নারী ও শিশু ডেস্ক: নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ৫৩ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন না। এই নারীরা কোনো চাকরিতেও ঢোকার চেষ্টা করেন না। আর চাকরিতে যুক্ত আছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। এর বাইরে যারা আছেন, তারা উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হতে চান। তারা কাজ খুঁজছেন। দেশের পূর্বাঞ্চলের হাওর-বাঁওড়বেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জের নারীদের নিয়ে চালানো একটি গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে আয়োজিত সংলাপে গবেষণায় পাওয়া ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সিপিডি, সেভ দ্য চিলড্রেন, দ্য আর্থ ও ইউসেপ বাংলাদেশ যৌথভাবে কিশোরগঞ্জে নারীর ক্ষমতায়ন ও সহনশীলতা সৃষ্টির একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রকল্পের জন্যই গবেষণাটি করা হয়েছে। আজ গবেষণায় পাওয়া ফলাফল নিয়ে ‘কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার, কর্মদক্ষতা এবং কিশোরী ও তরুণীদের জন্য শ্রমবাজারে যুক্ততার প্রস্তুতি’ শীর্ষক একটি সংলাপের আয়োজন করা হয়।
গবেষণায় পাওয়া ফলাফল উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহকারী এএসএম শামীম আলম। শুরুতে গবেষণার জন্য কিশোরগঞ্জ জেলাকে বেছে নেওয়ার কারণ জানিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রমবাজার তৈরিতে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জকে বেছে নেওয়া হয়। জেলাটি দেশের পিছিয়ে পড়া অন্য জেলাগুলোর মধ্যে আরও পিছিয়ে রয়েছে। সেখানকার প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশ করা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের।
কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার ১০৮টি ইউনিয়নে ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সি ৮৪৫ জন কিশোরী এবং ১৭ থেকে ২৬ বছর বয়সি ৮৮৩ জন তরুণীকে নিয়ে গবেষণা জরিপটি চালানো হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গড়ে ৫৫ শতাংশ নারী চাকরি, পড়াশোনা বা কোনো প্রশিক্ষণে যুক্ত নন। এসব নারীর বেশির ভাগ বিয়ে করে গৃহস্থালির কাজে যুক্ত। পড়াশোনা, চাকরি বা প্রশিক্ষণে যুক্ত না থাকা নারীদের মধ্যে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের হার ৭৩ শতাংশ আর ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সিদের হার ৩৮ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের ৫৯ শতাংশ তরুণী (১৭ থেকে ২৬ বছর বয়স) বিবাহিত। একটি উপজেলা বাদে সব উপজেলাতেই বাল্যবিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে নিকলীতে বাল্যবিয়ের হার ১৩ শতাংশ এবং বাজিতপুরে ৭ শতাংশ।
সাক্ষরতার হার প্রায় শতভাগ থাকলেও পড়াশোনা শেষের আগে কিংবা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জনের আগেই ৪৬ শতাংশ তরুণী ঝরে যান। কিশোরীদের ক্ষেত্রে এই হার ৯ শতাংশ। কিশোরগঞ্জের উপজেলাগুলোতে ৮৭ শতাংশ কিশোরী পড়াশোনায় যুক্ত আছে। তবে তরুণীদের মধ্যে পড়াশোনা করছেন মাত্র ৪২ শতাংশ। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কিংবা যাতায়াতের সমস্যার কারণে একটা বয়সের পর এসব এলাকার তরুণীরা ঝরে পড়েন।
কিশোরগঞ্জের বেশির ভাগ, অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ নারীর অর্থনৈতিক কার্যক্রম কৃষি খাতভিত্তিক। এ ছাড়া বাসায় থেকে করা যায়, এমন কাজ যেমন সেলাই, ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইনে ব্যবসায় নারীদের আগ্রহ বেশি এবং চর্চা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন সেবা খাতে (পর্যটনকেন্দ্রিক) নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। অভিবাসনের হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, কিশোরগঞ্জের উপজেলাগুলোর বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন। সেখানকার খুবই কমসংখ্যক নারী নিজ নিজ এলাকার বাইরে গিয়েছেন। তাই তাদের প্রশিক্ষণ করাতে হলে এলাকাতেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় ১০টি প্রস্তাব পরামর্শ আকারে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তিগত জ্ঞান, দক্ষতা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকায় যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে সেখানে কাজের সুযোগ হয়, এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু এলাকায় সেলাইয়ের মতো কারিগরি প্রশিক্ষণ আবার কৃষিপ্রধান এলাকায় কৃষিভিত্তিক ব্যবসার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বা তৈরি পণ্য সেখানেই বাজারজাতকরণ ও বিপণনের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়। ই-কমার্স কিংবা অনলাইন বিপণনের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। নারীদের কর্মজীবন সম্পর্কেও ধারণা দিতে হবে। প্রণোদনা ও ঋণসহায়তার কাঠামো তৈরি করতে হবে।
সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরীন আফরোজ বলেন, সরকারের যেসব প্রচেষ্টা রয়েছে, সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে সচেতনতা তৈরি করতে হলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতার উন্নয়ন করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম অধিকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদ বলেন, শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই ওই শ্রমিকেরা নিজেদের আস্থাবান মনে করবেন এবং উন্নয়ন করতে পারবেন। শিল্প গড়তে প্রণোদনা কিংবা দক্ষ জনবল তৈরির জন্যও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সংলাপের অন্য বক্তারা বলেন, কাজের জন্য কিশোরী বয়স থেকেই উৎসাহ দিতে হবে। পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ প্রদান, চাকরিদাতা, আর্থিক সহযোগিতাকারী-এসব পর্যায়ের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের পরে চাকরির ব্যবস্থা কিংবা উদ্যোক্তা হতে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। নারীকে শ্রমবাজারে আনতে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চিন্তার পরিবর্তনের পাশাপাশি নারী নির্যাতন ও বাল্যবিয়েতের মতো বিষয় বন্ধ করতে হবে।
সংলাপে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য রাশেদা কে চৌধূরী। সংলাপে আরও বক্তব্য দেন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এনএএসসিআইবি) সভাপতি মির্জা নুরুল গনি, উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সিজান খান, কিশোরগঞ্জ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক খলিলুজ জামান, ইউসেপ বাংলাদেশের উপপরিচালক জয় প্রকাশ বড়ুয়া, দ্য আর্থ সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান শাকিলা সাত্তার। শেষে সারাংশ আলোচনা করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক তানিয়া শারমিন।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ