প্রযুক্তি ডেস্ক: অনেক দিন ধরেই আমেরিকার সংস্কৃতিআর সেইসঙ্গে বিশ্বের অংশ হয়ে উঠেছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। অনেকেই মনে করেন, বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতির পেছনে গোপন কোনো দল বা শক্তি কাজ করছে। আর এমন ভাবনা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে পরিচিত।
নতুন গবেষণা বলছে, যতটা ধারণা করা হয় তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ আসলে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস কেবল সেইসব প্রচলিত ‘টিনফয়েল টুপি পরা অদ্ভুত লোকদের’ মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নেই, বরং সমাজের বড় এক অংশই এমন ধারণায় বিশ্বাস করেন। বিষয়টি রাজনৈতিক মত, শ্রেণি বা গোষ্ঠী– সবার মধ্যেই দেখা যায় বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে তা নতুন প্রকাশিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এ সমীক্ষায় ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হত্যাচেষ্টার ঘটনাটিকে একটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন গবেষকরা। ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাটির কয়েক দিন পরেই এ সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। এ জরিপ থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, কীভাবে গুজব ও ভ্রান্ত তথ্য বাস্তব সময়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘পিএনএএস নেক্সাস’এ। ‘নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক ও এ গবেষণার সহ-লেখক ডেভিড লেজার বলেছেন, ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাটির সময়কাল তার গবেষণা দলের জন্য বিশেষ এক সুযোগ এনে দিয়েছিল। অনেক মানুষ এসব ষড়যন্ত্রের কথা শুনেছেন এবং সেগুলোকে সত্যি বলেও মনে করেছেন। আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম, মানুষের মধ্যে থাকা এসব তথ্যের ঘাটতি বা শূন্যস্থান তারা পূরণ করবেন বাম ও ডান উভয় দিকের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাধ্যমে। আর ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। ডানপন্থীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে নির্বাচনে জেতা থেকে আটকাতে হত্যাচেষ্টার আয়োজন করেছে। অন্যদিকে, বামপন্থীদের মধ্যে আরেকটি তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে, রিপাবলিকানরা নিজেরাই এ ঘটনাটি সাজিয়েছে, যাতে ট্রাম্পের প্রতি ভোটারদের সহানুভূতি ও জনপ্রিয়তা বাড়ানো যায়।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাটির কথা শুনেছিলেন ৯৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। জরিপে ডানপন্থীদের তত্ত্ব শুনেছেন প্রায় ৪১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী, আর বামপন্থীদের তত্ত্ব শুনেছেন ৫৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। আর যারা এসব তত্ত্ব সম্পর্কে জানেন, তাদের মধ্যে অনেকে সেগুলো বিশ্বাসও করেছেন।
প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, ‘বেশিরভাগ সম্ভাবনা’ ডেমোক্র্যাটরাই এ হামলার পেছনে রয়েছেন। এদিকে, ‘সম্ভবত’ বলেছেন ১৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। রিপাবলিকানরা এ হামলার আয়োজন করেছেন এমন তত্ত্বের ক্ষেত্রে ‘বেশিরভাগ সম্ভাবনা’ বলেছেন ১২ শতাংশ এবং ১৭ শতাংশ বলেছেন ‘সম্ভবত’।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, মানুষদের এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের বেশি তাদের মূল তথ্যসূত্র হিসেবে সামাজিক মাধ্যমের কথা উল্লেখ করেছেন। তারপরের অবস্থানে ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে বন্ধু, পরিবার, সহকর্মীদের মাধ্যমে। এরপর রয়েছে টেলিভিশন। জরিপে আরো উঠে এসেছে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে শোনা ও বিশ্বাস করা দুটি ভিন্ন বিষয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনেন মানুষ। তবে আসলেই এসব কথা বেশি বিশ্বাস করেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে। যেমন- বন্ধু, পরিবার ও সহকর্মীদের কাছ থেকে শোনা কথায়। লেজার বলেছেন, আপনি যদি আপনার পরিচিত কারো কাছ থেকে কোনো কথা শোনেন তাহলে তা বিশ্বাস করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গবেষণা এখানেই থেমে থাকেনি। লেজার ও তার গবেষণা দলটি যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের এক লাখ ২৪ হাজার মানুষের ওপর বিস্তৃত পরিসরে জাতীয় জরিপও চালিয়েছিল, যা প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘জার্নাল অফ অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার’-এ।
ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ৭৯ শতাংশ মানুষ অন্তত এক ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন, যেখানে ‘স্ট্যান্ডার্ড আমেরিকান কনস্পিরেটরিয়াল থিংকিং স্কেল’-এর মাধ্যমে উত্থাপিত চারটি প্রশ্নের সঙ্গে একমত হয়েছেন ১৯ শতাংশ মানুষ।
এসব তথ্য থেকে ইঙ্গিত মিলছে, ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তাভাবনার বিষয়টি একেবারেই বিরল নয় এবং এটি কেবল কোনো এক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জরিপে এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে, যারা কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তই পড়াশোনা করেছেন। তাদের কোনো কলেজ ডিগ্রি নেই এবং তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের লক্ষণও রয়েছে। লেজার বলেছেন, জরিপের এসব ফলাফল আমাদের দেখায় যে, কেন ও কীভাবে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ছে তা গবেষণার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কেবল ভুল তথ্যের ঝুঁকির দিকেই ইঙ্গিত করে না, বরং মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসের গভীর বিষয় ও বিভ্রান্তিকর পৃথিবীকে বোঝার জন্য মানুষের প্রয়োজনীয়তার দিকেও ইঙ্গিত করে। তিনি বলেছেন, এই পৃথিবীকে বোঝা সত্যিই কঠিন।
সানা/আপ্র/১৪/১০/২০২৫