নারী ও শিশু ডেস্ক : মোহসিনা খাতুন, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। স্বামীসহ থাকেন রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুল এলাকায়। স্বামী মো. সায়েদুল ইসলাম বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট হিসেবে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করা মোহসিনা কাজ করেন শহরের বস্তি এলাকায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে।
রাজধানী মহাখালীর কড়াইল বস্তি ছাড়াও বাড্ডার দু’টি বস্তিতে কাজ করেন তিনি। এসব এলাকায় গৃহিণীদের কাছে তিনি পরিচিত ‘স্বাস্থ্য আপা’ হিসেবে। এসব স্বাস্থ্যকর্মীর ‘সামাজিক যোগাযোগ’ রাজধানীর বস্তি এলাকায় মা ও নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করে বলে সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায়ও বলা হয়েছে।
গবেষণা প্রকল্পটির নেতৃত্ব দেন আইসিডিডিআরবি’র সেন্টার ফর ইক্যুয়িটি অ্যান্ড হেলথ সিস্টেম বিভাগের সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. অ্যাডামস। তার নেতৃত্বে একটি গবেষক দল ঢাকা শহরের পাঁচটি বস্তির ৯৯৩ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেন, যারা পূর্ববতী তিন মাসের মধ্যে সন্তানের মা হয়েছেন।
গত বছর প্রকাশিত সংস্থাটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে জীবিকার সন্ধানে শহরে ছুটে আসছে। তাদের মধ্যে অপরিচিত পরিবেশে এসে সমস্যায় পড়েন গর্ভবতী মহিলারা।
এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা এবং নবজাতকসহ মাকে প্রসব পরবর্তী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ ও সেবা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার নিয়োজিত স্বাস্থ্য সেবিকারা। যা নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, বস্তির নি¤œ আয়ের মানুষকে সেবা দিতে ২০০৭ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ‘মানসি’ নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়োগ দেয়া হয় স্বাস্থ্যসেবিকা। যারা ওই বস্তি কিংবা আশপাশের এলাকারই বাসিন্দা।
স্বাস্থ্যকর্মী মোহসীনা খাতুন বলেন, বস্তির মায়েরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। কাজ করতে গিয়ে এমনও দেখেছি যে, অনেক গর্ভবতী নারী দূরের টিউবওয়েল থেকে পানির কলস আনতে গিয়ে অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। তারা যেমন কোনো ধরনের সেবা পান না, পরিবারের লোকজনও সচেতন নয়। এতে গর্ভবতী মা ও শিশুরা বেশ ঝুঁকিতে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের খোঁজ-খবর নেয়ার পাশাপাশি কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং অনাগত সন্তান ও মায়ের পুষ্টি নিয়ে কথা বলি। শিশুর জন্মের পর টিকা দেয়ার বিষয়েও পরামর্শ দিই।’
ব্র্যাকের নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির একজন কর্মকর্তা জানান, এসব স্বাস্থ্য সেবিকারা বস্তি এলাকার গর্ভবতী মহিলাদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু অপরিচিত বা অন্য এলাকার কেউ তাদের মাঝে গেলে অনেক নারীই অস্বস্তিবোধ করেন।
এদিকে ব্র্যাকের পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে আইসিডিডিআর,বি বলছে, আগে শতকরা মাত্র ১৫ শতাংশ গর্ভবতী প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও সন্তান প্রসব করার সকল প্রকার সুযোগ রয়েছে এমন স্বাস্থ্য কেন্দ্র্রে যেতেন। কিন্তু কর্মসূচি গ্রহণের ফলে এই হার শতকরা ৫৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
একই ভাবে গর্ভকালীন সময়ে শতকরা মাত্র ২৭ শতাংশ সন্তানসম্ভবা মা চারবার শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আসতেন। কিন্তু কর্মসূচির পর এ হার ৫২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
মায়েদের সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বস্তিতে সামাজিক সম্পর্ক ও সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছেন।
তাদের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েরা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান প্রসব, প্রসব পরবর্তী চিকিৎসা গ্রহণ ও নবজাতককে শালদুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে অধিক মাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। তারা পরিচিত বন্ধু-বান্ধব এমনকি পরিবারের সদস্যদের চাইতেও পরিচিত স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিক বিশ্বাস করে থাকেন।
মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. নাজনীন আখতার বলেন, আমরাও বিভিন্ন সময় দেখেছি যে, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা বিষয়ক তথ্য ও সেবা দিয়ে থাকেন। এর ফলে বস্তি এলাকার গর্ভবতী মায়েরা প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের দিয়ে প্রসব করানো, জন্মের পর পর শিশুকে শালদুধ খেতে দেয়া ও প্রসব পরবর্তী ফলোআপ চিকিৎসা নিতে যাওয়ার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী হয়ে থাকেন। এটা খুবই ভালো দিক।
এদিকে শুধু বস্তিতেই নয়, সব শ্রেণীর নারীদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চালু রয়েছে অনলাইনভিত্তিক ‘মায়া আপা প্লাস’। পরিচয় গোপন রেখে ও অনলাইন মেসেজিং সার্ভিসের মাধ্যমে বর্তমান করোনার সময়সহ সবসময়ই বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন নারীরা। এটি ২০১৫ সালে চালু করা হয়।
মায়া আপা’র চিফ মেডিক্যাল অফিসার পারমিতা করিম বলেন, আমাদের ডক্টরস প্যানেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। নিয়মিত গ্রাহকদের চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে সরকারের উদ্যোগে দেশে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে সমন্বিত শিশু চিকিৎসা কার্যক্রমকে মূল কৌশল হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের উদ্যোগে এমএনসি অ্যান্ড এএইচ অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় নবজাতক ও শূন্য থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মৃত্যু হ্রাসকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ চলছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দেশজুড়ে সমন্বিত শিশু চিকিৎসা কর্নারগুলোতে প্রায় ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৬১০ জন শিশুকে (অনূর্ধ্ব ৫ বছর) এ সেবা দেয়া হয়েছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা দেয়া এবং চিকিৎসার জন্য খরচ কমানো।
মাঠ পর্যায়ে এসব সেবা দিতে কাজ করে যাচ্ছেন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকরা। প্রশিক্ষণের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে যোগ দিয়ে নিজ এলাকার মা ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. সাঈদ আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, বস্তি এলাকার গর্ভবতী মায়েরা অপরিচিত কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর চেয়ে পরিচিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এভাবেই নারীদের কাছে আপনজন হয়ে উঠেছেন স্বাস্থ্য আপারা।
সরকারি উদ্যোগে সেবা নিয়ে বস্তিতে ‘স্বাস্থ্য আপা’
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ