ঢাকা ১২:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি কি সংবিধানসম্মত?

  • আপডেট সময় : ০৯:৫১:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২১
  • ১১৭ বার পড়া হয়েছে

এম এম খালেকুজ্জামান : শব্দ বিশ্বে আমাদের বাস। শব্দ দিয়ে শাসন করা যায়। শব্দ দিয়ে স্তব্ধ করা যায়। আবার শাসকগণ শাসনের স্বার্থে কিছু শব্দকে জব্দ করতে চান, কিছু শব্দের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এসব হচ্ছে এই সময়ের বাস্তবতা। শব্দের সম্ভবনা প্রায় অসীম সে সম্মিলিত স্লোগানেই হোক কিংবা গণমাধ্যমে লেখা সংবাদ বা সংবাদভাষ্যে হোক। হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও এখন সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতে হবে। শব্দ দাবানল ঘটাতে পারে আবার নেভাতেও পারে।
একাডেমিক কনস্টিটিউশনাল গতিধারা চালু রাখেন একডেমিশিয়ানরা আর উচ্চ আদালতে ইন্টারপ্রিটেশান অফ স্ট্যাটিউট-এর মাধ্যমে আইনের চলমানতা জারি রাখেন আইনজীবীগণ। শ্বাশত স্থিতি কিংবা সাম্প্রতিক পরিবর্তন সম্বন্ধে জানতে পারঙ্গম কারো সহায়তা নিতে হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি আবার নতুন করে কানে লাগল। সংবিধানে এর উপস্থিতি বিষয়ে জানতে আইনজীবী ও সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবালের শরণ নেই, জানতে চাই সংবিধানে এর উপস্থিতি নিয়ে। আলোচনার প্রেক্ষিতে তিনি তার সুচিন্তিত মত সামাজিক মাধ্যমে উন্মুক্ত করেন, তার চুম্বক অংশ-
‘দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের নানা বিষয় নিয়ে পড়ি-লিখি; একটা উচ্চতর ডিগ্রিও হয়েছে! কিন্তু কখনো সংখ্যালঘু শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয়নি; উল্টো সংবিধানে সকল নাগরিক সমান বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক সংবিধানেও এমন শব্দ দেখিনি। এর অর্থ হলো শব্দটা অসাংবিধানিক। তেমনটিই হওয়ার কথা। বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করেছে; যদিও ২-ক অনুচ্ছেদে একটা রাষ্ট্রধর্মের কথা আছে! রাষ্ট্রের ধর্ম বিষয়টিই গোলমেলে, সে তো ব্যক্তি নয়। একটা অসাংবিধানিক শব্দ কি করে নানাভাবে ব্যবহার হয় তা ভাবা উচিত। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকদের সমান মর্যাদা দিয়েছে; সুতরাং এখানে সকল নাগরিক সমান কেউ সংখ্যালঘু নন। এ সকল অসাংবিধানিক শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে সকল ধর্ম পালনের পরিবেশ নির্বিঘœ করতে হবে।’
এই ভূখ-ে সংবিধান হচ্ছে সেই মৌলিক বিধি সমষ্টি যা জীবন প্রণোদনার উৎসমুখ। শব্দ বা শব্দাবলী সংবিধানের কষ্ঠি পাথরে (যদিও এই পাথরে অনেক সংশোধনের কাটাকুটি) যাচাই করে ব্যবহার করা উচিত। হেয় প্রতিপন্ন করে এমন শব্দ ব্যবহার না করতে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধর্ষিতা শব্দটি লিঙ্গ বৈষম্যের পরিচায়ক বলে বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছে এর প্রেক্ষিতে গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের পূর্বে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দবন্ধ দিয়ে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হয়, সে অনুযায়ী মূল আইনের ৯(২) ধারাসহ প্রয়োজনীয় জায়গায় ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দ বসিয়ে আইন পাশ হয়। এছাড়া সংসদে দেয়া অসাংবিধানিক শব্দাবলী এক্সপাঞ্জ করার অনুশীলন তো আমরা দেখি প্রায়শই।
মোটা দাগে কোনো শব্দকে অসাংবিধানিক না বললেও, অসংবেদনশীল শব্দে অপমানিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে এমন শব্দ ব্যবহার না করাই শ্রেয়। আমাদের দেশে মুসলিম ভিন্ন অন্য ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় বোঝাতে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মনোভঙ্গী বোঝা যায়। ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহারে এমন একটা ভাব থাকে যেন সংখ্যাগুরুর অনুমোদনের উপর নির্ভরশীল অন্য ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী। সংবিধান কিন্তু তা বলে না। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোর সাধারণ পাঠেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
অনুচ্ছেদ ২(ক) প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। কিংবা অনুচ্ছেদ ১২ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা (এটি আবার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অন্তর্ভূক্ত)। অনুচ্ছেদ ৪১(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;
(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।
(২) কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।
প্রাসঙ্গিক যে অনুচ্ছেদগুলোতে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা যেত সেখানে করা হয়নি সচেতনভাবেই। প্রতিহিংসার চর্চা রোধ করা সম্ভব হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর (তিনি সে সময় লিডার অফ দ্য হাউস ছিলেন) নেতৃত্বে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সংবিধান প্রণেতাগণ সম্প্রীতি সহায়ক বিবেচনায় পূর্বানুমানযোগ্য আইনি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠের দম্ভ নিয়ে চাইলেই সংখ্যালঘুর মতো শব্দে কাউকে পৃথক করা যায়? যেন নীচের তলার মানুষের প্রতি উঁচু জাতের দৃষ্টিভঙ্গি, এর মধ্যে আইডেন্টিটি বা সত্তার একটা প্রশ্ন আছে। আমি বনাম অন্য বা অপররের দ্যোতনা সৃষ্টি করে।
‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি সংবিধানসম্মত কিনা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে এ কারণে সরকারও চায় সংবিধানসম্মত শব্দ ব্যবহার করা হোক। প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ইনভার্টেড কমার ভেতরে থাকা বিজ্ঞপ্তিটি ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অতএব, আগামী ৯ আগস্ট ২০১৫ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস এ সংবিধানসম্মত শব্দ চয়নের ব্যাপারে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা (জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ) এবং ইলেট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়া কর্তৃপক্ষকে পূর্বেই এ ব্যাপারে পরামর্শ /স্বরনিকা প্রদান করা হয়েছে।’ অর্থাৎ সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতা মেনে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছে। সে বিবেচনায় ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের ব্যবহার ভেবে দেখা উচিত।
গত কদিনের ভাংচূর, আগুনের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এ যেন প্যাথলজিক্যাল হেইট্রেডের (যা আসলে এক ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্থতা) রুপায়ণ। ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের অভিঘাত নিয়ে অনানুষ্ঠানিক চকিত জরিপের উত্তরে বন্ধু সুচরিতা, শুভ আর বাবলা যথাক্রমে জানান, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ মনোবল ভেঙ্গে দেয়া এক অভিধা, একজন শব্দটিকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখেন আর বাকি জন ব্যবহারের ধরন বিবেচনায় নিতে বলেন। শব্দ ব্যবহারে এর রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বাধ্যবাদকতা এখন বিবেচ্য। কিছু কিছু শব্দ আছে যা মহল বিশেষের গাত্রদাহের কারণ। এবং এ ধরনের শব্দ ব্যবহারে সম্ভাব্য সব প্রতিরোধই আরোপ করা হয় কখনো সম্পাদক দিয়ে কখনো সেন্সর বোর্ড দিয়ে। যেমন কিছুদিন আগে নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বানানো এক তথ্যচিত্রে তার বলা কিছু শব্দ শুনতে পায়নি দর্শক, ক্ষমতাসীন দলের জন্য সেই শব্দ প্রীতিকর ঠেকেনি তাই। ভারতের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিবেচনায় আমরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলায় পড়ে আছি।
‘সংখ্যালঘু’ নামে কারো পরিচয় দাগিয়ে দেয়ার মধ্যে এক ধরনের কায়েমী ইচ্ছা প্রকাশ পায়, বীভৎসভাবে প্রান্তিকীকরণ করা হয় এমন ধারণা কি অযৌক্তিক? শ্বাপদের শাবলে ভাঙছে মন্দির, হন্তারকের আগুনে পুড়ছে ঘর আর কায়েমীর শব্দে জব্দ হচ্ছে কখনো হিন্দু, বৌদ্ধ কখনো খ্রিস্টান। এ এক অবিকল্প ভবিতব্য। যেন ন্যায়বোধ নির্বাসনে। আর এ জন্যই হয়তো ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছিলেন- সর্বোচ্চ মাত্রার উপস্থিতিই হলো অনুপস্থিতি।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহত ২০, শত শত লোকের মৃত্যুর শঙ্কা

‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি কি সংবিধানসম্মত?

আপডেট সময় : ০৯:৫১:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২১

এম এম খালেকুজ্জামান : শব্দ বিশ্বে আমাদের বাস। শব্দ দিয়ে শাসন করা যায়। শব্দ দিয়ে স্তব্ধ করা যায়। আবার শাসকগণ শাসনের স্বার্থে কিছু শব্দকে জব্দ করতে চান, কিছু শব্দের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এসব হচ্ছে এই সময়ের বাস্তবতা। শব্দের সম্ভবনা প্রায় অসীম সে সম্মিলিত স্লোগানেই হোক কিংবা গণমাধ্যমে লেখা সংবাদ বা সংবাদভাষ্যে হোক। হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও এখন সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতে হবে। শব্দ দাবানল ঘটাতে পারে আবার নেভাতেও পারে।
একাডেমিক কনস্টিটিউশনাল গতিধারা চালু রাখেন একডেমিশিয়ানরা আর উচ্চ আদালতে ইন্টারপ্রিটেশান অফ স্ট্যাটিউট-এর মাধ্যমে আইনের চলমানতা জারি রাখেন আইনজীবীগণ। শ্বাশত স্থিতি কিংবা সাম্প্রতিক পরিবর্তন সম্বন্ধে জানতে পারঙ্গম কারো সহায়তা নিতে হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি আবার নতুন করে কানে লাগল। সংবিধানে এর উপস্থিতি বিষয়ে জানতে আইনজীবী ও সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবালের শরণ নেই, জানতে চাই সংবিধানে এর উপস্থিতি নিয়ে। আলোচনার প্রেক্ষিতে তিনি তার সুচিন্তিত মত সামাজিক মাধ্যমে উন্মুক্ত করেন, তার চুম্বক অংশ-
‘দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের নানা বিষয় নিয়ে পড়ি-লিখি; একটা উচ্চতর ডিগ্রিও হয়েছে! কিন্তু কখনো সংখ্যালঘু শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয়নি; উল্টো সংবিধানে সকল নাগরিক সমান বলা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক সংবিধানেও এমন শব্দ দেখিনি। এর অর্থ হলো শব্দটা অসাংবিধানিক। তেমনটিই হওয়ার কথা। বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করেছে; যদিও ২-ক অনুচ্ছেদে একটা রাষ্ট্রধর্মের কথা আছে! রাষ্ট্রের ধর্ম বিষয়টিই গোলমেলে, সে তো ব্যক্তি নয়। একটা অসাংবিধানিক শব্দ কি করে নানাভাবে ব্যবহার হয় তা ভাবা উচিত। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকদের সমান মর্যাদা দিয়েছে; সুতরাং এখানে সকল নাগরিক সমান কেউ সংখ্যালঘু নন। এ সকল অসাংবিধানিক শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে সকল ধর্ম পালনের পরিবেশ নির্বিঘœ করতে হবে।’
এই ভূখ-ে সংবিধান হচ্ছে সেই মৌলিক বিধি সমষ্টি যা জীবন প্রণোদনার উৎসমুখ। শব্দ বা শব্দাবলী সংবিধানের কষ্ঠি পাথরে (যদিও এই পাথরে অনেক সংশোধনের কাটাকুটি) যাচাই করে ব্যবহার করা উচিত। হেয় প্রতিপন্ন করে এমন শব্দ ব্যবহার না করতে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধর্ষিতা শব্দটি লিঙ্গ বৈষম্যের পরিচায়ক বলে বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছে এর প্রেক্ষিতে গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের পূর্বে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দবন্ধ দিয়ে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হয়, সে অনুযায়ী মূল আইনের ৯(২) ধারাসহ প্রয়োজনীয় জায়গায় ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দ বসিয়ে আইন পাশ হয়। এছাড়া সংসদে দেয়া অসাংবিধানিক শব্দাবলী এক্সপাঞ্জ করার অনুশীলন তো আমরা দেখি প্রায়শই।
মোটা দাগে কোনো শব্দকে অসাংবিধানিক না বললেও, অসংবেদনশীল শব্দে অপমানিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে এমন শব্দ ব্যবহার না করাই শ্রেয়। আমাদের দেশে মুসলিম ভিন্ন অন্য ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় বোঝাতে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মনোভঙ্গী বোঝা যায়। ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহারে এমন একটা ভাব থাকে যেন সংখ্যাগুরুর অনুমোদনের উপর নির্ভরশীল অন্য ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী। সংবিধান কিন্তু তা বলে না। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোর সাধারণ পাঠেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
অনুচ্ছেদ ২(ক) প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। কিংবা অনুচ্ছেদ ১২ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা (এটি আবার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অন্তর্ভূক্ত)। অনুচ্ছেদ ৪১(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;
(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।
(২) কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।
প্রাসঙ্গিক যে অনুচ্ছেদগুলোতে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা যেত সেখানে করা হয়নি সচেতনভাবেই। প্রতিহিংসার চর্চা রোধ করা সম্ভব হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর (তিনি সে সময় লিডার অফ দ্য হাউস ছিলেন) নেতৃত্বে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সংবিধান প্রণেতাগণ সম্প্রীতি সহায়ক বিবেচনায় পূর্বানুমানযোগ্য আইনি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠের দম্ভ নিয়ে চাইলেই সংখ্যালঘুর মতো শব্দে কাউকে পৃথক করা যায়? যেন নীচের তলার মানুষের প্রতি উঁচু জাতের দৃষ্টিভঙ্গি, এর মধ্যে আইডেন্টিটি বা সত্তার একটা প্রশ্ন আছে। আমি বনাম অন্য বা অপররের দ্যোতনা সৃষ্টি করে।
‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি সংবিধানসম্মত কিনা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে এ কারণে সরকারও চায় সংবিধানসম্মত শব্দ ব্যবহার করা হোক। প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ইনভার্টেড কমার ভেতরে থাকা বিজ্ঞপ্তিটি ‘বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অতএব, আগামী ৯ আগস্ট ২০১৫ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস এ সংবিধানসম্মত শব্দ চয়নের ব্যাপারে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা (জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ) এবং ইলেট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়া কর্তৃপক্ষকে পূর্বেই এ ব্যাপারে পরামর্শ /স্বরনিকা প্রদান করা হয়েছে।’ অর্থাৎ সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতা মেনে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছে। সে বিবেচনায় ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের ব্যবহার ভেবে দেখা উচিত।
গত কদিনের ভাংচূর, আগুনের প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এ যেন প্যাথলজিক্যাল হেইট্রেডের (যা আসলে এক ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্থতা) রুপায়ণ। ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের অভিঘাত নিয়ে অনানুষ্ঠানিক চকিত জরিপের উত্তরে বন্ধু সুচরিতা, শুভ আর বাবলা যথাক্রমে জানান, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দ মনোবল ভেঙ্গে দেয়া এক অভিধা, একজন শব্দটিকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখেন আর বাকি জন ব্যবহারের ধরন বিবেচনায় নিতে বলেন। শব্দ ব্যবহারে এর রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক বাধ্যবাদকতা এখন বিবেচ্য। কিছু কিছু শব্দ আছে যা মহল বিশেষের গাত্রদাহের কারণ। এবং এ ধরনের শব্দ ব্যবহারে সম্ভাব্য সব প্রতিরোধই আরোপ করা হয় কখনো সম্পাদক দিয়ে কখনো সেন্সর বোর্ড দিয়ে। যেমন কিছুদিন আগে নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বানানো এক তথ্যচিত্রে তার বলা কিছু শব্দ শুনতে পায়নি দর্শক, ক্ষমতাসীন দলের জন্য সেই শব্দ প্রীতিকর ঠেকেনি তাই। ভারতের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিবেচনায় আমরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলায় পড়ে আছি।
‘সংখ্যালঘু’ নামে কারো পরিচয় দাগিয়ে দেয়ার মধ্যে এক ধরনের কায়েমী ইচ্ছা প্রকাশ পায়, বীভৎসভাবে প্রান্তিকীকরণ করা হয় এমন ধারণা কি অযৌক্তিক? শ্বাপদের শাবলে ভাঙছে মন্দির, হন্তারকের আগুনে পুড়ছে ঘর আর কায়েমীর শব্দে জব্দ হচ্ছে কখনো হিন্দু, বৌদ্ধ কখনো খ্রিস্টান। এ এক অবিকল্প ভবিতব্য। যেন ন্যায়বোধ নির্বাসনে। আর এ জন্যই হয়তো ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছিলেন- সর্বোচ্চ মাত্রার উপস্থিতিই হলো অনুপস্থিতি।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।