আমীন আল রশীদ : বিসিএস ছাড়া মোটামুটি অন্য সব সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রার্থীদের ঢাকায় আসতে হয়। সারা দেশ থেকে এই যে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ঢাকায় আসেন, এটি অনেকের জন্যই বেশ কষ্টকর। আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়ার বাইরেও প্রতিটি আবেদনের জন্য সরকারকে ফি দিতে হয়। এভাবে অসংখ্য বেকার তরুণ-তরুণীকে বছরের পর বছর ধরে চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এই খরচ করেও যে সবাই চাকরি পান, তাও না।
আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রে যে বেকারদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাতা দেওয়া হয়, আমাদের দেশে উল্টো সেই বেকারদের চাকরির পরীক্ষার জন্য অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাষ্ট্রকে দিতে হয়। কিন্তু এই টাকা খরচের সামর্থ কতজনের আছে? আবার এইসব তরুণকে পরিবারের তরফে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তা হলো, এতবার ঢাকায় যাচ্ছো, পরীক্ষা দিচ্ছো, চাকরি তো হয় না। আর কত পরীক্ষা দেবে? উপরন্তু, একই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা হয়। যে কারণে অনেকেই আবেদন করেও সব পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। প্রশ্ন হলো, শিক্ষিত বেকার তরুণদের এইসব বিব্রতকর প্রশ্ন এবং জটিলতার সমাধান কোথায়?
গত ৩ অক্টোবর ফেসবুকে রাশিদা আক্তার নামে একজন চাকরিপ্রার্থী লিখেছেন, ‘ঢাকায় পরীক্ষা হবে, এমন নিয়োগে আবেদন করি না।’ তার মানে ঢাকায় আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়ার যে খরচ ও জটিলতা, সেটি এড়ানোর জন্য এই নারী অনেক পরীক্ষায় অংশও নিতে পারছেন না। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের কারণে তিনি সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে পারছেন না। অথচ কোনও না কোনও পরীক্ষায় হয়তো তিনি টিকে যেতেন। সুতরাং এই পরীক্ষাটি যদি তার জেলা, নিদেনপক্ষে বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি অংশ নিতে পারতেন।
ধরা যাক, দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে একজন চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসবেন। ঢাকায় নেমেই সাথে সাথে পরীক্ষার হলে যাওয়া সম্ভব নয়। সাধারণত একদিন আগে আসতে হয়। বিশ্রাম নিতে হয়। ঢাকার সবার আত্মীয়-স্বজন নাও থাকতে পারে। না থাকলে তাকে হোটেলে উঠতে হয়। তার মানে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে একদিন আগে ঢাকায় এসে হোটেল উঠতে হয়; দুদিনে ৬-৭ বেলা খেতে হয়; পরীক্ষার হলে যেতে হয় আবার পরীক্ষা শেষে বাসে বা ট্রেনে পঞ্চগড়ে ফিরতে হয়। তাতে দেখা যাবে বাস বা ট্রেন ভাড়া, হোটেলে থাকা খাওয়া এবং অন্যান্য পরিবহন খরচসহ একটি পরীক্ষা দিতেই পঞ্চগড়ের ওই তরুণ বা তরুণীর কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। আবার একজন তরুণ হয়তো একাই ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ নারীর সঙ্গে তার একজন অভিভাবককে আসতে হয় নিরাপত্তার জন্য। অর্থাৎ তার খরচ হয় দ্বিগুণ। তারওপর আছে পরীক্ষার আবেদন ফি। এভাবে একজন চারকিপ্রার্থীকে যদি ১০টি পরীক্ষায়ও অংশ নিতে হয়, তাহলে তার কত খরচ হলো? এত খরচ করেও শেষমেষ যে তিনি একটা চাকরি পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?
এই দুর্ভোগ অবসানের উপায় দুটি। ১. বিসিএস পরীক্ষার মতো সব সরকারি চাকরির পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে এবং সম্ভব হলে জেলায় জেলায় আয়োজন করতে হবে এবং ২. সরকারি চাকরির আবেদনের জন্য কোনও ফি নেওয়া যাবে না।
একজন বেকার তরুণ তরুণী ফি দেবেন কী করে? পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কোন প্রক্রিয়ায় সরকারি চাকরির জন্য প্রার্থী বাছাই করা হয়, সেগুলোও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা দরকার। আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা নানা বাহানায়, এমনকি পুকুর চাষ ও ঘাষ কাটা শিখতেও বিদেশ সফরে যান। অথচ শিক্ষিত বেকারদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের উপায় খুঁজতে কোনও সফরে যান না বা কোনও দেশে গিয়ে এসব বিষয় জানার চেষ্টাও করেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকারি চাকরির আবেদনের জন্য যদি ফি নেওয়া না হয়, তাহলে পরীক্ষা আয়োজনের যে খরচ, সেখানে তো সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। সরকার নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছে। সরকারের নিজের টাকা বলে তো কিছু নেই। সবই জনগণের টাকা। সুতরাং সেই জনগণ যে ট্যাক্স দেয়, সেই জনগণের বেকার সন্তানরাই সরকারি চাকরির জন্য যে আবেদন করবেন, সেখানে তাকে ফি দিতে হবে কেন? চাকরির আবেদনের ফি নিয়ে সরকার কি বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে? এই অংকটা নিশ্চয়ই অনেক বড় নয়। সুতরাং এই টাকা ভর্তুকি দেওয়া সরকারের জন্য বড় কোনও অসুবিধার ব্যাপার নয়। বরং জনগণের ট্যাক্সের টাকা জনগণের বেকার সন্তানদের পরীক্ষা নেওয়ার পেছনেই খরচ হবে।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বিভাগ বা জেলা পর্যায়ে পরীক্ষা নিলে খরচ বাড়বে কিনা? খুব বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না। কারণ ঢাকায় পরীক্ষা আয়োজনের যে খরচ, তাতে অংশ নিতে গিয়ে সারা দেশে থেকে লাখ লাখ পরীক্ষার্থীদের ঢাকায় আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়া মিলিয়ে যে খরচ হয়, তার তুলনায় জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নেওয়ার খরচ অনেক কম। নির্ভর করছে পরীক্ষাটা কার অধীনে হচ্ছে? স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে নাকি কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের? ঢাকায় যে খরচ হবে সেই খরচের একটি অংশ সরকার যদি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন বা পরীক্ষায় আয়োজক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেয়, তাহলে এটি বড় কোনও সমস্যা নয়।
এখানে মূল সংকট বা সমস্যা হচ্ছে প্রশ্নের নিরাপত্তা ও পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা। স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষা হলে সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের আত্মীয়-স্বজন বা দলীয় নেতাকর্মীরা পরীক্ষার হলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে সমাধান হলো সকল সরকারি চাকরির পরীক্ষা পিএসসির অধীনে বা তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করা। এমনকি যেহেতু এখন সকল বিভাগীয় শহরে অন্তত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ফলে সেখানেও পরীক্ষাগুলো হতে পারে এবং সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে চাকরির পরীক্ষাগুলোয় কোনও ধরনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রাখবে না, তাহলে এটি সম্ভব। তবে সবচেয়ে ভালো হয় পরীক্ষাগুলো পিএসসির অধীনে গ্রহণ করা গেলে। কারণ এখন পর্যন্ত পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত কোনও পরীক্ষা নিয়ে কোনও বিতর্ক ওঠেনি বা এখানে কোনও ধরনের প্রভাব বিস্তার করা যায় বলে শোনা যায়নি। ফলে পিএসসি যদি পরীক্ষাগুলো গ্রহণ করে এবং পরীক্ষার খাতা দেখা এবং ভাইভা পর্যন্ত সবগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিয়োগের সুপারিশ করে, তাহলে এ নিয়ে বিতর্ক উঠবে না। তবে পিএসসির সেই সক্ষমতা আছে কি না এবং সবগুলো মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা একটি প্রতিষ্ঠান নিতে পারবে কি না—সেটিও বিরাট প্রশ্ন।
সেক্ষত্রে সমাধান হলো যেমন সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ একই ছাতার নিচে নিয়ে আসার জন্য একটা নিয়োগ কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। সেটি হতে পারে পিএসসির অধীনেই। বছরের শুরুতে সবগুলো মন্ত্রণালয় যদি তাদের চাহিদা দিয়ে দেয় যে কোন পদে কতজন লোক নিয়োগ দিতে হবে, তখন ওই নিয়োগ কর্তৃপক্ষ একটি অভিন্ন পরীক্ষা গ্রহণ করবে এবং ফলাফলের ভিত্তিতে সেখান থেকে জনবল বাছাই করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় নিয়োগের সুপারিশ করবে। কারণ সোনালি ব্যাংকে চাকরির জন্য যিনি আবেদন করেছেন বা পরীক্ষা দিয়েছেন, তিনি রুপালি ব্যাংকেও চাকরি করতে পারবেন। সুতরাং দুটি ব্যাংকের জন্য আলাদা পরীক্ষা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। বিশেষায়িত পদ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাধারণ পদেও একই কথা প্রযোজ্য। তাতে করে একজন চাকরিপ্রার্থীকে বছরব্যাপী পরীক্ষা দিতে হবে না।
প্রসঙ্গত, এখন বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা হচ্ছে বিভাগীয় পর্যায়ে। ভাইভা শুধু ঢাকায়। তবে সম্প্রতি রেলের দুটি পরীক্ষাও ঢাকার বাইরে হয়েছে এবং সেগুলো হয়েছে পিএসসির অধীনে। যে কারণে ওই পরীক্ষাগুলো নিয়ে কোনও ধরনের বিতর্ক ওঠেনি। সেই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য সকল মন্ত্রণালয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা পিএসসির অধীনে নেওয়া গেলে সরকারি চাকরি নিয়ে মানুষের মনে যে খুব সাধারণ ধারণা যে, এখানে মোটা অংকের ঘুষ ও রাজনৈতিক তদবির ছাড়া চাকরি হবে না—সেই ধারণা থেকেও বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। সেজন্য পিএসসির কলেবর ও জনবল বাড়াতে হবে। বাজেট বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে পিএসসি আইনও সংস্কার করতে হবে।
সব মিলিয়ে সরকারি চাকরি পরীক্ষার পুরো বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। যারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং ভুক্তভোগী—তাদের মতামতের ভিত্তিতে এমন একটা পদ্ধতি চালু করা দরকার, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়ার পরে শিক্ষিত বেকার তরুণদের চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে শরীর, স্বাস্থ্য এবং অভিভাবকের অর্থের শ্রাদ্ধ করতে না হয়।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।