ঢাকা ১১:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সংলাপের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু

সংস্কার করবেন আপনারা, রাজনীতিকদের প্রধান উপদেষ্টা

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৯:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৫০ বার পড়া হয়েছে

শনিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আজ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো।

শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস এ কথা বলেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। আমরা কেবল মাত্র সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি, আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম। এটা আমার কাজ না, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।

শনিবার বিকাল ৩টায় বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ বৈঠকে বসে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর তার প্রেস অফিস সাংবাদিকদের ভিডিও সরবরাহ করে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকে বহুল প্রতীক্ষিত একটা বৈঠকে একত্রিত হওয়াতে আমি আনন্দিত। বহুদিন ধরে যারা অপেক্ষা করছিলাম, দিন গুনছিলাম কবে আমরা বসবো।

আমাদের প্রতিজ্ঞা হলো আমরা যেন ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না করি। যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল, সেটা যেন পরবর্তী প্রজন্ম মনে রাখে। তিনি বলেন, তাদের আত্মত্যাগকে স্বরণ করে, আত্মত্যাগকে সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে তাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করব। সেটা নিয়েই আজকে আমাদের যাত্রা।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এটি কমিশনের প্রথম বৈঠক।

বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা রয়েছেন। আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারির নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই বৈঠকে অংশ নিচ্ছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।

নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছয় কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গেও কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন।

কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কথার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার দ্রুত করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করবে সরকার। এ জাতীয় সনদের ভিত্তিতে হবে নির্বাচন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাস শেষ হল, আমাদের প্রথম পর্ব শেষ আজকে। আমরা দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করলাম।

প্রথমটা ছিল প্রস্তুতি পর্ব, সেই প্রস্তুতি পর্বের অনেক কিছু আপনাদের কাছে জানা। তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল এই স্বপ্নের পিছনে যে আত্মত্যাগ, আমরা যেন এমন একটা দেশ করতে পারি, যেটা সুশৃঙ্খলভাবে চলবে। তিনি বলেন, যে আইনি কাঠামোর মাধ্যেমে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল, সেই কাঠামো থেকে যেন আমরা পূর্ণরূপে বের হয়ে আসতে পারি।

দেশকে একটা তামাশায় পরিণত করে ফেলা হয়েছিল মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আইন বলে কিছু নাই। এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য কী আইন কানুন লাগবে, কীভাবে আমরা অগ্রসর হব, সেই প্রশ্ন মাথায় রেখে আমরা কিছু সংস্কার করা শুরু করেছিলাম, অর্থাৎ সংস্কার করতে হবে।

সংস্কারগুলো যেন এমনভাবে হয় যেন আগামী প্রজন্ম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সেই প্রত্যাশা তুলে ধরে তিনি বলেন, উনারা (সংস্কার কমিশন) যে সমস্ত জিনিস প্রস্তাব করেছেন সেগুলো উনাদের অভিজ্ঞতা এবং উনাদের পাণ্ডিত্য এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এখন আমাদের কাজ তাদের প্রস্তাবের কতটুকু গ্রহণ করবো কীভাবে অগ্রসর হবো।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের অভিজ্ঞতা, আপনারা যেহেতু বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতা, আপনাদেরইৃ আপনাদেরকেই প্রতিনিয়ত এই আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সেজন্য আপনাদের আলোচনা করার জন্য দেওয়া হবে।

আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর রাষ্ট্র গঠন করার বিষয়ে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য না, একটা ঐক্যমতের মাধ্যমে হবে। সুযোগটা আমরা সবাই জানি, এটাকে গ্রহণ করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। এটা প্রচন্ড সুযোগ, এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারি।

সুযোগ কাজে লাগালে একটা সুন্দর দেশ পাওয়া যাবে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কেবল মাত্র সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। এক সঙ্গে আলোচনা করব, কমিশনের যারা আছেন তারা আপনাদের সঙ্গে বসবেন ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য, চাপিয়ে দেওয়ার জন্য না। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নাই। আমরা শুধু আপনাদের বোঝানোর জন্য, কেন করা হয়েছিল, কী কারণে করা হয়েছিল সেটা উপস্থাপন করা।

সংস্কারের পুরো সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটা আমার কাজ না, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনাদের বলতে হবে সমাজের কোন জায়গায় কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছি, চেষ্টা করেছি এটাকে কোনো রকমে সচল করার জন্য, কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু এই ছয় মাসের যে অভিজ্ঞতা এটা আমাদের প্রচণ্ড সাহস দেয়। এই ছয়মাসের অভিজ্ঞতা হল- দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষরা যে সমর্থন দিয়েছে। এটা বোল্ড অক্ষরে লেখা থাকবে যে আমরা একত্রিত হতে পারি। প্রথম ছয় মাস পার করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা যদি ঠিক থাকে, দ্বিতীয় অংশের জন্য কোনো চিন্তা নাই।

সবাই মিলে নতুন বাংলাদেশের গড়তে পারার বিষয়টি স্পষ্ট মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা একটা মস্ত বড় শক্তি যে প্রথম পর্বটা আমরা যেভাবে কাটালাম। এই কাটানোর মধ্যে যে সমস্ত শক্তি আমাদের ব্যহত করার চেষ্টা করেছে, আমাদেরকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকে সুন্দরভাবে সবাই মিলে মোকাবেলা করতে পেরেছি।

রাজনৈতিক দল, জনগণ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব-সব মিলে পৃথিবীজুড়ে বড় রকমের সমর্থন আছে দাবি করে তিনি বলেন, যে কারণে অপর পক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। পদে পদে ব্যহত হচ্ছে। শেষমেশ ট্রাম্পের হাতেই আবার…চালাতে গিয়ে চালাতে পারল না।

যত ছোট রাষ্ট্র, বড় রাষ্ট্র, ধনী রাষ্ট্র, মাঝারি রাষ্ট্র সবাই আমাদের সমর্থন দিয়েছে। কারো কোনো রকমের দ্বিধা নাই কোন প্রশ্ন নাই। প্রথমেই যখন কথা বলে তখন বলে কি লাগবে বলো আমরা আছি।

এমন সমর্থনের ভেতর দিয়ে যদি নতুন বাংলাদেশ গড়া না যায় তাহলে তা কপালের দোষ মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা এই সুযোগ ছাড়তে চাই না। আন্তর্জাতিক মহলেও আমাদের জিজ্ঞাস করে তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে আমরা সাহায্য করতে পারব, কিন্তু সংস্কারের কাজ তোমরা নিজেরাই করতে পার। না হলে এই যে আত্মত্যাগ তা টিকিয়ে রাখা যাবে না, আবার নতুন করে কেউ লণ্ডভণ্ড করে দিবে।

সংস্কারের সুপারিশমালাকে মুল্যবান সম্পদ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, এই যে আইন কানুন এটা ক্রিকেট খেলার মত, একবার আইন কানুন বানিয়ে দিলে চলতে থাকবে। আমাদের এখানে খেলায় না জিতলে কলকাটি নাড়ে, কলকাটি নাড়া ছাড়াও যে দেশ চলতে পারে সেটা দেখতে চাই।

‘আয়নাঘরের’ কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা সেদিন আয়না ঘরে গেলাম, মানুষ কত নির্মম হতে পারে, বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে, নির্মম দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে এর চেয়ে বড় নমুনা পাওয়া যাবে না।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।

বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন জমির উদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মশিউল আলম।

ইসলামী আন্দোলনের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। খেলাফতে মজলিশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন আমিরে মজলিশ মাওলানা আবদুল বাছিদ আজাদ ও মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের। মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে এবি পার্টির প্রতিনিধিরা বৈঠকে যোগ দেন।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আইন-বিবেক অনুযায়ী ডিসিদের কাজ করার নির্দেশনা আইন উপদেষ্টার

সংলাপের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু

সংস্কার করবেন আপনারা, রাজনীতিকদের প্রধান উপদেষ্টা

আপডেট সময় : ০৮:৪৯:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আজ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো।

শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস এ কথা বলেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। আমরা কেবল মাত্র সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি, আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম। এটা আমার কাজ না, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।

শনিবার বিকাল ৩টায় বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ বৈঠকে বসে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর তার প্রেস অফিস সাংবাদিকদের ভিডিও সরবরাহ করে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকে বহুল প্রতীক্ষিত একটা বৈঠকে একত্রিত হওয়াতে আমি আনন্দিত। বহুদিন ধরে যারা অপেক্ষা করছিলাম, দিন গুনছিলাম কবে আমরা বসবো।

আমাদের প্রতিজ্ঞা হলো আমরা যেন ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না করি। যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল, সেটা যেন পরবর্তী প্রজন্ম মনে রাখে। তিনি বলেন, তাদের আত্মত্যাগকে স্বরণ করে, আত্মত্যাগকে সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে তাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করব। সেটা নিয়েই আজকে আমাদের যাত্রা।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এটি কমিশনের প্রথম বৈঠক।

বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা রয়েছেন। আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারির নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই বৈঠকে অংশ নিচ্ছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।

নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছয় কমিশনের পুরো প্রতিবেদন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গেও কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন।

কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কথার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার দ্রুত করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করবে সরকার। এ জাতীয় সনদের ভিত্তিতে হবে নির্বাচন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাস শেষ হল, আমাদের প্রথম পর্ব শেষ আজকে। আমরা দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করলাম।

প্রথমটা ছিল প্রস্তুতি পর্ব, সেই প্রস্তুতি পর্বের অনেক কিছু আপনাদের কাছে জানা। তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল এই স্বপ্নের পিছনে যে আত্মত্যাগ, আমরা যেন এমন একটা দেশ করতে পারি, যেটা সুশৃঙ্খলভাবে চলবে। তিনি বলেন, যে আইনি কাঠামোর মাধ্যেমে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল, সেই কাঠামো থেকে যেন আমরা পূর্ণরূপে বের হয়ে আসতে পারি।

দেশকে একটা তামাশায় পরিণত করে ফেলা হয়েছিল মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আইন বলে কিছু নাই। এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য কী আইন কানুন লাগবে, কীভাবে আমরা অগ্রসর হব, সেই প্রশ্ন মাথায় রেখে আমরা কিছু সংস্কার করা শুরু করেছিলাম, অর্থাৎ সংস্কার করতে হবে।

সংস্কারগুলো যেন এমনভাবে হয় যেন আগামী প্রজন্ম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সেই প্রত্যাশা তুলে ধরে তিনি বলেন, উনারা (সংস্কার কমিশন) যে সমস্ত জিনিস প্রস্তাব করেছেন সেগুলো উনাদের অভিজ্ঞতা এবং উনাদের পাণ্ডিত্য এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এখন আমাদের কাজ তাদের প্রস্তাবের কতটুকু গ্রহণ করবো কীভাবে অগ্রসর হবো।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের অভিজ্ঞতা, আপনারা যেহেতু বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতা, আপনাদেরইৃ আপনাদেরকেই প্রতিনিয়ত এই আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সেজন্য আপনাদের আলোচনা করার জন্য দেওয়া হবে।

আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর রাষ্ট্র গঠন করার বিষয়ে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য না, একটা ঐক্যমতের মাধ্যমে হবে। সুযোগটা আমরা সবাই জানি, এটাকে গ্রহণ করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। এটা প্রচন্ড সুযোগ, এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারি।

সুযোগ কাজে লাগালে একটা সুন্দর দেশ পাওয়া যাবে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কেবল মাত্র সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। এক সঙ্গে আলোচনা করব, কমিশনের যারা আছেন তারা আপনাদের সঙ্গে বসবেন ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য, চাপিয়ে দেওয়ার জন্য না। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নাই। আমরা শুধু আপনাদের বোঝানোর জন্য, কেন করা হয়েছিল, কী কারণে করা হয়েছিল সেটা উপস্থাপন করা।

সংস্কারের পুরো সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপনের বিষয়টি তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটা আমার কাজ না, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনাদের বলতে হবে সমাজের কোন জায়গায় কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছি, চেষ্টা করেছি এটাকে কোনো রকমে সচল করার জন্য, কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু এই ছয় মাসের যে অভিজ্ঞতা এটা আমাদের প্রচণ্ড সাহস দেয়। এই ছয়মাসের অভিজ্ঞতা হল- দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ সাধারণ মানুষরা যে সমর্থন দিয়েছে। এটা বোল্ড অক্ষরে লেখা থাকবে যে আমরা একত্রিত হতে পারি। প্রথম ছয় মাস পার করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা যদি ঠিক থাকে, দ্বিতীয় অংশের জন্য কোনো চিন্তা নাই।

সবাই মিলে নতুন বাংলাদেশের গড়তে পারার বিষয়টি স্পষ্ট মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা একটা মস্ত বড় শক্তি যে প্রথম পর্বটা আমরা যেভাবে কাটালাম। এই কাটানোর মধ্যে যে সমস্ত শক্তি আমাদের ব্যহত করার চেষ্টা করেছে, আমাদেরকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকে সুন্দরভাবে সবাই মিলে মোকাবেলা করতে পেরেছি।

রাজনৈতিক দল, জনগণ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব-সব মিলে পৃথিবীজুড়ে বড় রকমের সমর্থন আছে দাবি করে তিনি বলেন, যে কারণে অপর পক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। পদে পদে ব্যহত হচ্ছে। শেষমেশ ট্রাম্পের হাতেই আবার…চালাতে গিয়ে চালাতে পারল না।

যত ছোট রাষ্ট্র, বড় রাষ্ট্র, ধনী রাষ্ট্র, মাঝারি রাষ্ট্র সবাই আমাদের সমর্থন দিয়েছে। কারো কোনো রকমের দ্বিধা নাই কোন প্রশ্ন নাই। প্রথমেই যখন কথা বলে তখন বলে কি লাগবে বলো আমরা আছি।

এমন সমর্থনের ভেতর দিয়ে যদি নতুন বাংলাদেশ গড়া না যায় তাহলে তা কপালের দোষ মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা এই সুযোগ ছাড়তে চাই না। আন্তর্জাতিক মহলেও আমাদের জিজ্ঞাস করে তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে আমরা সাহায্য করতে পারব, কিন্তু সংস্কারের কাজ তোমরা নিজেরাই করতে পার। না হলে এই যে আত্মত্যাগ তা টিকিয়ে রাখা যাবে না, আবার নতুন করে কেউ লণ্ডভণ্ড করে দিবে।

সংস্কারের সুপারিশমালাকে মুল্যবান সম্পদ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, এই যে আইন কানুন এটা ক্রিকেট খেলার মত, একবার আইন কানুন বানিয়ে দিলে চলতে থাকবে। আমাদের এখানে খেলায় না জিতলে কলকাটি নাড়ে, কলকাটি নাড়া ছাড়াও যে দেশ চলতে পারে সেটা দেখতে চাই।

‘আয়নাঘরের’ কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা সেদিন আয়না ঘরে গেলাম, মানুষ কত নির্মম হতে পারে, বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে, নির্মম দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে এর চেয়ে বড় নমুনা পাওয়া যাবে না।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।

বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন জমির উদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মশিউল আলম।

ইসলামী আন্দোলনের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। খেলাফতে মজলিশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন আমিরে মজলিশ মাওলানা আবদুল বাছিদ আজাদ ও মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের। মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে এবি পার্টির প্রতিনিধিরা বৈঠকে যোগ দেন।