প্রত্যাশা ডেস্ক: বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। দেড় দশক ধরে কঠোর কর্তৃত্ববাদী চর্চার মধ্যে থাকার পর নতুন ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করতে দেশটি আট মাসের বেশি সময় পেয়েছে।
পদ্ধতিগত সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজন এমন বিভিন্ন খাতের সংস্কারের সময় টেকসইভাবে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপেক্ষা করা উচিত নয়। এমন একটি কমিশন হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি)। এ কমিশন সংস্কার করা হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নজরদারি, প্রতিকার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
মানবাধিকার ও আইনের শাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা এবং সেগুলো মেনে চলা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারির জন্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এনএইচআরসির দৃশ্যমান ত্রুটি ছিল। এই সীমাবদ্ধতার কারণে জাতিসংঘের স্বীকৃতিদাতা সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অব ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনস (জিএএনএইচআরআই) কমিশনটিকে প্রাথমিক স্বীকৃতির পর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিলে টানা তৃতীয়বারের মতো ‘বি’ রেটিং দেয়। রেটিংয়ে এ অবস্থানের মানে হলো, এটি কেবল আংশিকভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গুরুত্বের বিষয়ে বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। গত দশকে যদি এই কমিশন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কাজ করত, যথেষ্ট দক্ষতা ও ইচ্ছাশক্তি নিয়ে গুমের ঘটনা তদন্ত করত এবং গোপন কারাগারগুলো পরিদর্শন করতে পারত, তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার মানুষগুলো প্রতিকারের একটা পথ খুঁজে পেত।
বস্তুত কমিশন ছিল অদক্ষ। গত বছরের জুলাইয়ের প্রতিবাদ আন্দোলনের সময় মানবাধিকার সুরক্ষায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে কমিশনের অক্ষমতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন ৩০ জুলাই এনএইচআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান বিক্ষোভকারীদের ওপর চলা হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পরিস্থিতিকে কেবল ‘দুর্ভাগ্যজনক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে সব কমিশনার একসঙ্গে পদত্যাগ করার পর থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পদগুলো শূন্য রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র তিন মাস পর এমনটা ঘটেছিল। কিন্তু শুধু নতুন কমিশনার নিয়োগ করলেই এই সংস্থাকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করানো সম্ভব হবে না। এ জন্য কমিশনের প্রতিষ্ঠাকালীন বিধান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ (এনএইচআরসি আইন)-এ অবশ্যই বেশ কিছু সংশোধন আনতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে, প্যারিস নীতিমালায় যার উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ও স্বাধীন হতে হবে। তবে বর্তমানে এনএইচআরসির সদস্য নিয়োগের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এসবের বিরোধী। সাত সদস্যের একটি মনোয়ন কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়, যার অধিকাংশ সদস্য শাসক দলের হয়ে থাকে।
কমিটিতে সংসদের স্পিকার, দুজন মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং একজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য থাকেন। এ নিয়োগপ্রক্রিয়াটি অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ হতে হবে। উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক পর্ষদের মডেল নেওয়া যেতে পারে। সেখানে পার্লামেন্ট থেকে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা থাকেন। এটি প্যারিস মূলনীতি সমুন্নত রাখার বিষয়টি তুলনামূলক ভালোভাবে নিশ্চিত করতে পারে।
প্যারিস নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বড় পরিসরের ম্যান্ডেট ও পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এতে এনএইচআরসি যেকোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত, তথ্য–প্রমাণ সংগ্রহ, সরকার ও নাগরিক সমাজের পক্ষগুলোর সঙ্গে কাজ করতে এবং তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল ও সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারবে। কিন্তু এনএইচআরসির এখনকার আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী ও সরকারি খাতের কর্মীদের আচরণের ওপর সংস্থাটির ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার নেই।
এ ধরনের দায়মুক্তি অবশ্যই বাতিল করতে হবে এবং সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সব সরকারি কর্তৃপক্ষকে এনএইচআরসির আওতায় আনা জরুরি।
প্যারিস নীতিমালা অনুসারে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অবশ্যই পর্যাপ্ত সম্পদ থাকতে হবে যাতে তারা স্বাধীনভাবে, বাইরের প্রভাব বা আর্থিক বিধিনিষেধের ভয়মুক্ত থেকে নিজেদের কাজ করতে পারে। এনএইচআরসি আইনে কমিশনের অর্থায়নের জন্য একটি ‘মানবাধিকার কমিশন তহবিল’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে এ তহবিল শুধু সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বার্ষিক অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলে। এই বিধানটি এনএইচআরসিকে সরকারি তহবিলের করুণার ওপর রাখে, যা যেকোনো সময় বাতিল করা যেতে পারে। তাই কমিশনের কার্য সম্পাদনের জন্য অবশ্যই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে বাধ্য করে জাতীয় বাজেট থেকে কমিশনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। এ বরাদ্দের ন্যূনতম পরিমাণ যাতে এনএইচআরসি বাতিলের ভয় ছাড়াই পেতে পারে তা নিশ্চিত করা হবে। যদিও এই সংশোধনীগুলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক পর্যাপ্ত নজরদারি নিশ্চিত করার সূচনা মাত্র। তবুও বাংলাদেশে এখন এবং ভবিষ্যতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের প্রতিকারের জন্য একটি দক্ষ, কার্যকর মানবাধিকার ব্যবস্থা তৈরিতে এ সংশোধনীগুলো অত্যন্ত জরুরি বিষয়।