আমিরুল মোমেনীন মানিক
সত্তর দশকের কবি ও সাংবাদিক হাসান হাফিজের ৭১তম জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৫৫ সালের ১৫ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ের এলাহিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক। হাসান হাফিজ একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, রম্যলেখক, অনুবাদক, সংগঠক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। মৌলিক ও সম্পাদিত মিলিয়ে দুই শতাধিক গ্রন্থ এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
মধ্যদুপুর। গনগনে রোদ। মন তেতিয়ে আছে। মাথার ওপর তির্যক সূর্য। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়ির অপেক্ষায়। হঠাৎ ডাবলডেকার বাস চোখ পড়ল। গায়ে লেখা ‘তোমার সাথে বসত আমার তোমায় বসবাস’। চোখের সামনে ভুল শব্দের প্রয়োগ দেখে প্রায় ১৮ বছর পেছনে চলে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা আগুনমুখো চেহারা ভেসে উঠল চোখের সামনে। বৈশাখী টেলিভিশনের নিউজরুম। হাসান হাফিজ ভাই আমাদের শেখাচ্ছেন: সাথে সাধু, সঙ্গে চলিত। তাই চলিত শব্দে অবশ্যই সঙ্গে হবে, সাথে নয়।
দুই.
ভুল শব্দ প্রয়োগ দেখে মেজাজের ডিগ্রি ওপরে উঠল। ড্রাইভার কবির অনেক জ্যাম পেরিয়ে গাড়ি নিয়ে আমার সামনে এলো। মনে হলো, অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে যেন একমুঠো রোদ্দুর আমার দু’চক্ষু ভরে… গাড়িতে উঠলাম। কিন্তু নড়াচড়ার নাম নেই। কুতিয়ে কুতিয়ে একটু একটু করে এগোচ্ছে। ভীষণ বিরক্তি। কবির বলল, জ্যামে গান শোনেন স্যার। ও প্লেয়ার বাজিয়ে দিল- দুঃসহ যানজট/পিছিয়ে যাবার পথ বন্ধ/মর্জি মেজাজ হট/মেইন রোড বা অলিগলি/যেখানে যখন চলি/লেগেই আছে দিনরাত্তি/ভোগান্তি উদ্ভট/দুঃসহ যানজট/ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাবাড়/হজম পেটের খাবারদাবার/ছিড়ছি মাথার চুল/তবে কি ভাই বেরোনোটাই নিত্যদিনের ভুল/দুঃসহ যানজট…।
: কী কবির, এই গান কোথায় পেলে?
স্যার, আপনার ইউটিউব চ্যানেলে। জ্যাম লাগলেই আমি শুনি।
: তাই নাকি! এক যুগ আগে গেয়েছিলাম। এটা কবি হাসান হাফিজ ভাইয়ের লেখা গান। চিনেছ তাকে, কবির?
: স্যার, চিনেছি। জাতীয় প্রেস ক্লাবে দেখেছি।
তিন.
হাসান হাফিজ। আমাদের নগরে রোদে ঘামে সংগ্রামে লড়াইয়ে মানুষের মগজ ও চিন্তার অনুরণন থেকে জেগে ওঠা জীবনশিল্পী। বাংলা সাহিত্যের জন্য দুহাত ভরে লিখেছেন। লিখে যাচ্ছেন। কি সাংবাদিকতায়, কী কবিতায়, কী শিশুতোষ লেখায়, আমাদের দৈনিক জীবনযাত্রায় মিশে আছেন তিনি। সাংগঠনিক দক্ষতায় অভূতপূর্ব, সম্পাদনায় তুখোড়। যখন তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের দায়িত্বশীল, তখন দৃঢ়চেতা অভিভাবক; আবার যখন কালের কণ্ঠের সম্পাদনায়, তখন নির্ভুল নিরপেক্ষ সংবাদমানুষ। বাইরে ভীষণ শক্ত একজন মানুষ, কিন্তু আদতে ভেতরে কোমল, নরম, মেঘমল্লার রাগের মতো।
আমাদের পরিবারের ছোট্ট সদস্য আরীজ ও আরজুর পাঠ্যতালিকায়ও হাসান হাফিজ দারুণ আলো করে আছেন। ‘অবাক রঙিন রূপকথা’, ‘রূপকথারা ভিনদেশি’, ‘দূর দেশের রূপকথা’, ‘রকমারি রূপকথা’, ‘আফ্রিকা-এশিয়ার রূপকথা’, ‘মনের মতো রূপকথা’, ‘রঙ বাহারি রূপকথা’, ‘জাপানের রূপকথা’, ‘১৩ দেশের রূপকথা’, ‘সোনালী সব রূপকথা’; আরীজ-আরজুর নিত্যদিনের আনন্দের সহযাত্রী।
চার.
কবিতা ও ছড়ায় ব্যতিক্রমী শব্দ প্রয়োগ, ভিন্নমাত্রিক উপস্থাপন, অপ্রচলিত প্লট হাসান হাফিজকে নিয়ে গেছে অন্য মাত্রায়। একদিন এক গ্রাম সফরের ঘটনা। অজপাড়াগাঁ। দিঘল আল পেরিয়ে গ্রামের মুখে টং দোকান। নিলাম চা বিরতি। দোকানি বললেন, কি নাম ভাই আপনার? নিজের পরিচয় লুকিয়ে বললাম, আমার নাম মানিক হাফিজ। লোকটা আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, আপনি কি কবি হাসান হাফিজের ভাই? আমি বললাম, হ্যাঁ। পরের প্রশ্নটা করলেন দোকানদার। তাইলে কি হেলাল হাফিজও আপনাদের ভাই?
বললাম, হ্যাঁ আমরা তিন ভাই। মানিক হাফিজ, হাসান হাফিজ, হেলাল হাফিজ। খুব মজা পেলেন গ্রামের লোকটা। আরেক কাপ চা খাওয়ানোর জন্য চাপাচাপি করলেন। বিদায়ের আগে সত্যটাই জানালাম। বললাম, হাসান হাফিজ শুধু আমার ভাই নন, ভাইয়ের চেয়ে বেশি কিছু। যখন ফিরতে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হলো, হাসান হাফিজ ভাই একজন গ্রামের মানুষের কাছেও কতা প্রিয়!
২০০৬ সালের কথা। তিনি ছিলেন বার্তা সম্পাদক, আর আমি স্টাফ রিপোর্টার। বলছি বৈশাখী টেলিভিশনের কথা। হাসান হাফিজ ভাই ছিলেন নিউজরুমের নিশানবাহক। অনেক কিছুই শিখেছি এই বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষটির কাছ থেকে। দেড় যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো নানা কর্মতৎপরতায় সাহসের ঈগল হয়ে তরুণদের পাশে থাকেন এই বটবৃক্ষ। একদিন আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, মানিক, আমার কোনো ছোট ভাই নেই, তোমাকে আপন ভ্রাতা মনে করি বলেই জ্বালাতন করি। আমি লজ্জা পেলাম। খানিকটা ঈর্ষান্বিতও হলাম! হাসান হাফিজের ছোট ভাই হওয়া তো কম গর্বের বিষয় নয়!
কবি হাসান হাফিজ ভাই, আমার মতো অসংখ্য তরুণের হৃদয়ে মিশে আছেন আত্মার মানুষ হয়ে।
পাঁচ.
ফ্যাসিবাদী দুঃসময়ে হাসান হাফিজের মতো বরেণ্য কবিও রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন। মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত তার সাহিত্যচর্চাকেও দলীয় মোড়কে ট্যাগ লাগানোর প্রয়াস চালানো হয়। ফলে দীর্ঘদিন মূলধারার তথাকথিত প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতে তিনি ছিলেন প্রায় উপেক্ষিত। তার সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ প্রকাশ করে পত্রিকাগুলো পাঠকপ্রিয় হলেও অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞায় কোথাও তার চাকরি হয়নি।
গণ-অভ্যুত্থানের পর হাসান হাফিজ ভাই জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পান। এক যুগ ধরে বঞ্চিতদের জন্য খুলে যায় নতুন জানালা। আবেদনকারী অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়। তিনি দল-মত-নির্বিশেষে পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীদের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
কবিতা, ছড়া, রূপকথা, গল্প, প্রবন্ধে তিনি যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি দক্ষ নাবিকের মতো প্রেস ক্লাবেও তার নেতৃত্ব সুদৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।
হাসান হাফিজ ভাই নিজে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়েননি। বরং তার মধ্যপন্থি সমন্বয়বাদী চিন্তা সব কাজে তাকে গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষচূড়ায় নিয়ে গেছে।
ছয়.
বন্ধুবৎসল মানুষ হাসান হাফিজ। শত শত গ্রন্থ তিনি তার বন্ধু স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী নিকটজনকে উৎসর্গ করে বদান্যতা দেখিয়েছেন। এটাও মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের দুর্দান্ত এক মাধ্যম। সেই বিনয় অনেকের প্রতি দেখিয়েছেন হাসান হাফিজ। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে কেবল ভালোবেসে তার লেখা শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ ‘বিশ্বসেরা ১২ বিজ্ঞানী’ উৎসর্গ করেছেন। অন্যদিকে বিখ্যাতরাও তাকে অনেক গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন। শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদসহ খ্যাতিমানদের অনেকে তার নামে বই নজরানা করেছেন, শুভেচ্ছাপত্র দিয়েছেন। অগ্রজদের অন্তহীন ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। ফলে হাসান হাফিজকে ঘিরে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে একটি পরিবার তৈরি হয়েছে।
হাসান ভাই মাঝেমধ্যে তার স্নেহপ্রাপ্তদেরও চমকে দেন। এমনই এক ঘটনা। এক জন্মদিনে তিনি আমার জন্য সারপ্রাইজ পাঠালেন। আমি এ রকম উপহার আর পাইনি। আমৃত্যু তার দেওয়া সেই সারপ্রাইজ অনুপ্রেরণা দেবে। আমাকে নিয়ে তার সেই ছড়া উপহারটি ছিল এ রকম-
‘মানিক, ও ভাই মানিক
একটু দাঁড়াও খানিক।
তোমার লেখা, কণ্ঠ ও সুর
আবেশমাখা অনেক সুদূর
বিশ্বজোড়া যায় ছড়িয়ে
পরানটাকে দ্যায় ভরিয়ে
নয় সেটা নয় স্থানিক।
মানিক ও ভাই মানিক
সুর জাগাতে মন জাগাতে
কোমল স্বরের টান আঘাতে
নিচ্ছে সময়? তা নিক।
সেটাই নিয়ম মাফিক।
মানিক, ও ভাই মানিক
তোমার গানে ধন্যি জীবন
স্বস্তি কিছু পায় পোড়া মন
তুমি গাতক, গানিক
সাত রাজার ধন মানিক
হাই আমিরুল হে মোমেনীন
তোমার জন্যে এ ছড়া-ফুল
নয় তা আনুষ্ঠানিক।’
সাত.
বড় মানুষরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ দেখতে পান। হাসান হাফিজ সে রকম বড় মানুষ। তার অন্তর্দৃষ্টি গভীর। হাসান হাফিজ তার কবিতায় লিখেছেন- ‘মানুষ তেমন নয়, নিজেদের মধ্যে তারা সুনিপুণ জিইয়ে কেন রাখে/বিদ্বেষের চোরাবিষ, ঈর্ষা ও জ্বলুনি ক্রোধ মিশে যায় রক্তসঞ্চালনে/নদীর মতন খোলা উদ্দাম সংস্কারহীন মানুষেরা হতেই পারে না!’ যখন সংস্কার নিয়ে সারা দেশ তোলপাড় হয়নি, তারও বহু আগে হাসান হাফিজ অকপটে বলেছিলেন, নদীর মতন খোলা উদ্দাম সংস্কারহীন মানুষেরা হতেই পারে না!
হাসান হাফিজ ভাই হলেন আমাদের হাতের পাঁচ। জীবনের নানা প্রয়োজনে নানা অনুষঙ্গে তার সাহিত্য দিয়েই আমরা ঘর-সংসার করি, খাইদাই, পরিচয় দিই। এ রকম জীবনশিল্পী কজন আছেন, যিনি তার নিজের অজান্তেই অসংখ্য তরুণের হৃদয়ে বুনে দিয়েছেন ভালোবাসার সুরভি। সেই সুরভিবৃক্ষ চারাগাছ থেকে বৃহৎ হচ্ছে, ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে বিস্তৃত আঙিনায়। সময় যত যাবে, সেই বৃক্ষের ছায়া তত প্রগাঢ় প্রশান্তিদায়ক হবে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ