নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্র সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে প্রথম ধাপের ছয় সংস্কার কমিশনের চারটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। কমিশনগুলো হলো-সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।
এতে সংবিধানের সংস্কারে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মতো সুপারিশ রয়েছে।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের প্রধান ও অন্য সদস্যরা প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন।
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত এই সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলে আসছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন।
এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। বাকি চারটি কমিশনের প্রতিবেদন বুধবার জমা দেওয়া হলো।
সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে।
এ মাসেই আলোচনা শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে যেসব প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। প্রস্তাবগুলো কবে, কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা হবে, তার একটি রূপরেখা আসতে পারে দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার মাধ্যমে।
সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম বদলের সুপারিশ: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি সংবিধানের সংস্কারে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মত সুপারিশ রয়েছে।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ওই প্রতিবেদন জমা দেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে তিনি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের সুপারিশগুলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
আলী রীয়াজ বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।
বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রয়েছে।
সেই মূলনীতির আলোকে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ করাকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে হয়েছে সংবিধানে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সুপারিশ প্রতিবেদন করার কথা তুলে ধরেন সংস্কার কমিশনের প্রধান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটায় আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের পরিচিত হওয়া উচিত ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’।
মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণের বিষয়ে সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের শিক্ষক আলী রীয়াজ বলেন, শুধু তাই নয়, আমরা সাংবিধানিকভাবে তার সুরক্ষা এবং তা যেন বলবতযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য একটা সমন্বিত একক সনদের কথা বলেছি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা জানান আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনের পেছনে আছে প্রায় এক লাখ লোকের মতামত; রাজনৈতিক দলগুলোর অবদান, আছে নাগরিক সমাজের অবদান এবং আছে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মত।
আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট- কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা সংবিধানের যে ধারাগুলোর, যে বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার সেগুলো আমরা বলেছি।
সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যের আশা করে তিনি বলেন, একটা ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।
এদিকে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধানের প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘Republic’ ও ‘Peoples Republic of Bangladesh’ শব্দগুলো থাকছে।
সুপারিশে বলা হয়, ভাষা নাগরিকতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা হবে ‘বাংলা’। সংবিধানে বাংলাদেশে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত সকল ভাষা এ দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
নাগরিকত্ব ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি…’ কমিশন এ বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে আলী রীয়াজ কমিশন।
সুপারিশে বলা হয়, বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) নিম্নোক্তভাবে সংশোধন করা হোক “বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন” হিসেবে প্রতিস্থাপিত হোক।
দ্বিকক্ষের সংসদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল: সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা সুপারিশে তুলে ধরার কথা বলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব করার কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, এ দু কক্ষ মিলে যাতে সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, তার জন্য একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছি।
আলী রীয়াজ বলেন, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে ‘একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র মোকাবেলা করেছে’, তার একটা বড় কারণ ছিল ক্ষমতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না।
সেই কারণে যাতে কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ এবং নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয় হিসাবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছি।
রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদের দুকক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারদের পাশাপাশি অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বকারী একজনকে এই কাউন্সিলে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে পারবে বলে মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, এটা খুব সুস্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করার জন্যই এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করতে না পারেন, সেজন্য আমরা এগুলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করার সুপারিশ করেছি।
প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফেরানোর অংশ হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীক কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করার কথা বলেন তিনি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া দরকার, সে ব্যবস্থা করা দরকার। সে কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যাতে প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য আমরা তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছি।
নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। এক ধরনের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্য দিয়ে যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আমরা সেই সুপারিশ করেছি।
প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে সাংবিধানিক কাউন্সিল: নির্বাচনকালীন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে ‘সুস্পষ্ট কাঠামোর’ পরামর্শ প্রতিবেদনে দেওয়ার কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক নয়।
সে কারণে আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে এই বাছাই প্রক্রিয়া অর্পণ করেছি বা সুপারিশ করেছি। আমরা আশা করছি, সেটা সম্ভব হবে।
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে বিভাগীয় শহরে হাই কোর্টের এখতিয়ার ও মর্যাদাসম্পন্ন আদালত স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে সুগম এবং যথাসাধ্য মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে, কমিশন মনে করে, বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার।
আমরা সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখেই দেশের সকল বিভাগীয় শহরে হাই কোর্ট বিভাগের এখতিয়ার এবং মর্যাদাসম্পন্ন একটি স্থায়ী আসনের সুপারিশ করেছি।
‘শক্তিশালী’ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে ‘সমন্বয় কাউন্সিল’ গঠনের সুপারিশ করার কথা জানান তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, শুধু কমিশনের সদস্যরাই নন, অংশীজন যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের সকলেই প্রায় জোর দিয়ে বলেছেন, শক্তিশালীভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
সেজন্য আমরা স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছি। আমরা জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছি।