ঢাকা ০৯:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৬ অগাস্ট ২০২৫

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক সাংবাদিক তোয়াব খানকে বিদায়

  • আপডেট সময় : ১২:৫৮:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২
  • ১০০ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রীয় সম্মানের গান স্যালুট আর শ্রদ্ধা ভালোবাসায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিদায় জানানো হল সাংবাদিক তোয়াব খানকে।
গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে তার কফিন শহীদ মিনারে পৌঁছালে প্রথমেই ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয় এই মুক্তিযোদ্ধাকে, দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।
এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার বঙ্গভবনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সহকারী সামরিক সচিব লে. কর্নেল জিএম রাজিব আহমেদ তোয়াব খানের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় সংবাদকর্মী থেকে থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতকি ও রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এরপর।
একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক গত শনিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান, তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। শহীদ মিনারে তোয়াব খানের ভাই সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, “আমার প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে তোয়াব খানকে শুধু একটি দিনে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে নয়, তার কর্মের ভিতর দিয়ে তাকে আবিষ্কার করতে হবে, গ্রহণ করতে হবে এবং ধারণ করতে হবে।
“আজকে বাংলাদেশ এক দিকে তাকিয়ে আছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলণ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না। একটি বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা আসছে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার সময় এখনই।”
আওয়ামী লীগের পক্ষে তোয়াব খানের কফিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন “আবদুল গাফফার চৌধুরীর পর বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে তোয়াব খান সম্ভবত সবার সিনিয়র ছিলেন। তিনিও অবশেষে চলে গেলেন। তার মৃত্যুতে আমাদের সংবাদপত্র জগতে এক বটবৃক্ষের বিশাল পতন হল।“
সাংবাদিক তোয়াব খানকে দেখার কথা স্মরণ করে কাদের বলেন, “তিনি হাঁকডাক করতেন না, নেতাগিরি করতেন না। নীরেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাংবাদিকতায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। একাত্তরের শব্দ সৈনিক, বাহান্নোর ভাষা সৈনিক এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অনেক পছন্দ করতেন। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।”
শহীদ মিনারে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ছিলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুর ও উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, সম্প্রতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রয়াত এ সাংবাদিকের প্রতি।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তোয়াব খানের কফিন জাতীয় প্রেসক্লাবে নেওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন ও জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হয় গুলশানে তার নিজ বাসভবনে। বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে আরেকবার জানাজা শেষে এই প্রবীণ সাংবাদিককে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে।
শ্রদ্ধায় ভাসলেন ‘সম্পাদকদের সম্পাদক’ : জাতীয় প্রেসক্লাবে একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান সাংবাদিক, দৈনিক বাংলা ও নিউজ বাংলার সম্পাদক তোয়াব খানকে শেষশ্রদ্ধা জানিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ বিশিষ্টজনেরা। সোমবার দুপুর পৌনে একটার দিকে তার মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স প্রেসক্লাব চত্বরে পৌঁছায়। সেখানে ১টায় জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে টেনিস গ্রাউন্ডে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেন বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকরা। জানাজা শেষে সাংবাদিক, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এ সময় শ্রদ্ধা জানাতে প্রেস ক্লাবে হাজির হন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি। এছাড়াও জানাজার নামাজ শেষে জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সাব-এডিটরস কাউন্সিল, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট, নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং তোয়াব খানের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, ‘যে কোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অনন্য এক ক্ষমতা ছিল তোয়াব খানের। তার সাংবাদিকতা, কর্মজীবন আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।’ প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘চিন্তা ও মননে তিনি আজীবন একজন সক্রিয় সাংবাদিক ছিলেন। তিনি তার কর্মের মধ্যেই বেঁচে ছিলেন, কর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের মাঝে থাকবেন।’
প্রথম আলোর উপসম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘সম্পাদকদের সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। আমরা প্রতিনিয়ত তার কাছ থেকে শিখি। তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আজকে আমরা শোকে ভারাকান্ত। আমাদের সঙ্গে হয়তো প্রকৃতিও আজ কাঁদছে। আমাদের (জাতীয় প্রেস ক্লাব) আজীবন সদস্য তোয়াব ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি সবার কাছে বলব, আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতা আজকে শূন্যস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে। তোয়াব ভাইয়ের চলে যাওয়া মানে সাংবাদিকতার একটি ইতিহাসের অধ্যায় শেষ হওয়া।’
প্রেস ক্লাবে প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজার আগে তোয়াব খানের ছোট ভাই ওবায়দুল কবির খান বলেন, ‘আমার বড় ভাই গত শনিবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ হচ্ছে, যদি উনি কখন আপনাদের সঙ্গে ভুল ব্যবহার বা অন্য কোনও কিছু করে থাকে তবে তাকে ক্ষমা করে দেবেন। একই সঙ্গে তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া রাখবেন।’
জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাজা নামাজ শেষে তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সাব-এডিটর কাউন্সিল, দৈনিক প্রথম আলো,কালেরকণ্ঠ, জনকণ্ঠ,সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রে, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সংগঠন।
এর আগে সকাল ১০টায় দৈনিক বাংলা ও নিউজবাংলার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় তোয়াব খানের প্রথম জানাজা। এরপর দুপুর ১২টায় মরদেহ নেওয়া হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় তাকে।
প্রেসক্লাবে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বর্ষীয়ান এ সাংবাদিকের মরদেহ গুলশানে তার নিজ বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে তৃতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে।
২০১৬ সালে একুশে পদক পাওয়া তোয়াব খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল, সাতক্ষীরার রসুলপুর গ্রামে। তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতার মাধ্যমে। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে তিনি দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক হন। এরপর ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। তোয়াব খান ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন। তিনি প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও প্রেস ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের প্রেস সচিবের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তোয়াব খান। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিবও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিকের ভূমিকা পালন করেন তোয়াব খান। সে সময় তার আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় নিয়মিত প্রচারিত হয় ‘পি-ির প্রলাপ’। স্বাধীনতার পরে দৈনিক পাকিস্তান থেকে বদলে যাওয়া দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দৈনিক জনকণ্ঠের শুরু থেকে উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বশেষ তিনি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শ্রদ্ধা-ভালবাসায় মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক সাংবাদিক তোয়াব খানকে বিদায়

আপডেট সময় : ১২:৫৮:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রীয় সম্মানের গান স্যালুট আর শ্রদ্ধা ভালোবাসায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিদায় জানানো হল সাংবাদিক তোয়াব খানকে।
গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে তার কফিন শহীদ মিনারে পৌঁছালে প্রথমেই ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয় এই মুক্তিযোদ্ধাকে, দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।
এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার বঙ্গভবনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সহকারী সামরিক সচিব লে. কর্নেল জিএম রাজিব আহমেদ তোয়াব খানের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় সংবাদকর্মী থেকে থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতকি ও রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এরপর।
একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক গত শনিবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান, তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। শহীদ মিনারে তোয়াব খানের ভাই সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, “আমার প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে তোয়াব খানকে শুধু একটি দিনে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে নয়, তার কর্মের ভিতর দিয়ে তাকে আবিষ্কার করতে হবে, গ্রহণ করতে হবে এবং ধারণ করতে হবে।
“আজকে বাংলাদেশ এক দিকে তাকিয়ে আছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলণ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না। একটি বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা আসছে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার সময় এখনই।”
আওয়ামী লীগের পক্ষে তোয়াব খানের কফিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন “আবদুল গাফফার চৌধুরীর পর বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে তোয়াব খান সম্ভবত সবার সিনিয়র ছিলেন। তিনিও অবশেষে চলে গেলেন। তার মৃত্যুতে আমাদের সংবাদপত্র জগতে এক বটবৃক্ষের বিশাল পতন হল।“
সাংবাদিক তোয়াব খানকে দেখার কথা স্মরণ করে কাদের বলেন, “তিনি হাঁকডাক করতেন না, নেতাগিরি করতেন না। নীরেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাংবাদিকতায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। একাত্তরের শব্দ সৈনিক, বাহান্নোর ভাষা সৈনিক এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অনেক পছন্দ করতেন। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।”
শহীদ মিনারে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ছিলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুর ও উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, সম্প্রতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রয়াত এ সাংবাদিকের প্রতি।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তোয়াব খানের কফিন জাতীয় প্রেসক্লাবে নেওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন ও জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হয় গুলশানে তার নিজ বাসভবনে। বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে আরেকবার জানাজা শেষে এই প্রবীণ সাংবাদিককে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে।
শ্রদ্ধায় ভাসলেন ‘সম্পাদকদের সম্পাদক’ : জাতীয় প্রেসক্লাবে একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান সাংবাদিক, দৈনিক বাংলা ও নিউজ বাংলার সম্পাদক তোয়াব খানকে শেষশ্রদ্ধা জানিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ বিশিষ্টজনেরা। সোমবার দুপুর পৌনে একটার দিকে তার মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স প্রেসক্লাব চত্বরে পৌঁছায়। সেখানে ১টায় জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে টেনিস গ্রাউন্ডে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেন বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকরা। জানাজা শেষে সাংবাদিক, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এ সময় শ্রদ্ধা জানাতে প্রেস ক্লাবে হাজির হন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি। এছাড়াও জানাজার নামাজ শেষে জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সাব-এডিটরস কাউন্সিল, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট, নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং তোয়াব খানের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, ‘যে কোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অনন্য এক ক্ষমতা ছিল তোয়াব খানের। তার সাংবাদিকতা, কর্মজীবন আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।’ প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘চিন্তা ও মননে তিনি আজীবন একজন সক্রিয় সাংবাদিক ছিলেন। তিনি তার কর্মের মধ্যেই বেঁচে ছিলেন, কর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের মাঝে থাকবেন।’
প্রথম আলোর উপসম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘সম্পাদকদের সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। আমরা প্রতিনিয়ত তার কাছ থেকে শিখি। তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আজকে আমরা শোকে ভারাকান্ত। আমাদের সঙ্গে হয়তো প্রকৃতিও আজ কাঁদছে। আমাদের (জাতীয় প্রেস ক্লাব) আজীবন সদস্য তোয়াব ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি সবার কাছে বলব, আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতা আজকে শূন্যস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে। তোয়াব ভাইয়ের চলে যাওয়া মানে সাংবাদিকতার একটি ইতিহাসের অধ্যায় শেষ হওয়া।’
প্রেস ক্লাবে প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজার আগে তোয়াব খানের ছোট ভাই ওবায়দুল কবির খান বলেন, ‘আমার বড় ভাই গত শনিবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ হচ্ছে, যদি উনি কখন আপনাদের সঙ্গে ভুল ব্যবহার বা অন্য কোনও কিছু করে থাকে তবে তাকে ক্ষমা করে দেবেন। একই সঙ্গে তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া রাখবেন।’
জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাজা নামাজ শেষে তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সাব-এডিটর কাউন্সিল, দৈনিক প্রথম আলো,কালেরকণ্ঠ, জনকণ্ঠ,সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রে, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সংগঠন।
এর আগে সকাল ১০টায় দৈনিক বাংলা ও নিউজবাংলার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় তোয়াব খানের প্রথম জানাজা। এরপর দুপুর ১২টায় মরদেহ নেওয়া হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় তাকে।
প্রেসক্লাবে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বর্ষীয়ান এ সাংবাদিকের মরদেহ গুলশানে তার নিজ বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে তৃতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে।
২০১৬ সালে একুশে পদক পাওয়া তোয়াব খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল, সাতক্ষীরার রসুলপুর গ্রামে। তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতার মাধ্যমে। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে তিনি দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক হন। এরপর ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। তোয়াব খান ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন। তিনি প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও প্রেস ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের প্রেস সচিবের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তোয়াব খান। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেস সচিবও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিকের ভূমিকা পালন করেন তোয়াব খান। সে সময় তার আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় নিয়মিত প্রচারিত হয় ‘পি-ির প্রলাপ’। স্বাধীনতার পরে দৈনিক পাকিস্তান থেকে বদলে যাওয়া দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দৈনিক জনকণ্ঠের শুরু থেকে উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বশেষ তিনি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।