ঢাকা ০৬:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে মৃত্যু

শৈশবে বাবা-মা হারা আবুল কালামের স্ত্রী-সন্তানকে দেখবে কে?

  • আপডেট সময় : ০৯:৩৬:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
  • ২৮ বার পড়া হয়েছে

আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী-সন্তান -ছবি পরিবার থেকে সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন আবুল কালাম। এরপর ভাই-বোনদের সংসারে বেড়ে ওঠেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের প্রিয় মানুষটি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা গেছেন।

রোববার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে এর আঘাতে নিহত হন ওই যুবক। আবুল কালামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। তাঁর এমন অকালমৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন ও গ্রামের মানুষেরা।
ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে আবুল কালাম। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে আবুল কালাম ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। ২০ বছর আগে তাঁর বাবা ও মা মারা যান। এরপর তিনি বড় হন বড় ভাই ও বোনদের কাছে।

সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় যান আবুল কালাম। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়েসন্তান রয়েছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন। ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন। ওই কাজের জন্যই প্রতিদিন তিনি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা যাতায়াত করতেন। প্রতিদিনের মতো রোববার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে আসেন আবুল কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হন। রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম। এরপর গণমাধ্যমের সংবাদে পরিবারের সদস্যরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।

আবুল কালামের মৃত্যুর খবরে শোকার্ত ঈশ্বরকাটি গ্রামের বাসিন্দারা। কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামে থাকা তাঁর স্বজনেরা। অনেকে ছুটে যান ঢাকায়। নড়িয়া উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কীর্তিনাশা নদী। নদীর তীরের ঈশ্বরকাটি গ্রামটি উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে। বিকেলে ঈশ্বরকাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বাড়িতে চার ভাইয়ের টিনের চারটি বসতঘর রয়েছে। গ্রামে এলে একটি ঘরে থাকতেন আবুল কালাম। সেই ঘরটি তালাবদ্ধ। তাঁর বড় ভাই খোকন চোকদারের ঘরে বসে কাঁদছিলেন বড় বোন সেলিনা বেগম; কাঁদছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের মানুষেরা ও এলাকার তাঁর বন্ধুবান্ধব বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন।

আবুল কালামের বাল্যকালের বন্ধু রিহিনুজ্জামান বলেন, ‘এক মাস আগে আবুল কালাম যখন গ্রামে এসেছিল, তখন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার সেই হাস্যোজ্জ্বল বন্ধুটি আজ নেই, ভাবতে পারছি না।’
ঘরে বসে আবুল কালামের ছবি হাতে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বড় বোন সেলিনা বেগম বলছিলেন, ‘আমার ভাইটি সারা জীবন কষ্ট করেছে। কিশোর বয়সে বাবা–মাকে হারিয়েছে। রোববার দুই শিশুসন্তান রেখে সে নিজেও না ফেরার দেশে চলে গেছে। এখন এই শিশু দুটির কী অবস্থা হবে? কে তাদের পিতৃস্নেহ দেবে। তার বিধবা স্ত্রী কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? আল্লাহ, তুমি আমার ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে এমন কেন করলা।’
আবুল কালামের বড় ভাই খোকন চোকদার গ্রামের বাড়িতে থাকেন। পারিবারিক জমিজমা দেখাশোনা করেন। পারিবারিক সেসব জমিজমা ও ফসলাদির খোঁজ নেওয়ার জন্য গত মাসে আবুল কালাম গ্রামের বাড়িতে আসেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে কাজ সেরে আবার ঢাকায় ফিরে যান। খোকন চোকদার বলেন, ‘ওটাই যে আমার ভাইয়ের শেষযাত্রা হবে, আমি বুঝতে পারিনি। এখন সে ফিরবে প্রাণহীন দেহ নিয়ে। আমরা স্বজনেরা অপেক্ষায় আছি তার প্রাণহীন দেহটার জন্য। আমাদের পরিবারের সঙ্গে কেন এমন হলো। আমার ভাইটি তো কারও কোনো ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন অকালে তাকে প্রাণ হারাতে হলো। তার স্ত্রী-সন্তানকেইবা এখন কে দেখবে?’

পৌনে ৭ ঘণ্টা পর মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু: রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় মেট্রোরেল চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ওই দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আড়াই ঘণ্টা পর বেলা তিনটায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়। আর পৌনে সাত ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে।
তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি: রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় রোববার দুপুরে মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারী নিহতের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সরকার নিহত পথচারীর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তাৎক্ষণিক ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। তার দাফন-কাফনের সব খরচও সরকার বহন করবে।
পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ। কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইএসটি)-এর বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটি-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএল-এর লাইন-৫ প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত পূর্ববর্তী দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত।
কমিটিকে আগামী ২ (দুই) সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পরপরই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজসহ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ডিএমটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা, কর্মক্ষম সদস্যকে দেওয়া হবে চাকরি: সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া পরিবারে কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি থাকলে তাকে চাকরি দেওয়া হবে মেট্রোরেলে। রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন। ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব মেট্রোরেল গ্রহণ করবে। প্রাথমিকভাবে নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পরে নিহতের পরিবারে যদি কর্মক্ষম সদস্য থাকে তাহলে তাকে চাকরি দেওয়া হবে মেট্রোরেলে।’ তিনি বলেন, ‘আহতদের আমি একটু পরে হাসপাতালে দেখতে যাবো এবং তাদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

সানা/আপ্র/২৬/১০/২০২৬

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে মৃত্যু

শৈশবে বাবা-মা হারা আবুল কালামের স্ত্রী-সন্তানকে দেখবে কে?

আপডেট সময় : ০৯:৩৬:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন আবুল কালাম। এরপর ভাই-বোনদের সংসারে বেড়ে ওঠেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের প্রিয় মানুষটি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা গেছেন।

রোববার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে এর আঘাতে নিহত হন ওই যুবক। আবুল কালামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। তাঁর এমন অকালমৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন ও গ্রামের মানুষেরা।
ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে আবুল কালাম। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে আবুল কালাম ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। ২০ বছর আগে তাঁর বাবা ও মা মারা যান। এরপর তিনি বড় হন বড় ভাই ও বোনদের কাছে।

সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় যান আবুল কালাম। সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়েসন্তান রয়েছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন। ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন। ওই কাজের জন্যই প্রতিদিন তিনি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা যাতায়াত করতেন। প্রতিদিনের মতো রোববার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে আসেন আবুল কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হন। রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম। এরপর গণমাধ্যমের সংবাদে পরিবারের সদস্যরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।

আবুল কালামের মৃত্যুর খবরে শোকার্ত ঈশ্বরকাটি গ্রামের বাসিন্দারা। কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামে থাকা তাঁর স্বজনেরা। অনেকে ছুটে যান ঢাকায়। নড়িয়া উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কীর্তিনাশা নদী। নদীর তীরের ঈশ্বরকাটি গ্রামটি উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে। বিকেলে ঈশ্বরকাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বাড়িতে চার ভাইয়ের টিনের চারটি বসতঘর রয়েছে। গ্রামে এলে একটি ঘরে থাকতেন আবুল কালাম। সেই ঘরটি তালাবদ্ধ। তাঁর বড় ভাই খোকন চোকদারের ঘরে বসে কাঁদছিলেন বড় বোন সেলিনা বেগম; কাঁদছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের মানুষেরা ও এলাকার তাঁর বন্ধুবান্ধব বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন।

আবুল কালামের বাল্যকালের বন্ধু রিহিনুজ্জামান বলেন, ‘এক মাস আগে আবুল কালাম যখন গ্রামে এসেছিল, তখন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার সেই হাস্যোজ্জ্বল বন্ধুটি আজ নেই, ভাবতে পারছি না।’
ঘরে বসে আবুল কালামের ছবি হাতে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বড় বোন সেলিনা বেগম বলছিলেন, ‘আমার ভাইটি সারা জীবন কষ্ট করেছে। কিশোর বয়সে বাবা–মাকে হারিয়েছে। রোববার দুই শিশুসন্তান রেখে সে নিজেও না ফেরার দেশে চলে গেছে। এখন এই শিশু দুটির কী অবস্থা হবে? কে তাদের পিতৃস্নেহ দেবে। তার বিধবা স্ত্রী কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? আল্লাহ, তুমি আমার ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে এমন কেন করলা।’
আবুল কালামের বড় ভাই খোকন চোকদার গ্রামের বাড়িতে থাকেন। পারিবারিক জমিজমা দেখাশোনা করেন। পারিবারিক সেসব জমিজমা ও ফসলাদির খোঁজ নেওয়ার জন্য গত মাসে আবুল কালাম গ্রামের বাড়িতে আসেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে কাজ সেরে আবার ঢাকায় ফিরে যান। খোকন চোকদার বলেন, ‘ওটাই যে আমার ভাইয়ের শেষযাত্রা হবে, আমি বুঝতে পারিনি। এখন সে ফিরবে প্রাণহীন দেহ নিয়ে। আমরা স্বজনেরা অপেক্ষায় আছি তার প্রাণহীন দেহটার জন্য। আমাদের পরিবারের সঙ্গে কেন এমন হলো। আমার ভাইটি তো কারও কোনো ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন অকালে তাকে প্রাণ হারাতে হলো। তার স্ত্রী-সন্তানকেইবা এখন কে দেখবে?’

পৌনে ৭ ঘণ্টা পর মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু: রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় মেট্রোরেল চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ওই দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আড়াই ঘণ্টা পর বেলা তিনটায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়। আর পৌনে সাত ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে।
তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি: রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় রোববার দুপুরে মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারী নিহতের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সরকার নিহত পথচারীর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তাৎক্ষণিক ৫ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। তার দাফন-কাফনের সব খরচও সরকার বহন করবে।
পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ। কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (এমআইএসটি)-এর বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটি-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএল-এর লাইন-৫ প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। উপসচিব আসফিয়া সুলতানা কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত পূর্ববর্তী দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধকল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করাও কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত।
কমিটিকে আগামী ২ (দুই) সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পরপরই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজসহ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ডিএমটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা, কর্মক্ষম সদস্যকে দেওয়া হবে চাকরি: সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া পরিবারে কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি থাকলে তাকে চাকরি দেওয়া হবে মেট্রোরেলে। রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন। ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘নিহত ব্যক্তির পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব মেট্রোরেল গ্রহণ করবে। প্রাথমিকভাবে নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পরে নিহতের পরিবারে যদি কর্মক্ষম সদস্য থাকে তাহলে তাকে চাকরি দেওয়া হবে মেট্রোরেলে।’ তিনি বলেন, ‘আহতদের আমি একটু পরে হাসপাতালে দেখতে যাবো এবং তাদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

সানা/আপ্র/২৬/১০/২০২৬