্য পড়াশোনা শুরু করে। তাদের কাছে একাডেমিক পড়াশোনা গৌণ মনে হয়। সরকারি চাকরি চাকরি না হারানোর নিশ্চয়তা, সামাজিক সম্মান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কারণে তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। এছাড়া বিগত সরকারের আমলে সরকারি আমলাদের অর্থবিত্ত, ক্ষমতা সরকারি চাকরিকে সমাজের সুপার ক্লাসে পরিণত করেছে।
অন্যদিকে বেসরকারি চাকরির অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো না থাকা ও শ্রম আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবের কারণে তরুণদের মধ্যে বেসরকারি চাকরির প্রতি অনীহা প্রকাশ বেড়েছে। বেশ কিছুদিন আগে রেলওয়ের ১৯তম গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হয় ওয়েম্যান পদের। যার মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। সেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি হলেও যোগদানকারী অধিকাংশই স্নাতকসম্পন্ন! যেটি আমাদের সরকারি চাকরির প্রতি তীব্র আকাক্সক্ষা ও বেকারত্বের সমস্যা কতটা প্রকট তা দেখায়। অনেকক্ষেত্রেই অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরি হলেও সরকারি চাকরি নিশ্চিত করতে চাচ্ছে তরুণরা।
বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি এক রিপোর্টে দেখা গেছে গত তিনবছরে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা ১৯ লাখ শিক্ষার্থীর অধিকাংশ বেকার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত প্রায় ২ হাজারের মতো কলেজে উচ্চশিক্ষা দেয়া হয়। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত তরুণ প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক চাকরির প্রার্থীর জন্য সরকারি ও বেসরকারি আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি সংখ্যা সীমিত।
এই বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর প্রধান টার্গেট সরকারি চাকরি। তারা প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত অবস্থা থেকে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রিপারেশন নিয়ে থাকে। ফলে উচ্চশিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য গবেষণা তা খুব কম অর্জিত হয়ে থাকে, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না বললেই চলে। যখন বয়সসীমা ৩৫ করা হবে তখন সরকারি চাকরির জন্য চাকরিপ্রার্থীরা ৩৫ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরির প্রিপারেশন নিবে এবং অন্য কোনো চাকরি বা শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করবে না! এছাড়া একজন ২৩ বছরের সদ্য গ্রাজুয়েট এর সাথে ১০ বছর প্রিপারেশন নেওয়া প্রার্থীর এক অসম প্রতিযোগিতা হবে, বেকারত্ব আরও বাড়বে। এছাড়া এই দীর্ঘ সময় মুখস্থনির্ভর সরকারি চাকরি প্রিপারেশন নেওয়া চাকরিপ্রার্থীর বাস্তবিক কাজ করার কোনো স্কিল অর্জন করবে না। সরকারি চাকরি না হলে তারা দেশের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে। দীর্ঘসময় যখন তরুণরা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখবে না, তখন সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এদিকে বেসরকারি চাকরিতে এই বয়সসীমা একটি বিরূপ প্রভাবে ফেলবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারি খাতে যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরি প্রার্থী প্রদান করতে পারছে না বলে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তা অভিযোগ করছে। দেশে এখনো অনেক বিদেশি কর্মী কাজ করছে যেখানে আমাদের দেশে বিশাল একশ্রেণি বেকার। সরকারি চাকরির বয়স ৩৫ হলে, অনেকেই চাকরির বয়স শেষে বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে চাইবে! ৩৫ বছর বয়সের একজন ট্রেইনি হিসেবে জয়েন করলে তার কাজ শিখে প্রোডাক্টিভ হতে প্রায় ৩৭ বছর বয়স হবে। তাহলে তার ক্যারিয়ার কতটা সুদূরপ্রসারী হবে? এই বয়সে তার নতুন করে শেখার প্রবণতা ও সক্ষমতা থাকবে না। ফলে বেসরকারি চাকরিতে টিকে থাকা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। ঠিক একই সময় ২৩ বছর বয়সের একজন ট্রেইনি হিসেবে জয়েন করবে। ফলে তাদের মধ্যে একটি জেনারেশন গ্যাপ বিদ্যমান হবে।
শুধু আনুষ্ঠানিক সরকারি বেসরকারি খাতে চাকরির চিন্তাধারা এই বিশাল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারি খাতে চাকরি সীমিত। এই সীমিত সংখ্যক চাকরির জন্য দীর্ঘ বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করা বেকারত্বকে আরও তীব্র করবে। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে ভাবা উচিত, সংখ্যা নিয়ে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃত অর্থে গবেষণা নির্ভর দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা উচিত।
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে উচ্চশিক্ষাকে এত সহজলভ্য করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। উচ্চশিক্ষার জন্য যে পরিমাণ সময় ও অর্থ ব্যয় করছে একজন শিক্ষার্থী তা যেন তার জন্য দিনশেষে বোঝা না হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষায় সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। নাহলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেকার বানানোর কারখানায় পরিণত হবে। চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির আন্দোলন শুধু বেকারত্ব না, আমাদের উচ্চশিক্ষার নাজুক অবস্থাকে প্রকাশ করছে।
লেখক: এইচআর স্পেশালিস্ট, বহুজাতিক কোম্পানি।