ঢাকা ০৯:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সংবিধান যদি বাতিল বা স্থগিত করা হয়

  • আপডেট সময় : ০৫:১৪:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

কাওসার আহ্মেদ : সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সংবিধান বাতিল করা হয়েছিল। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে দেশের বর্তমান সংবিধান গৃহীত হয়। অতঃপর, ১৯৭৫ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করে এটিকে সামরিক আইনের অধীন করা হয়। এরপর, ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় দফায় সামরিক শাসন জারি করা হলে সংবিধান সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করা হয়।

সম্প্রতি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে প্রায়ই বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম এই দাবি উত্থাপন করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমী, যিনি গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনসহ একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান জানান। পরবর্তীতে ২৩ অক্টোবর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন শীর্ষ সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিলের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

এর ধারাবাহিতায়, ২৩ নভেম্বর সংবিধান সংস্কারবিষয়ক এক গোল টেবিল আলোচনায় এবি পার্টির মহাসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সংবিধান বদলে ফেলার পক্ষে যুক্তি দেন। এ বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদ গঠনের আহ্বান জানান। এবং পরদিন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য-সচিব আখতার হোসেন এক সাক্ষাৎকারে সংবিধান বাতিলের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। সর্বোপরি, ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার মন্তব্য করেন, [প্রস্তাবিত] জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণায় ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান যদি বাতিল বা স্থগিত করা হয়, তবে তা দেশের আইনি কাঠামোয় সম্ভাব্য কী পরিবর্তন আনতে পারে, তা এই নিবন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।
প্রথমত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের তিনটি মৌলিক অঙ্গ—আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ, যেমন নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন ইত্যাদির সাংবিধানিক অস্তিত্বের অবসান ঘটবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের উল্লিখিত কোনো অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য সংবিধানে বর্ণিত পদগুলো যথা- রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, অ্যাটর্নি জেনারেল প্রভৃতি তৎক্ষণাৎ অবলুপ্ত হয়ে যাবে। এর ফলস্বরূপ, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের কর্তৃত্ব কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়বে। উপমাগতভাবে, এরকম পরিস্থিতি প্রখ্যাত অধ্যাপক লন এল. ফুলারের কল্পিত সর্বশক্তিমান রাজা ‘রেক্স’-এর শাসনের সঙ্গে তুলনীয়, যিনি এককভাবে রাষ্ট্রের আইন-প্রণয়ন, নির্বাহী এবং বিচার-বিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করেন (দ্য মোর‌্যালিটি অব ল’)।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকারী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী সরাসরি আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা অধিগত করে এবং বিচার বিভাগ পূর্বোক্তের অনুবর্তী হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। কারণ সংবিধানের অবর্তমানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আইনগত বৈধতা অথবা কোনো কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে আদালতে কোনো কার্যধারা আনয়ন করা সম্ভব হয় না।

প্রসঙ্গত, ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে সামরিক ফরমান (মার্শাল ল’ প্রক্লেমেশন) জারি করে পাকিস্তানের তৎকালীন সংবিধান রদ করা হলে যথাক্রমে ল’জ (কনটিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার, ১৯৫৮ এবং প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন অর্ডার, ১৯৬৯ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ কতিপয় সাংবিধানিক পদগুলোর কার্যকারিতা অব্যাহত রাখা হয়। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে প্রথম সামরিক শাসনামলে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে রহিত না করে সামরিক আইনের অধীন করার মাধ্যমে সাংবিধানিক পদগুলোর কার্যকারিতা অব্যাহত রাখা হয়। ফলে সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তার মর্যাদা হারায়। পক্ষান্তরে ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বার সামরিক শাসনামলে সংবিধান সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করা হলে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, এবং অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক পদসমূহের কার্যকারিতা বজায় রাখা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব হারানো বা স্থগিত কিংবা রহিত হওয়ার পরও যদি সাংবিধানিক পদসমূহ বহাল থাকে, তখন স্বভাবিকভাবেই তাদের সাংবিধানিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে না। এর কারণ হলো সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানের অবর্তমানে, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষেত্রে সংবিধানে নির্ধারিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, রক্ষাকবচ ও প্রক্রিয়া অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। ফলে এসব পদে নিয়োগ ও অপসারণ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশন: ট্রেন্ডস অ্যান্ড ইস্যুজ’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, সামরিক শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনও কখনও সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম যোগ্যতা অনুসরণ করা হয়নি। উক্ত গ্রন্থে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, কিছু ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ করা হয়েছে।

যেমন- ১৯৮২ সালে প্রধান সামরিক প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক আইনের ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি কে এম সোবহানকে অপসারণ করেন।
দ্বিতীয়ত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে মৌলিক অধিকারসহ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা রহিত হবে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিক ও ব্যক্তির ন্যূনতম মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। এসকল অধিকারসমূহের মধ্যে রয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, গ্রেফতার, আটক ও বিচার সম্পর্কিত সুরক্ষা, মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের অধিকার, সভা-সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি।

অধিকন্তু, সংবিধানের ২৬, ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রের কোনো কার্য বা আইন যদি মৌলিক অধিকারের অসামঞ্জস্য হয়, তবে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল ঘোষণা করার এখতিয়ার রাখে। অতএব, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো কার্য বা আইন আদালতের মাধ্যমে বাতিল করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না ।
তৃতীয়ত, মৌলিক মানবাধিকার প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ জাতিসংঘ স্বীকৃত মানবাধিকারবিষয়ক নয়টি মৌলিক সনদের প্রতিটিতে সদস্য হয়েছে। এই মানবাধিকার সনদগুলো মূলত আন্তর্জাতিক চুক্তি বা ট্রিটি। যেসব দেশ আন্তর্জাতিক আইনের অভ্যন্তরীণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বৈতবাদ তথা ড্যুয়োলিজম অনুসরণ করে, সেসব দেশে আন্তর্জাতিক চুক্তি হতে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব মেনে চলার জন্য রাষ্ট্র-প্রণীত আইনের প্রয়োজন হয়। যেহেতু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের অভ্যন্তরীণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বৈতবাদ (ড্যুয়োলিজম) অনুসরণ করে, তাই উল্লিখিত মানবাধিকারবিষয়ক সনদগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব আইনের মাধ্যমে বলবৎ করা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহের মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে পূর্বোক্ত মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন মৌলিক সনদ, যথা—আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক সনদ (আইসিসিপিআর), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক সনদ (আইসিইএসসিআর) এবং টর্চারবিরোধী সনদ (ইউএনক্যাট) প্রভৃতির বিভিন্ন বিধান কার্যকর করা হয়। এখন, যদি সংবিধান বাতিল বা স্থগিত হওয়ার দরুন মৌলিক অধিকার আইনের মর্যাদা হারায়, তবে বাংলাদেশ কর্তৃক মৌলিক মানবাধিকার সনদসমূহ মেনে চলার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এমতাবস্থায়, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার অবর্তমানে মৌলিক মানবাধিকার সনদসমূহ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে যে অপারগতার উদ্ভব হবে তা বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইনগত দায়ের কারণ হতে পারে।

চতুর্থত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে’ নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ তাদের কর্মের জন্য প্রযোজ্য সংবিধান কর্তৃক প্রতিশ্রুত রক্ষাকবচ থেকে বঞ্চিত হবেন। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অনুসারে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত পদে বহাল থাকার অধিকার, সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন অথবা তার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধির আওতায় নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ, এবং অধস্তন কর্তৃপক্ষের দ্বারা বরখাস্ত, অপসারণ বা পদাবনতির শিকার না হওয়ার নিশ্চয়তা সহ যেকোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর সুযোগ পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি। ফলত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে, প্রজাতন্ত্রের কর্মের শর্ত নির্ধারণে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছাই প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠবে—এমন অনুমান করা অসংগত হবে না।

অনুরূপভাবে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত হলে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর অভিভাবকত্ব হারাবে; পাশাপাশি, এসমস্ত আদালতে কর্মরত বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের বাধ্যবাধকতারও অবসান ঘটবে।

পঞ্চমত, সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি সংবিধান-সংশোধনীর ওপর গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করেছে। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর, হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সেইসব বিধান বাতিল করেছে, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোট পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এর ফলে, দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের একটি পথ উন্মুক্ত হয়েছে এবং সংবিধানের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সংশোধন আনয়নের জন্য গণভোটের বিধান পুনঃস্থাপিত হয়েছ। ইতোপূর্বে, ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর, আপিল বিভাগ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের প্রক্রিয়া হিসেবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থার পুনর্বহাল নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনকারী সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে উচ্চ আদালতের এসব রায় বা সিদ্ধান্ত তাদের আইনগত প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে।
পূর্বোল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আর তা হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান। প্রতীয়মান হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্য এই সরকারের আইনগত (ডি জ্যুরে) বৈধতা স্বীকার করে একে একটি সাংবিধানিক সরকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে এর একটি কারণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। তবে যদি সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো কোনো সদস্যের দৃষ্টিতে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের আইনগত (ডি জ্যুরে) বৈধতার পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটি শুধুমাত্র কার্যকরী (ডি ফ্যাক্টো) সরকার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আয়নাঘরের পরতে পরতে নির্যাতনের চিহ্ন

সংবিধান যদি বাতিল বা স্থগিত করা হয়

আপডেট সময় : ০৫:১৪:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

কাওসার আহ্মেদ : সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সংবিধান বাতিল করা হয়েছিল। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে দেশের বর্তমান সংবিধান গৃহীত হয়। অতঃপর, ১৯৭৫ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করে এটিকে সামরিক আইনের অধীন করা হয়। এরপর, ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় দফায় সামরিক শাসন জারি করা হলে সংবিধান সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করা হয়।

সম্প্রতি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপক গণ-বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে প্রায়ই বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে। সর্বপ্রথম এই দাবি উত্থাপন করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমী, যিনি গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনসহ একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান জানান। পরবর্তীতে ২৩ অক্টোবর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন শীর্ষ সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিলের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

এর ধারাবাহিতায়, ২৩ নভেম্বর সংবিধান সংস্কারবিষয়ক এক গোল টেবিল আলোচনায় এবি পার্টির মহাসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ সংবিধান বদলে ফেলার পক্ষে যুক্তি দেন। এ বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদ গঠনের আহ্বান জানান। এবং পরদিন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য-সচিব আখতার হোসেন এক সাক্ষাৎকারে সংবিধান বাতিলের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। সর্বোপরি, ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার মন্তব্য করেন, [প্রস্তাবিত] জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণায় ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান যদি বাতিল বা স্থগিত করা হয়, তবে তা দেশের আইনি কাঠামোয় সম্ভাব্য কী পরিবর্তন আনতে পারে, তা এই নিবন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।
প্রথমত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের তিনটি মৌলিক অঙ্গ—আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ, যেমন নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন ইত্যাদির সাংবিধানিক অস্তিত্বের অবসান ঘটবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের উল্লিখিত কোনো অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য সংবিধানে বর্ণিত পদগুলো যথা- রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, অ্যাটর্নি জেনারেল প্রভৃতি তৎক্ষণাৎ অবলুপ্ত হয়ে যাবে। এর ফলস্বরূপ, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের কর্তৃত্ব কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়বে। উপমাগতভাবে, এরকম পরিস্থিতি প্রখ্যাত অধ্যাপক লন এল. ফুলারের কল্পিত সর্বশক্তিমান রাজা ‘রেক্স’-এর শাসনের সঙ্গে তুলনীয়, যিনি এককভাবে রাষ্ট্রের আইন-প্রণয়ন, নির্বাহী এবং বিচার-বিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করেন (দ্য মোর‌্যালিটি অব ল’)।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকারী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী সরাসরি আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা অধিগত করে এবং বিচার বিভাগ পূর্বোক্তের অনুবর্তী হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। কারণ সংবিধানের অবর্তমানে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আইনগত বৈধতা অথবা কোনো কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে আদালতে কোনো কার্যধারা আনয়ন করা সম্ভব হয় না।

প্রসঙ্গত, ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে সামরিক ফরমান (মার্শাল ল’ প্রক্লেমেশন) জারি করে পাকিস্তানের তৎকালীন সংবিধান রদ করা হলে যথাক্রমে ল’জ (কনটিনিউয়েন্স ইন ফোর্স) অর্ডার, ১৯৫৮ এবং প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন অর্ডার, ১৯৬৯ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ কতিপয় সাংবিধানিক পদগুলোর কার্যকারিতা অব্যাহত রাখা হয়। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে প্রথম সামরিক শাসনামলে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে রহিত না করে সামরিক আইনের অধীন করার মাধ্যমে সাংবিধানিক পদগুলোর কার্যকারিতা অব্যাহত রাখা হয়। ফলে সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে তার মর্যাদা হারায়। পক্ষান্তরে ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বার সামরিক শাসনামলে সংবিধান সম্পূর্ণরূপে স্থগিত করা হলে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, এবং অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক পদসমূহের কার্যকারিতা বজায় রাখা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব হারানো বা স্থগিত কিংবা রহিত হওয়ার পরও যদি সাংবিধানিক পদসমূহ বহাল থাকে, তখন স্বভাবিকভাবেই তাদের সাংবিধানিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে না। এর কারণ হলো সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানের অবর্তমানে, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষেত্রে সংবিধানে নির্ধারিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, রক্ষাকবচ ও প্রক্রিয়া অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। ফলে এসব পদে নিয়োগ ও অপসারণ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশন: ট্রেন্ডস অ্যান্ড ইস্যুজ’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, সামরিক শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনও কখনও সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম যোগ্যতা অনুসরণ করা হয়নি। উক্ত গ্রন্থে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, কিছু ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ করা হয়েছে।

যেমন- ১৯৮২ সালে প্রধান সামরিক প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক আইনের ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি কে এম সোবহানকে অপসারণ করেন।
দ্বিতীয়ত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে মৌলিক অধিকারসহ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা রহিত হবে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিক ও ব্যক্তির ন্যূনতম মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। এসকল অধিকারসমূহের মধ্যে রয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, গ্রেফতার, আটক ও বিচার সম্পর্কিত সুরক্ষা, মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের অধিকার, সভা-সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা ইত্যাদি।

অধিকন্তু, সংবিধানের ২৬, ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রের কোনো কার্য বা আইন যদি মৌলিক অধিকারের অসামঞ্জস্য হয়, তবে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল ঘোষণা করার এখতিয়ার রাখে। অতএব, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো কার্য বা আইন আদালতের মাধ্যমে বাতিল করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না ।
তৃতীয়ত, মৌলিক মানবাধিকার প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ জাতিসংঘ স্বীকৃত মানবাধিকারবিষয়ক নয়টি মৌলিক সনদের প্রতিটিতে সদস্য হয়েছে। এই মানবাধিকার সনদগুলো মূলত আন্তর্জাতিক চুক্তি বা ট্রিটি। যেসব দেশ আন্তর্জাতিক আইনের অভ্যন্তরীণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বৈতবাদ তথা ড্যুয়োলিজম অনুসরণ করে, সেসব দেশে আন্তর্জাতিক চুক্তি হতে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব মেনে চলার জন্য রাষ্ট্র-প্রণীত আইনের প্রয়োজন হয়। যেহেতু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের অভ্যন্তরীণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বৈতবাদ (ড্যুয়োলিজম) অনুসরণ করে, তাই উল্লিখিত মানবাধিকারবিষয়ক সনদগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব আইনের মাধ্যমে বলবৎ করা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহের মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে পূর্বোক্ত মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন মৌলিক সনদ, যথা—আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক সনদ (আইসিসিপিআর), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক সনদ (আইসিইএসসিআর) এবং টর্চারবিরোধী সনদ (ইউএনক্যাট) প্রভৃতির বিভিন্ন বিধান কার্যকর করা হয়। এখন, যদি সংবিধান বাতিল বা স্থগিত হওয়ার দরুন মৌলিক অধিকার আইনের মর্যাদা হারায়, তবে বাংলাদেশ কর্তৃক মৌলিক মানবাধিকার সনদসমূহ মেনে চলার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এমতাবস্থায়, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার অবর্তমানে মৌলিক মানবাধিকার সনদসমূহ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে যে অপারগতার উদ্ভব হবে তা বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইনগত দায়ের কারণ হতে পারে।

চতুর্থত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে’ নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ তাদের কর্মের জন্য প্রযোজ্য সংবিধান কর্তৃক প্রতিশ্রুত রক্ষাকবচ থেকে বঞ্চিত হবেন। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অনুসারে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত পদে বহাল থাকার অধিকার, সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন অথবা তার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধির আওতায় নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ, এবং অধস্তন কর্তৃপক্ষের দ্বারা বরখাস্ত, অপসারণ বা পদাবনতির শিকার না হওয়ার নিশ্চয়তা সহ যেকোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর সুযোগ পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি। ফলত, সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে, প্রজাতন্ত্রের কর্মের শর্ত নির্ধারণে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছাই প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠবে—এমন অনুমান করা অসংগত হবে না।

অনুরূপভাবে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত হলে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর অভিভাবকত্ব হারাবে; পাশাপাশি, এসমস্ত আদালতে কর্মরত বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের বাধ্যবাধকতারও অবসান ঘটবে।

পঞ্চমত, সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি সংবিধান-সংশোধনীর ওপর গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করেছে। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর, হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সেইসব বিধান বাতিল করেছে, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোট পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এর ফলে, দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের একটি পথ উন্মুক্ত হয়েছে এবং সংবিধানের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সংশোধন আনয়নের জন্য গণভোটের বিধান পুনঃস্থাপিত হয়েছ। ইতোপূর্বে, ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর, আপিল বিভাগ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের প্রক্রিয়া হিসেবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থার পুনর্বহাল নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনকারী সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হলে উচ্চ আদালতের এসব রায় বা সিদ্ধান্ত তাদের আইনগত প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে।
পূর্বোল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আর তা হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান। প্রতীয়মান হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্য এই সরকারের আইনগত (ডি জ্যুরে) বৈধতা স্বীকার করে একে একটি সাংবিধানিক সরকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে এর একটি কারণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। তবে যদি সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো কোনো সদস্যের দৃষ্টিতে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের আইনগত (ডি জ্যুরে) বৈধতার পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটি শুধুমাত্র কার্যকরী (ডি ফ্যাক্টো) সরকার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট