ঢাকা ০৬:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫

শ্রমিক আন্দোলন কি সবসময় মুক্তির পথ দেখায়?

  • আপডেট সময় : ০৫:৪২:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
  • ৫২ বার পড়া হয়েছে

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মেক্সিকান আমেরিকান নাগরিক অধিকার কর্মী সিজার শ্যাভেজ (ঈবংধৎ ঈযধাবু) এবং ফিলিপিনো আমেরিকান সংগঠক ল্যারি ইটলিয়ংয়ের (খধৎৎু ওঃষরড়হম) নেতৃত্বে নব-সংগঠিত খামার কর্মীরা ভালো বেতন এবং আরও বেশি মানবিক কাজের পরিস্থিতির দাবিতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছিলেন। তারা আংশিকভাবে মিছিল এবং অনশনের মতো অহিংস প্রতিবাদী কৌশল অবলম্বন করেন। তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ওই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া কৃষি শ্রম সম্পর্ক আইন ১৯৭৫ প্রণয়ন করে; যা রাজ্যজুড়ে কৃষকদের সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতা দেয়। কৃষক-শ্রমিক ক্রমেই অধিকার পায়। আবার ক্রমেই নতুন দাবি-দাওয়া তৈরি হয়।
সারা পৃথিবীতে শ্রমিকদের কল্যাণে নানা ধরনের আইন থাকা সত্ত্বেও এখনো শ্রম কিংবা শ্রমের পারিশ্রমিক নিয়ে দর কষাকষি করতেই হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই শ্রমিক আন্দোলন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকরা যেন বঞ্চিত না হয়, তাদের দাবি যেন গুরুত্ব পায়Ñ এ জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বিকাশ ও বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ আমরা লক্ষ করেছি। তারপরও আইনে বৈষম্য, মজুরিতে বৈষম্য, নারী পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য, অধিকারে বৈষম্য বিশ্বব্যাপী আমাদের সামনে রয়ে গেছে। এসব বৈষম্য নিরসন এবং বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য শ্রমিক রক্ত দিয়েছে যুগে যুগে। তারপরও শ্রমিকদের তাদের দাবি-দাওয়া তথা নানা ধরনের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রতিদিন ছুটতে হচ্ছে, এমনকি লড়াই করতে হচ্ছে। নামতে হচ্ছে রাজপথে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে।
উন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত যে দেশের কথাই বলি না কেন—কোনো দেশই এই সংকটের বাইরে নেই। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আরভিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস শ্রম ইতিহাসের প্রমাণ রয়েছে—বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘটকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে সাধারণ নিপীড়িত শ্রমিক জনতা।
মার্কিন ডাক বিভাগের কর্মচারীরা ইউএস পোস্টাল সার্ভিসের অগ্রদূত। বছরের পর বছর কম বেতন এবং দেশের মেইল প্রসেসিং এবং ডেলিভারির কাজ করে। কিন্তু তাদের সামান্য লিভারেজ ছিল। কারণ ফেডারেল কর্মচারীদের ধর্মঘট করা বেআইনি ছিল। কিন্তু ১৯৭০ সালের মার্চে নিউইয়র্কের ডাককর্মীরা তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন নেতৃত্বকে অস্বীকার করে ধর্মঘট ডাকে। শিগগিরই অন্যত্র শ্রমিকরা ফেডারেল সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সেই ধর্মঘটে যোগ দেয়।
অবশেষে নিক্সন প্রশাসন তাদের পূর্ববর্তী বেতন বৃদ্ধি করে এবং আট দিন পর ডাকবিভাগের কর্মীরা আবার কাজে ফেরে। ১৯৭১ সালে ইউএসপিএস গঠনের পর ডাক কর্মীদের বেতন এবং কাজের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
ভারতবর্ষেও এমন উদাহরণ অসংখ্য রয়েছে। আমাদের এই উপমহাদেশে শ্রমিক আন্দোলনরে অসংখ্য নজির রয়েছে। শ্রমিকরা লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, দাবিও বাস্তবায়ন করেছে। শ্রমিকদের কোনো ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন হয়নি—এমন ঘটনা নেই বললেই চলে।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকের ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শ্রম পরিবেশের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধ অর্জন, সরবরাহ ব্যবস্থার অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধিসহ সবার জন্য সমান ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান যে নীতি রয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অন্য দেশগুলো শ্রমিকের ক্ষমতায়ন ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এগিয়ে নেওয়া হবে বলে জানায়। পাশাপাশি শ্রমিক ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এমনকি আমরা লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ নজর রয়েছে—সেটি আমরা সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতিতে লক্ষ করেছি।
উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শ্রমিকদের অধিকার প্রসঙ্গে সংকট অধিকভাবে লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে এই সংকটের মধ্যে রয়েছে সবসময়ই। এখানে শ্রমিকদের দাবির শেষ নেই। কারণ এখানে শুধু শ্রমিক নয় সাধারণ মানুষের দাবিরও শেষ নেই।
অনেক মানুষ রয়েছেন দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য অবস্থায়। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক আয় দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে অনেকের। ধনীরা টের না পেলেও মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা অনেকটা দিশেহারা হতে চলেছে। কৃষক-শ্রমিক তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সংকটের মুখোমুখি। বাজারে গিয়ে শ্রমিক এবং দিনমজুরদের সাথে কথা বললে হতাশা এবং ক্ষোভের কথা শুনতে পাই।
ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান-পরবর্তী বাংলাদেশ, এমনকি বর্তমানেও শ্রমিক অসন্তোষ অনেক। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন এবং ২৪ এর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শ্রমিকদের বড় ভূমিকা ছিল। ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিকশ্রেণি শুধু নিজের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে শ্রমিকরা। একটি সমস্যার সমাধান হলে, নতুন আরেকটি সমস্যা সামনে আসে। এ জন্য শুধু দেশের অর্থনীতি দায়ী নয়। মানুষের চাহিদার যেমন শেষ নেই, ঠিক তেমনি বৈষম্যের শেষ নেই।
পৃথিবীর সব দেশেই একটির পর একটি বৈষম্য সামনে আসে। একটি বৈষম্য নিরসন হলে আরেকটি বৈষম্য সামনে আসে। এক্ষেত্রে আমাদের বলতেই হয়, যেকোনো দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে সে দেশের শ্রমজীবী মানুষের শ্রম ও ঘামের ওপর। কৃষি উৎপাদন, প্রবাসী রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টস শ্রমিকরাই সচল রাখে অর্থনীতি। আরও স্পষ্ট করে বললে, তুলনামূলক স্বল্পশিক্ষিত মেহনতি মানুষই আর্থিক খাতের প্রাণশক্তি হয়।
সাধারণত স্বপ্নভঙ্গ আর হতাশার মধ্যে আশার দিক হচ্ছে গণতন্ত্রকামী জনতার পাশাপাশি শ্রমিকরা সংগঠিত হয়। যুগযুগ ধরে বিশ্বব্যাপী তাই লক্ষ করা গেছে। শ্রমিকশ্রেণি সংগঠিত প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের কথা বলছে। রাস্তায় নামছে। রক্ত ও জীবন দিতেও পিছ পা হচ্ছে না।
শ্রমিকশ্রেণি নতুন ইতিহাস লেখার রসদ জোগাচ্ছে। নব উদ্যমে আন্দোলন ও সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করছে। এমনকি আমরা লক্ষ করেছি সব ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে দেশ ও বিদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি।
আমরা লক্ষ করি, শ্রমিকশ্রেণির সাংগঠনিক ও সমষ্টিগত লড়াই সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। শ্রমিকরা সাহস পাচ্ছে, সংগঠিত হচ্ছে, রাস্তায় নামছে শুধু বেতনের জন্য নয়, দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও। রাজনীতির পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক আর ছাত্র আন্দোলনই পারে যেকোনো দেশের মুক্তির পথ দেখাতে। এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে অসংখ্য। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে শ্রমিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখায়। নিজেদের অধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনেও শ্রমিক আন্দোলন অনেক বেশি প্রয়োজন।
অতীতে শ্রমিকশ্রেণি বারবার সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। আধুনিক সমাজে আজও শ্রমিকের সেবা ছাড়া একটি মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। শ্রমিকদের রক্ত আর ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এ সভ্যতা। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের ওপর জুলুম করা চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘনের শামিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের ধরন, গঠন ও চর্চার মধ্যেও নতুন চিহ্ন তৈরি করার সময় এসেছে। সংস্কার, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা অন্তর্র্বতী সরকারসহ সব সরকারের উদ্যোগের মধ্যে প্রতিফলিত হতে হবে শ্রমিক এবং দিনমজুরদের প্রত্যাশা। কারণ এই জাতির ইতিহাস কৃষক-শ্রমিকদের ত্যাগের ইতিহাসের সাথে জড়িত।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শ্রমিক আন্দোলন কি সবসময় মুক্তির পথ দেখায়?

আপডেট সময় : ০৫:৪২:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মেক্সিকান আমেরিকান নাগরিক অধিকার কর্মী সিজার শ্যাভেজ (ঈবংধৎ ঈযধাবু) এবং ফিলিপিনো আমেরিকান সংগঠক ল্যারি ইটলিয়ংয়ের (খধৎৎু ওঃষরড়হম) নেতৃত্বে নব-সংগঠিত খামার কর্মীরা ভালো বেতন এবং আরও বেশি মানবিক কাজের পরিস্থিতির দাবিতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছিলেন। তারা আংশিকভাবে মিছিল এবং অনশনের মতো অহিংস প্রতিবাদী কৌশল অবলম্বন করেন। তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে সরকার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ওই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া কৃষি শ্রম সম্পর্ক আইন ১৯৭৫ প্রণয়ন করে; যা রাজ্যজুড়ে কৃষকদের সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতা দেয়। কৃষক-শ্রমিক ক্রমেই অধিকার পায়। আবার ক্রমেই নতুন দাবি-দাওয়া তৈরি হয়।
সারা পৃথিবীতে শ্রমিকদের কল্যাণে নানা ধরনের আইন থাকা সত্ত্বেও এখনো শ্রম কিংবা শ্রমের পারিশ্রমিক নিয়ে দর কষাকষি করতেই হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই শ্রমিক আন্দোলন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকরা যেন বঞ্চিত না হয়, তাদের দাবি যেন গুরুত্ব পায়Ñ এ জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বিকাশ ও বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ আমরা লক্ষ করেছি। তারপরও আইনে বৈষম্য, মজুরিতে বৈষম্য, নারী পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য, অধিকারে বৈষম্য বিশ্বব্যাপী আমাদের সামনে রয়ে গেছে। এসব বৈষম্য নিরসন এবং বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য শ্রমিক রক্ত দিয়েছে যুগে যুগে। তারপরও শ্রমিকদের তাদের দাবি-দাওয়া তথা নানা ধরনের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রতিদিন ছুটতে হচ্ছে, এমনকি লড়াই করতে হচ্ছে। নামতে হচ্ছে রাজপথে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে।
উন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত যে দেশের কথাই বলি না কেন—কোনো দেশই এই সংকটের বাইরে নেই। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আরভিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস শ্রম ইতিহাসের প্রমাণ রয়েছে—বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘটকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে সাধারণ নিপীড়িত শ্রমিক জনতা।
মার্কিন ডাক বিভাগের কর্মচারীরা ইউএস পোস্টাল সার্ভিসের অগ্রদূত। বছরের পর বছর কম বেতন এবং দেশের মেইল প্রসেসিং এবং ডেলিভারির কাজ করে। কিন্তু তাদের সামান্য লিভারেজ ছিল। কারণ ফেডারেল কর্মচারীদের ধর্মঘট করা বেআইনি ছিল। কিন্তু ১৯৭০ সালের মার্চে নিউইয়র্কের ডাককর্মীরা তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন নেতৃত্বকে অস্বীকার করে ধর্মঘট ডাকে। শিগগিরই অন্যত্র শ্রমিকরা ফেডারেল সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সেই ধর্মঘটে যোগ দেয়।
অবশেষে নিক্সন প্রশাসন তাদের পূর্ববর্তী বেতন বৃদ্ধি করে এবং আট দিন পর ডাকবিভাগের কর্মীরা আবার কাজে ফেরে। ১৯৭১ সালে ইউএসপিএস গঠনের পর ডাক কর্মীদের বেতন এবং কাজের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল।
ভারতবর্ষেও এমন উদাহরণ অসংখ্য রয়েছে। আমাদের এই উপমহাদেশে শ্রমিক আন্দোলনরে অসংখ্য নজির রয়েছে। শ্রমিকরা লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, দাবিও বাস্তবায়ন করেছে। শ্রমিকদের কোনো ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন হয়নি—এমন ঘটনা নেই বললেই চলে।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকের ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শ্রম পরিবেশের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধ অর্জন, সরবরাহ ব্যবস্থার অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধিসহ সবার জন্য সমান ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান যে নীতি রয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অন্য দেশগুলো শ্রমিকের ক্ষমতায়ন ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এগিয়ে নেওয়া হবে বলে জানায়। পাশাপাশি শ্রমিক ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এমনকি আমরা লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ নজর রয়েছে—সেটি আমরা সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতিতে লক্ষ করেছি।
উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শ্রমিকদের অধিকার প্রসঙ্গে সংকট অধিকভাবে লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে এই সংকটের মধ্যে রয়েছে সবসময়ই। এখানে শ্রমিকদের দাবির শেষ নেই। কারণ এখানে শুধু শ্রমিক নয় সাধারণ মানুষের দাবিরও শেষ নেই।
অনেক মানুষ রয়েছেন দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য অবস্থায়। দৈনিক, সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক আয় দিয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে অনেকের। ধনীরা টের না পেলেও মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা অনেকটা দিশেহারা হতে চলেছে। কৃষক-শ্রমিক তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সংকটের মুখোমুখি। বাজারে গিয়ে শ্রমিক এবং দিনমজুরদের সাথে কথা বললে হতাশা এবং ক্ষোভের কথা শুনতে পাই।
ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান-পরবর্তী বাংলাদেশ, এমনকি বর্তমানেও শ্রমিক অসন্তোষ অনেক। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন এবং ২৪ এর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শ্রমিকদের বড় ভূমিকা ছিল। ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিকশ্রেণি শুধু নিজের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে শ্রমিকরা। একটি সমস্যার সমাধান হলে, নতুন আরেকটি সমস্যা সামনে আসে। এ জন্য শুধু দেশের অর্থনীতি দায়ী নয়। মানুষের চাহিদার যেমন শেষ নেই, ঠিক তেমনি বৈষম্যের শেষ নেই।
পৃথিবীর সব দেশেই একটির পর একটি বৈষম্য সামনে আসে। একটি বৈষম্য নিরসন হলে আরেকটি বৈষম্য সামনে আসে। এক্ষেত্রে আমাদের বলতেই হয়, যেকোনো দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে সে দেশের শ্রমজীবী মানুষের শ্রম ও ঘামের ওপর। কৃষি উৎপাদন, প্রবাসী রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টস শ্রমিকরাই সচল রাখে অর্থনীতি। আরও স্পষ্ট করে বললে, তুলনামূলক স্বল্পশিক্ষিত মেহনতি মানুষই আর্থিক খাতের প্রাণশক্তি হয়।
সাধারণত স্বপ্নভঙ্গ আর হতাশার মধ্যে আশার দিক হচ্ছে গণতন্ত্রকামী জনতার পাশাপাশি শ্রমিকরা সংগঠিত হয়। যুগযুগ ধরে বিশ্বব্যাপী তাই লক্ষ করা গেছে। শ্রমিকশ্রেণি সংগঠিত প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের কথা বলছে। রাস্তায় নামছে। রক্ত ও জীবন দিতেও পিছ পা হচ্ছে না।
শ্রমিকশ্রেণি নতুন ইতিহাস লেখার রসদ জোগাচ্ছে। নব উদ্যমে আন্দোলন ও সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করছে। এমনকি আমরা লক্ষ করেছি সব ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে দেশ ও বিদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি।
আমরা লক্ষ করি, শ্রমিকশ্রেণির সাংগঠনিক ও সমষ্টিগত লড়াই সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। শ্রমিকরা সাহস পাচ্ছে, সংগঠিত হচ্ছে, রাস্তায় নামছে শুধু বেতনের জন্য নয়, দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও। রাজনীতির পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক আর ছাত্র আন্দোলনই পারে যেকোনো দেশের মুক্তির পথ দেখাতে। এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে অসংখ্য। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে শ্রমিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখায়। নিজেদের অধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনেও শ্রমিক আন্দোলন অনেক বেশি প্রয়োজন।
অতীতে শ্রমিকশ্রেণি বারবার সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। আধুনিক সমাজে আজও শ্রমিকের সেবা ছাড়া একটি মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। শ্রমিকদের রক্ত আর ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এ সভ্যতা। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের ওপর জুলুম করা চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘনের শামিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের ধরন, গঠন ও চর্চার মধ্যেও নতুন চিহ্ন তৈরি করার সময় এসেছে। সংস্কার, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা অন্তর্র্বতী সরকারসহ সব সরকারের উদ্যোগের মধ্যে প্রতিফলিত হতে হবে শ্রমিক এবং দিনমজুরদের প্রত্যাশা। কারণ এই জাতির ইতিহাস কৃষক-শ্রমিকদের ত্যাগের ইতিহাসের সাথে জড়িত।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়