ঢাকা ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

ষোলোকে কি আর ফিরে পাওয়া যায়?

  • আপডেট সময় : ১০:৪৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • ৭৩ বার পড়া হয়েছে

নাদীম কাদিও : মানুষের বয়স নিয়ে নানা ধরনের কৌতূহল অথবা কিছু মজার মজার ঘটনা আছে। মেয়েদের বয়স নিয়ে লুকোচুরি অনেক সময় হয়। এমনকি মেয়েদের বয়স নিয়ে প্রশ্ন করাও অসৌজন্যমূলক। কিন্তু ছেলেদের বয়স নিয়ে নাকি এমন কোনও ব্যাপার নেই।

সম্প্রতি দেখলাম বেশ কিছু মানুষ, যারা পঞ্চাশের ওপরে, তারাও বয়স একটু কমিয়ে বলার চেষ্টা করেন। এতে কী লাভ জানি না। কারণ যেকোনও দাফতরিক কাজে সার্টিফিকেটের বয়সই ধরা হয়। সে যাহোক, এসব যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আমি বয়স লুকাই না, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুরুব্বির প্রাপ্য সম্মানটা পাই। বয়সের সঙ্গে অভিজ্ঞতারও একটি সূচক আছে। এই সূচক আমার অভিজ্ঞতায় বেশ মূল্যায়িত হয়। তবে আমার একটি অভ্যাস আছে। আর তা হলো সবসময় বলা, “ দাড়িমোচ পেকেছে তাতে কী হয়েছে, আমার বয়স ষোলোতে আটকে আছে।” মানে সুইট সিক্সটিন!।

আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন এই সুইট সিক্সটিন মুখে বলে লাভ কী? প্রথমত, আমার কাছে মনে হয় আমি ষোলোতে আটকে আছি। দ্বিতীয়ত, ষোলোর একটি টিনেজ অনুভূতি আছে, যা আমি আমার দৈনন্দিন কাজে গতির জন্য ব্যবহার করি। তৃতীয়ত, ষোলো একটি জোড় সংখ্যা, যা আমার কর্মকা-ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা জ্যোতিষীদের কথা। আমি এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছি, যেখানে আমি সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি। কাছাকাছি বয়সের আরও কয়েকজন আছেন। ক্লাসে তাই তরুণ তরুণীরা আংকেল বলে ডাকে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার পছন্দ হলো না। তাই আমি সজোরে হেসে হেসে বললাম, উড়বং সু ভধপব মরাব ঃযব ষড়ড়শ ড়ভ ধহ টহপষব? ঘড়! ণড়ঁ ধৎব ৎিড়হম. ও ধস ড়হষু ংরীঃববহ. উলটো আমি তোমাদের আংকেল আন্টি বলবো।
কথা শুনে অট্টহাসিতে সবাই ফেটে পড়লো। জিজ্ঞেস করলাম, বলো তো আমার বয়স কত এখন? বেশিরভাগ সময়েই সবাই পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন বললো। আমি হতভম্ব। সত্যিই আমাকে দেখে ষাটোর্ধ্ব মনে হয় না?
আমি খুবই আনন্দ অনুভব করলাম। আহ! আমি তো এখনও অনেক তরুণ। আমার ভাবনার সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল আছে। কারণ মুখ দেখে ষোলো মনে হতে পারে না। এর মাঝে গোঁফ পেকে সাদা, চুলও সাদা হচ্ছে।
হঠাৎ আমার ষোলো বছরের ভাবনায় চিড় ধরলো। ভীষণ অসুস্থ হয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছালাম। বুঝতে পারছি না কী হলো। শুধু এটুকু বুঝছি মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এই প্রথম হুইলচেয়ারে বসতে হলো। কিন্তু এরইমধ্যে মনে হতে শুরু হলো, এ কী হচ্ছে! আমার বয়স না ষোলো?
আমার ভাবনার সঙ্গে কি বাস্তবের চিড় ধরলো? এরপর ডাক্তার আর পরীক্ষা, ডাক্তার আর পরীক্ষা। ফলাফল- পুষ্টিহীনতা থেকে শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং অর্থনৈতিক সংকটে ব্রেনের ওপর চাপ। এর মূল কারণ, যার মাধ্যমে আমার দৈনন্দিন খরচের টাকা পাওয়ার কথা ছিল তার ব্যত্যয় ঘটে। আমার টাকা থেকেও কিন্তু সেই টাকা আমার হাতে নেই। নিজের টাকার জন্য সেই মানুষটিকে বারবার তাড়া দিয়ে কিছুটা পাচ্ছিলাম। সেই খুচরা-খুচরি দিয়ে আমি ট্রেন ভাড়া দেবো নাকি পেট সন্তুষ্ট করবো? এদিকে ইউনিভার্সিটির ক্লাস মিস দেওয়া যাবে না। তাই প্রায় না খেয়েই ট্রেনে চেপে যাওয়া আসা। লিডস-এ বসবাসরত আমার এক বন্ধু আমার এই করুণ অবস্থা জানতে পেরে মাঝে মাঝে আমার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠাতে শুরু করলো। তাই হয়তো আজও বেঁচে আছি। বিদেশের মাটিতে নিজের মানুষের কারণে এত অসহায় হয়ে পড়বো ভাবতে পারিনি। চাকরির দারুণ অভাব, তাই সে দরজা তখনও বন্ধ।
আজকে অসুস্থতার কারণে এক ছোট ভাই আমার কথাগুলো লিখে দিচ্ছে। কম্পিউটারে কাজ করা আমার সম্পূর্ণ নিষেধ।
যাহোক ফিরে আসি আমার বয়সের কথায়। বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আমার এক আত্মীয় জিজ্ঞেস করলো, এখনও কি বলবে তোমার বয়স ষোলো? আমি মৃদু হেসে বললাম, কেন? কী এমন হলো বয়স নিয়ে? উত্তরে সে বললো, এখনও যেভাবে চলাফেরা করো আর শরীরের যে অযতœ করো, ষোলো কীভাবে ধরে রাখবে?
আসলে তোমাকে এখন ভাবতে হবে ষোলো উল্টো করে একষট্টি যোগ দুই, অর্থাৎ তেষট্টি। একটু থমকে গেলাম। আমি তো এই হিসাব করে দেখিনি। ষোলোকে কি আর ফিরে পাওয়া যাবে না? কারণ ছোটবেলায় তেষট্টি বছরের মানুষকে দেখে বলতাম কত বুড়ো হয়ে গেছে। আজকে আমিও বুড়ো।
হ্যাঁ, সত্যিই ষোলোতে ফেরা যাবে না। কারণ শরীর বা মস্তিষ্ক ১৯৭১ সাল থেকে বাবাহারা জীবনে যুদ্ধ ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলছে। সেই তুলনায় আমি তো ভালোই আছি। এছাড়া গত চব্বিশ বছর মাকে ছাড়া একটি হাহাকার জীবন। কে যে আপন আর কে যে পর সবই গুলিয়ে গেছে। তা যাহোক, ষোলো বা তেষট্টি। চলতে তো হবেই যতদিন ক্ষতবিক্ষত হৃৎপি- চলবে। প্রায়শই মনে হয় আর পারছি না। আর কত যুদ্ধ, আর কত চ্যালেঞ্জ। আমিও রক্ত মাংসের একটি মানুষ, যার জীবনে একটু স্থিতি প্রয়োজন, এক রাত নিশ্চিন্তে ঘুমানো প্রয়োজন। কিন্তু বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এ এক অসম্ভব চাওয়া।
বাকিটা পথ যা শক্তি আছে, যা মেধা আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করে যাবো, মনকে ষোলোতে আটকে। আশা করি সফলভাবে অতিক্রম করতে পারবো, তবে তা হলো যতক্ষণ ক্ষতবিক্ষত হৃৎপি-টা দপদপ করবে। তাই বলি- আমি ষোলোতেই আটকে থাকতে চাই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক

 

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ষোলোকে কি আর ফিরে পাওয়া যায়?

আপডেট সময় : ১০:৪৭:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

নাদীম কাদিও : মানুষের বয়স নিয়ে নানা ধরনের কৌতূহল অথবা কিছু মজার মজার ঘটনা আছে। মেয়েদের বয়স নিয়ে লুকোচুরি অনেক সময় হয়। এমনকি মেয়েদের বয়স নিয়ে প্রশ্ন করাও অসৌজন্যমূলক। কিন্তু ছেলেদের বয়স নিয়ে নাকি এমন কোনও ব্যাপার নেই।

সম্প্রতি দেখলাম বেশ কিছু মানুষ, যারা পঞ্চাশের ওপরে, তারাও বয়স একটু কমিয়ে বলার চেষ্টা করেন। এতে কী লাভ জানি না। কারণ যেকোনও দাফতরিক কাজে সার্টিফিকেটের বয়সই ধরা হয়। সে যাহোক, এসব যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আমি বয়স লুকাই না, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুরুব্বির প্রাপ্য সম্মানটা পাই। বয়সের সঙ্গে অভিজ্ঞতারও একটি সূচক আছে। এই সূচক আমার অভিজ্ঞতায় বেশ মূল্যায়িত হয়। তবে আমার একটি অভ্যাস আছে। আর তা হলো সবসময় বলা, “ দাড়িমোচ পেকেছে তাতে কী হয়েছে, আমার বয়স ষোলোতে আটকে আছে।” মানে সুইট সিক্সটিন!।

আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন এই সুইট সিক্সটিন মুখে বলে লাভ কী? প্রথমত, আমার কাছে মনে হয় আমি ষোলোতে আটকে আছি। দ্বিতীয়ত, ষোলোর একটি টিনেজ অনুভূতি আছে, যা আমি আমার দৈনন্দিন কাজে গতির জন্য ব্যবহার করি। তৃতীয়ত, ষোলো একটি জোড় সংখ্যা, যা আমার কর্মকা-ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা জ্যোতিষীদের কথা। আমি এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছি, যেখানে আমি সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি। কাছাকাছি বয়সের আরও কয়েকজন আছেন। ক্লাসে তাই তরুণ তরুণীরা আংকেল বলে ডাকে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার পছন্দ হলো না। তাই আমি সজোরে হেসে হেসে বললাম, উড়বং সু ভধপব মরাব ঃযব ষড়ড়শ ড়ভ ধহ টহপষব? ঘড়! ণড়ঁ ধৎব ৎিড়হম. ও ধস ড়হষু ংরীঃববহ. উলটো আমি তোমাদের আংকেল আন্টি বলবো।
কথা শুনে অট্টহাসিতে সবাই ফেটে পড়লো। জিজ্ঞেস করলাম, বলো তো আমার বয়স কত এখন? বেশিরভাগ সময়েই সবাই পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন বললো। আমি হতভম্ব। সত্যিই আমাকে দেখে ষাটোর্ধ্ব মনে হয় না?
আমি খুবই আনন্দ অনুভব করলাম। আহ! আমি তো এখনও অনেক তরুণ। আমার ভাবনার সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল আছে। কারণ মুখ দেখে ষোলো মনে হতে পারে না। এর মাঝে গোঁফ পেকে সাদা, চুলও সাদা হচ্ছে।
হঠাৎ আমার ষোলো বছরের ভাবনায় চিড় ধরলো। ভীষণ অসুস্থ হয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছালাম। বুঝতে পারছি না কী হলো। শুধু এটুকু বুঝছি মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এই প্রথম হুইলচেয়ারে বসতে হলো। কিন্তু এরইমধ্যে মনে হতে শুরু হলো, এ কী হচ্ছে! আমার বয়স না ষোলো?
আমার ভাবনার সঙ্গে কি বাস্তবের চিড় ধরলো? এরপর ডাক্তার আর পরীক্ষা, ডাক্তার আর পরীক্ষা। ফলাফল- পুষ্টিহীনতা থেকে শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং অর্থনৈতিক সংকটে ব্রেনের ওপর চাপ। এর মূল কারণ, যার মাধ্যমে আমার দৈনন্দিন খরচের টাকা পাওয়ার কথা ছিল তার ব্যত্যয় ঘটে। আমার টাকা থেকেও কিন্তু সেই টাকা আমার হাতে নেই। নিজের টাকার জন্য সেই মানুষটিকে বারবার তাড়া দিয়ে কিছুটা পাচ্ছিলাম। সেই খুচরা-খুচরি দিয়ে আমি ট্রেন ভাড়া দেবো নাকি পেট সন্তুষ্ট করবো? এদিকে ইউনিভার্সিটির ক্লাস মিস দেওয়া যাবে না। তাই প্রায় না খেয়েই ট্রেনে চেপে যাওয়া আসা। লিডস-এ বসবাসরত আমার এক বন্ধু আমার এই করুণ অবস্থা জানতে পেরে মাঝে মাঝে আমার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠাতে শুরু করলো। তাই হয়তো আজও বেঁচে আছি। বিদেশের মাটিতে নিজের মানুষের কারণে এত অসহায় হয়ে পড়বো ভাবতে পারিনি। চাকরির দারুণ অভাব, তাই সে দরজা তখনও বন্ধ।
আজকে অসুস্থতার কারণে এক ছোট ভাই আমার কথাগুলো লিখে দিচ্ছে। কম্পিউটারে কাজ করা আমার সম্পূর্ণ নিষেধ।
যাহোক ফিরে আসি আমার বয়সের কথায়। বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে আমার এক আত্মীয় জিজ্ঞেস করলো, এখনও কি বলবে তোমার বয়স ষোলো? আমি মৃদু হেসে বললাম, কেন? কী এমন হলো বয়স নিয়ে? উত্তরে সে বললো, এখনও যেভাবে চলাফেরা করো আর শরীরের যে অযতœ করো, ষোলো কীভাবে ধরে রাখবে?
আসলে তোমাকে এখন ভাবতে হবে ষোলো উল্টো করে একষট্টি যোগ দুই, অর্থাৎ তেষট্টি। একটু থমকে গেলাম। আমি তো এই হিসাব করে দেখিনি। ষোলোকে কি আর ফিরে পাওয়া যাবে না? কারণ ছোটবেলায় তেষট্টি বছরের মানুষকে দেখে বলতাম কত বুড়ো হয়ে গেছে। আজকে আমিও বুড়ো।
হ্যাঁ, সত্যিই ষোলোতে ফেরা যাবে না। কারণ শরীর বা মস্তিষ্ক ১৯৭১ সাল থেকে বাবাহারা জীবনে যুদ্ধ ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলছে। সেই তুলনায় আমি তো ভালোই আছি। এছাড়া গত চব্বিশ বছর মাকে ছাড়া একটি হাহাকার জীবন। কে যে আপন আর কে যে পর সবই গুলিয়ে গেছে। তা যাহোক, ষোলো বা তেষট্টি। চলতে তো হবেই যতদিন ক্ষতবিক্ষত হৃৎপি- চলবে। প্রায়শই মনে হয় আর পারছি না। আর কত যুদ্ধ, আর কত চ্যালেঞ্জ। আমিও রক্ত মাংসের একটি মানুষ, যার জীবনে একটু স্থিতি প্রয়োজন, এক রাত নিশ্চিন্তে ঘুমানো প্রয়োজন। কিন্তু বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এ এক অসম্ভব চাওয়া।
বাকিটা পথ যা শক্তি আছে, যা মেধা আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করে যাবো, মনকে ষোলোতে আটকে। আশা করি সফলভাবে অতিক্রম করতে পারবো, তবে তা হলো যতক্ষণ ক্ষতবিক্ষত হৃৎপি-টা দপদপ করবে। তাই বলি- আমি ষোলোতেই আটকে থাকতে চাই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক