মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক মহাসঙ্কটের মধ্যে পড়েছে, যেখানে সংকটমুক্তির পথ খুঁজতে রাজনৈতিক দল, বিশিষ্টজন এবং নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ নানা আলোচনা ও সংলাপে অংশ নিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংলাপ, যেখানে প্রায় ২০টি রাজনৈতিক দল ও জোট, শিক্ষার্থী এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছেন, তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করেছে। এই সংলাপে উঠে এসেছে কিছু মূল বিষয়— সংস্কার, নির্বাচন এবং জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচারের প্রতি আশা। তবে, এই আলোচনা শুরুর পর থেকেই সরকারের পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্দেশ্য এবং জনগণের চাহিদা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে উঠে এসেছে, ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে সামনে নিয়ে এগোনোর অপরিহার্যতা। তিনি সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশের অগ্রগতিতে সহায়ক হতে পারবে না। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো ধরনের সংস্কার কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়। তার মতে, নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রমও চালিয়ে যেতে হবে। এটি শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়; বরং প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
জাতীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের পরিবর্তনের এই মুহূর্তে ঐক্য একটি মৌলিক প্রয়োজন। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান আমাদের ঐতিহাসিকভাবে নতুন কক্ষপথে প্রবেশের সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে সর্বাত্মক ঐক্যের প্রয়োজন।
ড. ইউনূসের বক্তব্যে এই ঐক্যের গুরুত্ব বারবার উঠে এসেছে। বিশেষত তিনি যখন বলেন, “সংস্কারের জন্য ঐকমত্য প্রয়োজন এবং আমরা দ্রুত এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই,” তখন স্পষ্ট হয় যে, একটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটি কতটা জরুরি।
সংস্কার কমিশন গঠনের বিষয়টি ড. ইউনূসের পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১৫টি সংস্কার কমিশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপারিশমালা প্রণয়ন করবে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে তা চূড়ান্ত করা হবে। এই প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, যাতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারণের প্রস্তাবটি তরুণদের নিয়ে ড. ইউনূসের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ এবং সংস্কারের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তবে এই প্রস্তাবনার কার্যকারিতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ভোটার হওয়ার বয়স কমানোর মাধ্যমে তরুণদের সম্পৃক্ত করা একটি সাহসী পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু এটি কিভাবে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। তরুণদের জন্য শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত, যা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির মহাসচিব, বলেছেন, সংস্কারের জন্য বেশি সময় ব্যয় করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তার বক্তব্যের মধ্যে যে একটি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে, তা হলো, সরকারের কাঠামোর মধ্যে সংস্কার প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর এবং কাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। ফখরুলের মতে, বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এমন এক কাঠামো বিদ্যমান, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধী দলের জন্য জায়গা কম এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা যথাযথভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি, অন্যদিকে তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংস্কারের পথকে সংকুচিত করছে।
অন্যদিকে, নাহিদ ইসলাম, সরকারের তথ্য উপদেষ্টা, রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন,’রাষ্ট্রের সংস্কার হলে সবাই ন্যায়বিচার পাবে।‘ তবে, তার ভাষায়, ‘যারা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।‘ এটা স্পষ্ট যে সরকার সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হলেও, কিছু কর্মকর্তা ও আমলাতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া আর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তার মতে, একত্রীকরণ এবং নির্বাচনি পরিবেশের সঠিক উন্নতি নিশ্চিত করতে না পারলে পরবর্তী নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে বিশৃঙ্খল এবং অস্থিতিশীল।
হোসেন জিল্লুর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, নির্বাচন এবং সংবিধান সংশোধন নিয়ে আরও গভীর আলোচনা করেছেন। তিনি নির্বাচনের আগে যে ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, যদি প্রশাসনিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকে, তাহলে নির্বাচনে জনগণের আস্থা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি সতর্ক করেন যে, রাজনৈতিক সংলাপের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়, বরং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।
এই বক্তব্যগুলো একে অপরকে পরিপূরক এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্র্নিমাণের একটি প্রয়োজনীয় দিক উন্মোচন করে। একদিকে রাজনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব, অন্যদিকে নির্বাচন ও নির্বাচনি পরিবেশের সঠিক বাস্তবায়ন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির কী হবে এবং এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দীর্ঘ সময় ধরে শাসনব্যবস্থার অস্থিতিশীলতার শিকার। সরকারি দল এবং বিরোধী দলদের মধ্যে দুর্বল সংলাপ এবং বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশকে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের সংস্কারের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে সরকারের কার্যকারিতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি সম্ভব হলেও, এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের প্রয়োজন। বিশেষত, সরকারের প্রশাসনিক সংস্কার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আমলাতন্ত্র এবং সরকারি প্রশাসনের এককেন্দ্রিকতা। যদিও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সংস্কারের পক্ষে, তাদের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করা কঠিন। নাহিদ ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, যারা আন্দোলনের নামে আমলাতন্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘন করছে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো যে আমলাতন্ত্র নিজেই এক শক্তিশালী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যা প্রবর্তিত সংস্কারের পক্ষে প্রতিবন্ধক।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং তাদের মৌলিক অধিকার ও জাতির ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে এক গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে যে ধরনের অস্থিরতা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংকটগুলোর সঙ্গে জনগণ পরিচিত, তা জনগণের ন্যায়বিচারের প্রতি গভীর অনীহা তৈরি করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যারা গণতন্ত্রের জন্য প্রথম প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল, এখন নির্বাচনি ব্যবস্থায় আরও স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দেখতে চায়। তারা শুধু নির্বাচন নয়, পুরো রাজনৈতিক পরিবেশে পরিবর্তন চায়। তাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশে গণতন্ত্র তখনই সফল হবে, যখন জনগণের সঠিক অধিকার নিশ্চিত হবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে।
সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনগণের মধ্যে পুনরায় আস্থা অর্জন করা। হোসেন জিল্লুর রহমান যেমন বলেছেন, “সরকারের চার-পাঁচ মাস হয়ে গেছে, কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা বলতে হবে।” সরকারকে সামনে রেখে একদিকে সংস্কার, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক অস্থিরতার কারণে সরকার যেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকার শুধু নিজের ভাবমূর্তি উন্নত করতে পারবে না, বরং দেশের শাসনব্যবস্থা ও জনগণের অধিকার সংরক্ষণও সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জে পূর্ণ, কিন্তু একইসঙ্গে সুযোগও রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সম্মিলিতভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর সংস্কার প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমঝোতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা অপরিহার্য। সরকারের স্বচ্ছতা, জনগণের ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা হলেই আসল পরিবর্তন আসবে।
লেখক: কলামিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক