অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), ফুসফুসসহ মুখগহ্বরে ক্যান্সার প্রতিরোধে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। তামাকজাতীয় দ্রব্য ও ধূমপান থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারলে সিওপিডি রোগ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। ধূমপান না করা, তামাক চাষ বন্ধ করা এবং তামাক জাতীয় দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে সিওপিডি রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব।
বাংলাদেশে জর্দা ও গুলের কারখানার আশপাশের এলাকায় তামাকজাতীয় দ্রব্যের বিষাক্ত গুঁড়ো বাতাস দূষিত করছে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে তা প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টি করছে। সিগারেট, জর্দা, গুল, সাদাপাতা- এসবই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাকে রয়েছে চার হাজারের বেশি বিষাক্ত উপাদান। কাঁচা তামাকে রয়েছে দুই হাজার বিষাক্ত উপাদান। বাকি দুই হাজার সৃষ্টি হয় তামাক পোড়ানোর ফলে।
ইদানীং আবার ই-সিগারেট বের হয়েছে। এটাও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। মানবদেহের সব অঙ্গপ্রতঙ্গের জন্য তামাক খারাপ প্রভাব ফেলে। ক্যান্সার, পক্ষাঘাত, হৃদরোগ, স্নায়ুবৈকল্য, অন্ধত্ব, লিভার ও কিডনির বিভিন্ন রোগ, ফুসফুসের জটিল সমস্যার কারণ হলো তামাক। ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, পক্ষাঘাত, ফুসফুসের ক্যান্সার, জটিল বক্ষ্যব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। তামাক উচ্চ রক্তচাপ রোগও সৃষ্টি করে।
সিগারেটে প্রায় পঞ্চাশটির মতো রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যা মানবশরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। তামাকে নিকোটিন নামে আরেকটি উপাদান আছে যা আসক্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী। অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে যৌন সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি।
ধূমপায়ীদের কারণে অধূমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে নারীরা কর্মস্থলে ও নারী-শিশুরা পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এছাড়া মেয়েদের মধ্যেও ধূমপানের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে মা ও অনাগত সন্তান মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটার হার বেশি। এছাড়া গর্ভস্থ ভ্রƒনেরও অনেক ক্ষতি করে ধূমপান। যেমন জন্মের সময় নবজাতকের ওজন আদর্শ ওজনের তুলনায় কম হওয়া ও সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোমের হার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৬০ লাখ লোক তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায়। এর প্রায় ৬ লাখ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।
৩১ মে ছিল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘টোবাকো’স থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট’ অর্থাৎ তামাক আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীতে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, কর বৃদ্ধি, ধূমপানমুক্ত স্থান বৃদ্ধি, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে এই দিবসটিতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সর্বাপেক্ষা উত্তম পদ্ধতি হলো তামাক চাষ বন্ধ করা। তামাকজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতা বন্ধ করতে হবে। তামাকজাতীয় দ্রব্যের ওপর সর্বোচ্চ মাত্রায় কর আরোপ করতে হবে। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়, প্রদর্শন, বিজ্ঞাপন ও প্রচার-প্রচারণা বন্ধে যে নির্দেশনা দেওয়া আছে, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া যায়।
লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ এবং কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ও ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধ বাংলাদেশ হোক তামাকমুক্ত
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ