নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘ এক বছরের আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সম্বলিত জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হলো।
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও এই রাজনৈতিক সমঝোতার দলিলে স্বাক্ষর করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশন ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করেছে। সারা বিশ্বের কাছে এটি ‘উদাহরণ হয়ে থাকবে’।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষরের এই আনুষ্ঠানিতা হয়। বিকাল ৪টায় এ অনুষ্ঠান শুরুর করা থাকলেও বৃষ্টির কারণে তা আধা ঘণ্টার বেশি বিলম্বিত হয়। ঠিক সাড়ে ৪টায় ব্যান্ডদলের বাদ্যের তালে মঞ্চে এসে উপস্থিত হন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে স্বাগত জানান ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ।
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশের এক নতুন জন্ম হয়েছে এবং গণঅভ্যুত্থানের কারণে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে তিনি এই সনদ স্বাক্ষরকে অভ্যুত্থানের ‘দ্বিতীয় অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং অভ্যুত্থান সফলের পেছনে আত্মত্যাগকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। বক্তব্য প্রদানকালে ড. মোহাম্মদ ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, জাতি আজ এক নবজন্মের সন্ধিক্ষণে। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের কারণে, বিশেষ করে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের কারণে। তিনি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটিকে সেই অভ্যুত্থানের “দ্বিতীয় অংশ” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আত্মত্যাগকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্যের শুরুতেই ড. ইউনূস অভ্যুত্থানের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন রক্ত দিয়েছেন, তাদের স্মরণ করেন। একই সঙ্গে যারা আহত হয়েছেন বা কষ্টে আছেন, সেই বীর যোদ্ধাদের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, তাদের আত্মত্যাগের ফলেই আজকের এই দিনটি সম্ভব হয়েছে এবং সারা জাতি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
সংবিধান ও সরকার পরিচালনায় পরিবর্তন প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সুযোগে জাতি পুরনো ও অপ্রয়োজনীয় আলোচনা (পুরন পুরনো কথাবার্তা সব পেছনে ফেলে) বাদ দিয়ে নতুন বিষয়গুলোকে জাতীয় জীবনে নিয়ে এসেছে। এই পরিবর্তনের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের পরিবর্তন এবং সরকার পরিচালনার (সরকার চালানো বিষয়) সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়। তিনি নিশ্চিত করেন, এই পরিবর্তনের ভেতরে অনেক নতুন বিষয় এসেছে।
অনুষ্ঠান মঞ্চে তার সঙ্গী হন জুলাই সনদ প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। বিকাল ৪টা ৩৭ মিনিটে জাতীয় সংগীতে অনুষ্ঠান শুরু হয়। যে দলটির দাবির মুখে জুলাই সনদ সই হচ্ছে, জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি ‘স্পষ্ট’ না হওয়ার যুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছে দলটি।
এছাড়া ইতিহাস ‘সঠিকভাবে না আসা’ এবং সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন নিয়ে আপত্তির কারণে বাম ধারার চারটি দল সনদে সই না করার ঘোষণা দিয়েছিল। দলগুলো হল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
ইউনূসের সঙ্গে মঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সালাহ উদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের. সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও আবুল হাসান রুবেল, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেখা গেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা ছাড়াও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব ছিলেন অনুষ্ঠানে।
কূটনীতিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আমন্ত্রিত প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ৩৩ দল ও জোট ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে থাকা কয়েকটি দলের প্রতিনিধিরা সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। দর্শক সারিতে দেখা গেছে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনকেও।
স্বাগত বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, আজকে এ দিন দেশের ইতিহাসের একটি অভূতপূর্ব ও অনন্য সময়। একটি ক্রান্তিকালে দেশের জন্য দীর্ঘপথ যাত্রার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।
সরকারের সংস্কারের ধারাবাহিকতা ও ঐকমত্য কমিশনের কাযক্রম তুলে ধরে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সনদ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতার পর সাত মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।
এদিকে এ অনুষ্ঠানের আগে দুপুরে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আইনি সুরক্ষা, পুনর্বাসনের দাবিতে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চের সামনে অবস্থান নেয় জুলাই শহীদদের পরিবার ও আহত শতাধিক ব্যক্তি। তাদের বিক্ষোভের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ মঞ্চে এসে তাদের দাবি পূরণে জুলাই সনদে সংশোধনী আনার ঘোষণা দেন। ওই প্রতিশ্রুতির পরও ‘জুলাই যোদ্ধারা’ সেখান থেকে না সরলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ও লাঠিপেটা করে সেখান থেকে তাদের সরায়। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করে পুলিশ।
বিশেষ প্রামাণ্যচিত্রে নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি: জুলাই সনদে স্বাক্ষর ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের পর অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয় বিশেষ প্রামাণ্য চিত্র। এতে উঠে আসে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন নিষ্ঠুরতার প্রতিচিত্র। আয়নাঘরে গুম হওয়া পরিবারের আর্তনাদ, বেঁচে আসা ব্যারিস্টার আরমানের লোমহর্ষক বর্ণনা, বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড ও জুলাই আন্দোলনের নির্মম হত্যার চিত্র প্রদর্শনের সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সাত মিনিটের এ প্রামাণ্যচিত্র দেখতে সংসদ ভবনের বাইরেও বিপুল সংখ্যক দর্শকের দৃষ্টি ছিল অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনের এলইডিতে। অনেকে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। সেখানে আসা স্কুল শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘এ প্রদর্শনীতে বিগত দিনে বাংলাদেশের অন্ধকার সময়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।’
আরেক অভিভাবক বলেন, ‘এ দৃশ্যগুলো আমাদের দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়গুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন দিন আর না আসুক।’
সানা/আপ্র/১৭/১০/২০২৫