ঢাকা ০৬:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০১ জুন ২০২৫

সংকটে-শান্তিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

  • আপডেট সময় : ১০:২১:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪
  • ৮১ বার পড়া হয়েছে

খায়রুল আলম : বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের রয়েছে নিজস্ব সেনাবাহিনী। যার কাজ হল আভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রু থেকে নিজ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। আমাদের দেশেও একই স্লোগান নিয়ে রয়েছে “শান্তিতে সংগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী”।
দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশের কোটা নিয়ে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক সহিংসতায় জনমনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছে দেশপ্রেমিক সেনারা।

বাংলাদেশের গর্ব এই বাহিনী মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বুকে শান্তির কাজে স্থান করে নিয়েছে। শান্তির কাজে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যাক সেনা দিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। এই কৃতিত্ব শুধু সশস্ত্র বাহিনীর নয় গোটা জাতির ও বটে।
শুধু নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। দেশের ও জাতীয় স্বার্থে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি বিতরণ, ভিজিডি কার্ড বিতরণ, টিআরকাবিখার হরিলুট বন্ধে ব্যবস্থা, ওয়াসার পানি বন্টন, ট্রাফিক যানজট নিরসন, চট্টগ্রামের পাহাড় ধস, জনদুর্ভোগ নিরসনে ত্বরিত কালভার্ট, সেতু, রাস্তা নিমার্ণ, রানা প্লাজা ও র্যাংগস ভবন সহ শিল্প কারখানার আগুন নির্বাপনে, ৮৮, ৯১ এর সর্বগ্রাসী সামুদ্রিক জলোচ্ছাস, টর্নেডো, গোর্কির তান্ডব, উড়িরচরে সামুদ্রিক জলোচ্ছাস ও মহাপ্লাবনে যখন সারাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত, লন্ড-ভন্ড ও বিপর্যস্ত হয় সেই সময় দুর্দশাগ্রস্ত দুর্গতের পাশে দাড়িয়েছিলো সেনাবাহিনী।
দেশগঠনমূলক কাজে সেনাবাহিনীর অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যেমন পদ্মাসেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্প, মহিপাল ফ্লাইওভার, কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে সেনাবাহিনী। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে সেনাবাহিনী প্রচুর পরিমাণ রাস্তা এবং কালভার্ট নির্মাণ করেছে, যা উক্ত অঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের পর্যটন শিল্পে ব্যাপক অবদান রেখেছে।
মাত্র বছর খানেক আগেও মহামারী করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনী যেভাবে পাশে দাড়িয়েছিলো তা কিন্তু ভুলবার নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের সময়, বাংলাদেশ সরকার সিআইও-এর জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় অনেক অফিসার এবং সদস্যবৃন্দ তাদের দেশপ্রেমের জন্য মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যা দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক কাউন্টার ইনসার্জেন্সি সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসামান্য অবদানের কারণে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুই দশকেরও বেশি দীর্ঘ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। বর্তমানে সেনাবাহিনী সরকারকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পোস্ট সিআইওর ভূমিকা পালন করছে। সারাবিশ্বে শান্তি রক্ষায় অহংকার ও গৌরবের ইতিহাস বহনকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ‘ইমেজ’ ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করার অপতৎপরতা চলছে সাইবার ওর্য়াল্ডে । দেশের প্রতিটি দুর্যোগ বা সংকটে সেনাবাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। দেশের মানুষও তাদের ওপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট এবং আস্থাশীল।
কিন্তু দেশবিরোধী ভয়ানক সাইবার দুর্বৃত্তরা যেন ফেসবুক , টুইটার (এক্স) ও ইউটিউবে অসত্যের দোকান খুলে বসেছে। বিশ্লেষক নামধারী এই সাইবার দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘টার্গেট’ করে দিব্যি মনগড়া ও ভুল তথ্যের প্রবাহ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে। তারা অবাস্তব, অসত্য, বানোয়াট ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছে এবং গুজব ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মূলত একটি চিহ্নিত অপশক্তির টু-পাইস ফর্মুলায় তারা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন বন্ধের হীন চক্রান্ত করছে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাকে কুণ্ডতর্ক শুরু করেছে। অসত্য তথ্য-উপাত্ত ছড়িয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সাইবার দুর্বৃত্ত চক্রের এসব কার্মকাণ্ডকে সরকারবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে মূলত সেনা সদস্যদের উসকে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অনুকূলে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে দীর্ঘ চার দশকের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সফল অগ্রযাত্রাকে। এই সাইবার দুর্বৃত্ত চক্রের এ ধরনের ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেটিজেনরাও।

তারা বলছেন, ‘দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশে একটি রাজনৈতিক দুর্যোগকে স্বাগতম বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে স্পষ্টতই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ফন্দিফিকির করছে কেউ কেউ। এজন্য তারা সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে জলঘোলা করার সব আয়োজন করেছে। এরা মূলত স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রের পোষ্য। তারা ওই চক্রটির কথায় ওঠে-বসে। সরকারকে নাস্তানাবুদ করার অপকৌশল হালে পানি না পাওয়ায় এখন তারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার সব ধরনের হীন অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টেকসই গণতন্ত্র, উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার প্রশ্নে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের অটল মনোভাব প্রমাণ করেছে শেষ পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বরাবরই গণতন্ত্রের পক্ষে সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সেনাবাাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার ও বিশ্বমানের। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছেন। তাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। কোনো ধরনের বিভ্রান্তির প্রলোভনে তারা গত দুই যুগে পা দেয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে শান্তি-সংগ্রামের পাশাপাশি অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী অনন্য অবদান রাখছে। শান্তিরক্ষা মিশন থেকে অর্জিত আয় বাংলাদেশের তৃতীয় আয়ের খাত। দেশবিরোধী বিভিন্ন সংস্থা বর্তমান সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এ দেশের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক অনুপস্থিত। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সংগঠনের উসকানি কোনো কাজে লাগছে না। কারণ প্রতিটি বাহিনীর রয়েছে পেশাদারি আচরণ। তাছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মান্য করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। তবু বিভিন্ন অপপ্রচার থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য, রাষ্ট্রের অনিবার্য অঙ্গ সেনাবাহিনীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে অপপ্রচার মোকাবিলায় মিডিয়ার কার্যকর অবদান রাখা জরুরি। সেনাবাহিনী কোন ব্যাক্তি, গোষ্টি ও দলের নয়। সেনাবাহিনী এদেশেরই নাগরিক, ভোটার ও দেশরক্ষার অকতোভয় গর্বিত সন্তান। দেশের জন্য তাদের দরদ ও দেশপ্রেম অন্য কারো চেয়ে কোন অংশে কম নহে। তারপর সেনাবাহিনী যেহেতু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাহিনী সে হিসেবে জাতীয় প্রয়োজনে সাংবিধানিকভাবে অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, কর্তব্য ও নির্দেশনা মেনে চলাটাও শৃংখলারই অংশ।
‘জাতির পিতা একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি একটি সুশৃঙ্খল, পেশাদার এবং শক্তিশালী সামরিকবাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন এবং কম্বাইন্ড আর্মস স্কুলসহ সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৪ সালেই একটি প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবদান রাখার তাগিদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ চালু করেছে। যেখানে সাধারণ মানুষজনের ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, ‘দেশব্যাপী অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে সেনাবাহিনী আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও পেশাগত দক্ষতায় বলীয়ান হয়ে দেশের প্রতিরক্ষা ও দেশ গড়ার কাজে আরো বেশি অবদান রাখবেন।’

এই বাহিনীকে ব্যবহার করে অনেকে রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে চাচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে সুশৃঙ্খল বাহিনীকে ব্যবহার করতে চায়। এদের প্রতিহত করতে হবে। সকল দল-মতের উর্দ্ধে অতীতের মত তাদের থাকতে হবে। সকল ষড়যন্ত্রের নাগজাল ছিন্ন করে দেশের কল্যানে সেনাসদস্যরা কাজ করবে এমনটাই প্রত্যাশা বাংলার ১৮ কোটি মানুষের।
লেখক: সাংবাদিক, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক; ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সংকটে-শান্তিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

আপডেট সময় : ১০:২১:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

খায়রুল আলম : বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের রয়েছে নিজস্ব সেনাবাহিনী। যার কাজ হল আভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রু থেকে নিজ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। আমাদের দেশেও একই স্লোগান নিয়ে রয়েছে “শান্তিতে সংগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী”।
দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশের কোটা নিয়ে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক সহিংসতায় জনমনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছে দেশপ্রেমিক সেনারা।

বাংলাদেশের গর্ব এই বাহিনী মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বুকে শান্তির কাজে স্থান করে নিয়েছে। শান্তির কাজে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যাক সেনা দিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। এই কৃতিত্ব শুধু সশস্ত্র বাহিনীর নয় গোটা জাতির ও বটে।
শুধু নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। দেশের ও জাতীয় স্বার্থে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি বিতরণ, ভিজিডি কার্ড বিতরণ, টিআরকাবিখার হরিলুট বন্ধে ব্যবস্থা, ওয়াসার পানি বন্টন, ট্রাফিক যানজট নিরসন, চট্টগ্রামের পাহাড় ধস, জনদুর্ভোগ নিরসনে ত্বরিত কালভার্ট, সেতু, রাস্তা নিমার্ণ, রানা প্লাজা ও র্যাংগস ভবন সহ শিল্প কারখানার আগুন নির্বাপনে, ৮৮, ৯১ এর সর্বগ্রাসী সামুদ্রিক জলোচ্ছাস, টর্নেডো, গোর্কির তান্ডব, উড়িরচরে সামুদ্রিক জলোচ্ছাস ও মহাপ্লাবনে যখন সারাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত, লন্ড-ভন্ড ও বিপর্যস্ত হয় সেই সময় দুর্দশাগ্রস্ত দুর্গতের পাশে দাড়িয়েছিলো সেনাবাহিনী।
দেশগঠনমূলক কাজে সেনাবাহিনীর অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যেমন পদ্মাসেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্প, মহিপাল ফ্লাইওভার, কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে সেনাবাহিনী। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে সেনাবাহিনী প্রচুর পরিমাণ রাস্তা এবং কালভার্ট নির্মাণ করেছে, যা উক্ত অঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের পর্যটন শিল্পে ব্যাপক অবদান রেখেছে।
মাত্র বছর খানেক আগেও মহামারী করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনী যেভাবে পাশে দাড়িয়েছিলো তা কিন্তু ভুলবার নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের সময়, বাংলাদেশ সরকার সিআইও-এর জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় অনেক অফিসার এবং সদস্যবৃন্দ তাদের দেশপ্রেমের জন্য মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যা দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক কাউন্টার ইনসার্জেন্সি সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসামান্য অবদানের কারণে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুই দশকেরও বেশি দীর্ঘ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। বর্তমানে সেনাবাহিনী সরকারকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পোস্ট সিআইওর ভূমিকা পালন করছে। সারাবিশ্বে শান্তি রক্ষায় অহংকার ও গৌরবের ইতিহাস বহনকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ‘ইমেজ’ ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করার অপতৎপরতা চলছে সাইবার ওর্য়াল্ডে । দেশের প্রতিটি দুর্যোগ বা সংকটে সেনাবাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। দেশের মানুষও তাদের ওপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট এবং আস্থাশীল।
কিন্তু দেশবিরোধী ভয়ানক সাইবার দুর্বৃত্তরা যেন ফেসবুক , টুইটার (এক্স) ও ইউটিউবে অসত্যের দোকান খুলে বসেছে। বিশ্লেষক নামধারী এই সাইবার দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘টার্গেট’ করে দিব্যি মনগড়া ও ভুল তথ্যের প্রবাহ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে। তারা অবাস্তব, অসত্য, বানোয়াট ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছে এবং গুজব ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মূলত একটি চিহ্নিত অপশক্তির টু-পাইস ফর্মুলায় তারা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন বন্ধের হীন চক্রান্ত করছে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাকে কুণ্ডতর্ক শুরু করেছে। অসত্য তথ্য-উপাত্ত ছড়িয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সাইবার দুর্বৃত্ত চক্রের এসব কার্মকাণ্ডকে সরকারবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে মূলত সেনা সদস্যদের উসকে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অনুকূলে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে দীর্ঘ চার দশকের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সফল অগ্রযাত্রাকে। এই সাইবার দুর্বৃত্ত চক্রের এ ধরনের ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেটিজেনরাও।

তারা বলছেন, ‘দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশে একটি রাজনৈতিক দুর্যোগকে স্বাগতম বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে স্পষ্টতই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে ফন্দিফিকির করছে কেউ কেউ। এজন্য তারা সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে জলঘোলা করার সব আয়োজন করেছে। এরা মূলত স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রের পোষ্য। তারা ওই চক্রটির কথায় ওঠে-বসে। সরকারকে নাস্তানাবুদ করার অপকৌশল হালে পানি না পাওয়ায় এখন তারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার সব ধরনের হীন অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টেকসই গণতন্ত্র, উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার প্রশ্নে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের অটল মনোভাব প্রমাণ করেছে শেষ পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বরাবরই গণতন্ত্রের পক্ষে সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সেনাবাাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার ও বিশ্বমানের। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছেন। তাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। কোনো ধরনের বিভ্রান্তির প্রলোভনে তারা গত দুই যুগে পা দেয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে শান্তি-সংগ্রামের পাশাপাশি অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী অনন্য অবদান রাখছে। শান্তিরক্ষা মিশন থেকে অর্জিত আয় বাংলাদেশের তৃতীয় আয়ের খাত। দেশবিরোধী বিভিন্ন সংস্থা বর্তমান সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এ দেশের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক অনুপস্থিত। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সংগঠনের উসকানি কোনো কাজে লাগছে না। কারণ প্রতিটি বাহিনীর রয়েছে পেশাদারি আচরণ। তাছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মান্য করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। তবু বিভিন্ন অপপ্রচার থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য, রাষ্ট্রের অনিবার্য অঙ্গ সেনাবাহিনীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে অপপ্রচার মোকাবিলায় মিডিয়ার কার্যকর অবদান রাখা জরুরি। সেনাবাহিনী কোন ব্যাক্তি, গোষ্টি ও দলের নয়। সেনাবাহিনী এদেশেরই নাগরিক, ভোটার ও দেশরক্ষার অকতোভয় গর্বিত সন্তান। দেশের জন্য তাদের দরদ ও দেশপ্রেম অন্য কারো চেয়ে কোন অংশে কম নহে। তারপর সেনাবাহিনী যেহেতু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাহিনী সে হিসেবে জাতীয় প্রয়োজনে সাংবিধানিকভাবে অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, কর্তব্য ও নির্দেশনা মেনে চলাটাও শৃংখলারই অংশ।
‘জাতির পিতা একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি একটি সুশৃঙ্খল, পেশাদার এবং শক্তিশালী সামরিকবাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন এবং কম্বাইন্ড আর্মস স্কুলসহ সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৪ সালেই একটি প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবদান রাখার তাগিদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ চালু করেছে। যেখানে সাধারণ মানুষজনের ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, ‘দেশব্যাপী অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে সেনাবাহিনী আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও পেশাগত দক্ষতায় বলীয়ান হয়ে দেশের প্রতিরক্ষা ও দেশ গড়ার কাজে আরো বেশি অবদান রাখবেন।’

এই বাহিনীকে ব্যবহার করে অনেকে রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে চাচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে সুশৃঙ্খল বাহিনীকে ব্যবহার করতে চায়। এদের প্রতিহত করতে হবে। সকল দল-মতের উর্দ্ধে অতীতের মত তাদের থাকতে হবে। সকল ষড়যন্ত্রের নাগজাল ছিন্ন করে দেশের কল্যানে সেনাসদস্যরা কাজ করবে এমনটাই প্রত্যাশা বাংলার ১৮ কোটি মানুষের।
লেখক: সাংবাদিক, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক; ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।